আজ শান্তিনিকেতন আশ্রমে নিজের জন্মোৎসবের উদ্যোগ দেখে তাঁর কুণ্ঠিত জিজ্ঞাসা, ‘জন্ম তো আমার অর্ধ শতাব্দীর প্রান্তে কোথায় পড়ে রয়েছে, সে-যে কবেকার পুরানো কথা তার আর ঠিক নেই– মৃত্যুদিনের মূর্তি তার চেয়ে অনেক বেশি কাছে এসেছে– এই জীর্ণ জন্মদিনকে নিয়ে উৎসব করবার বয়স কি আমার?’
১৩.
১৩১৭ পঁচিশে বৈশাখ উপাসনাগৃহে রবীন্দ্রনাথের অভিভাষণটি শান্তিনিকেতন গ্রন্থে আছে ‘জন্মোৎসব’ শিরোনামে। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘বস্তুত, নিজের জন্মদিন বৎসরের অন্য ৩৬৪ দিনের চেয়ে নিজের কাছে কিছুমাত্র বড়ো নয়। যদি অন্যের কাছে তার মূল্য থাকে তবেই তার মূল্য।’
জন্মগ্রহণের সময় আত্মীয় পরিজনেরা উৎসব করেছিলেন, সে উৎসব নবজাতকের নিজের উৎসব নয়। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, অজ্ঞাত এক গোপনীয়তার মধ্য থেকে নবজাতকের আবির্ভাবকে যাঁরা একটি পরম লাভ মনে করেছিলেন, তাঁদেরই উৎসব। ‘আনন্দলোক থেকে একটি আনন্দ-উপহার পেয়ে তাঁরা আত্মার আত্মীয়তার ক্ষেত্রকে বড়ো করে উপলব্ধি করেছিলেন, তাই তাঁদের উৎসব।’
কিন্তু জীবনের প্রায় অর্ধশতাব্দী অতিক্রম করে কবির মনে হচ্ছে, আত্মীয় পরিজনের আনন্দের উপলব্ধি চিরকাল নবীন থাকে না। নবীন অতিথি পুরনো হতে থাকে, তার আবির্ভাবের রহস্যময়তা হারিয়ে যেতে থাকে। ক্রমে যখন তার কাছে নতুন কিছু আর আশা করার থাকে না, সে হয়ে ওঠে প্রতিদিনের ব্যবহারের জিনিস, তখন তার জন্মদিনের উৎসবটিও হয়ে ওঠে দায়সারা প্রথাপালন। উৎসব তো প্রতিদিনের জিনিস নয়, সে যে নবীনতারই উপলব্ধি। আজ রবীন্দ্রনাথের ‘সেই দিনের কথা মনে পড়ছে যখন আমার জন্মদিন নবীনতার উজ্জ্বলতায় উৎসবের উপযুক্ত ছিল।’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এই জগতে আমরা চোখে দেখার, কানে শোনার অনেক কিছুই পাই, কিন্তু সবকিছু কি আপন করে পাই? অসংখ্য মানুষ আমাদের চারপাশে রয়েছেন, কিন্তু আমাদের আপন নন বলে তাঁদের মধ্যে আমাদের আনন্দ নেই। আপন করে পাওয়ার জন্যই মানুষের যত কিছু সাধনা। শিশুর জন্মগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই তার মা-বাবা ঘরের লোক আপন লোককে পায়, অনায়াসেই পায়। সেই আপন করে পাওয়ার আনন্দেই উৎসব। মানুষের জন্ম একবার নয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
“তখন আমার তরুণ বয়স। প্রভাত হতে না হতে প্রিয়জনেরা আমাকে কত আনন্দে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে ‘আজ তোমার জন্মদিন’। আত্মীয়দের সেই আনন্দ-উৎসাহের মধ্যে মনুষ্যজন্মের একটি বিশেষ মূল্য সেদিন অনুভব করতুম। যেদিকে সংসারে আমি অসংখ্য বহুর মধ্যে একজনমাত্র, সেদিক থেকে আমার দৃষ্টি ফিরে গিয়ে যেখানে আমি আমিই, যেখানে আমি বিশেষভাবে একমাত্র, সেখানেই আমার দৃষ্টি পড়ত– নিজের গৌরবে সেদিন প্রাতঃকালে হৃদয় বিকশিত হয়ে উঠত।”
আজ শান্তিনিকেতন আশ্রমে নিজের জন্মোৎসবের উদ্যোগ দেখে তাঁর কুণ্ঠিত জিজ্ঞাসা, ‘জন্ম তো আমার অর্ধ শতাব্দীর প্রান্তে কোথায় পড়ে রয়েছে, সে-যে কবেকার পুরানো কথা তার আর ঠিক নেই– মৃত্যুদিনের মূর্তি তার চেয়ে অনেক বেশি কাছে এসেছে– এই জীর্ণ জন্মদিনকে নিয়ে উৎসব করবার বয়স কি আমার?’ নিজেই এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন রবীন্দ্রনাথ, জন্মোৎসবের ভিতরকার সার্থকতাটা কীসে।
এই জগতে আমরা চোখে দেখার, কানে শোনার অনেক কিছুই পাই, কিন্তু সবকিছু কি আপন করে পাই? অসংখ্য মানুষ আমাদের চারপাশে রয়েছেন, কিন্তু আমাদের আপন নন বলে তাঁদের মধ্যে আমাদের আনন্দ নেই। আপন করে পাওয়ার জন্যই মানুষের যত কিছু সাধনা। শিশুর জন্মগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই তার মা-বাবা ঘরের লোক আপন লোককে পায়, অনায়াসেই পায়। সেই আপন করে পাওয়ার আনন্দেই উৎসব। মানুষের জন্ম একবার নয়। বীজ মরে যেমন অঙ্কুর, অঙ্কুর থেকে যেমন গাছ, মানুষকেও বারে বারে নতুন জীবনে প্রবেশ করতে হয়। প্রত্যেক মানুষই দ্বিজ। গর্ভের মধ্যে তার প্রথম জন্ম, দ্বিতীয় জন্ম মুক্ত পৃথিবীতে। এক জন্ম আপনাকে নিয়ে, আর-এক জন্ম সকলকে নিয়ে।
জঠরের মধ্যে ভ্রুণ থাকে সমস্ত কিছুর কেন্দ্রে, পৃথিবীতে জন্মমাত্র সে অনেকের অন্তর্বর্তী। তেমনি স্বার্থলোকে আমিই থাকি কেন্দ্রে, মঙ্গললোকে আমি সমগ্রের অন্তর্বর্তী। সমগ্রের প্রাণই সেই আমি-র প্রাণ, সমগ্রের ভালোমন্দই সে আমি-র ভালোমন্দ। মাতৃজঠরের নিশ্চিন্ত আরামশয্যা ছেড়ে পৃথিবীতে মুক্তিলাভ করার পর মানুষকে অনেক দুঃখস্বীকার করতে হয়, নিজের সঙ্গে অনেক সংগ্রাম করতে হয়। তেমনই, স্বার্থের জঠরের দ্বিধাহীন আরামশয়ান থেকে মনুষ্যত্বে মুক্ত হয়ে বিরোধের ধন্দে পড়ে মানুষের দুঃখের অন্ত থাকে না। ত্যাগ তার পক্ষে সহজ হয় না, তবু ত্যাগ তাকে করতেই হয়। বাধ্যতার সেই ত্যাগের মধ্যে তার সম্পূর্ণ আনন্দ থাকে না, তবু চেষ্টা তাকে করতেই হয়। যে শ্রেয়কে আশ্রয় করে সে অহংকার থেকে মুক্তি পাবে, অহংকার গোপনে সেই শ্রেয়কেই আশ্রয় করে বসতে থাকে। জন্মদিনের উৎসবও তাই ব্যর্থ হতে থাকে।
১৩১৭ পঁচিশে বৈশাখ উপাসনাগৃহে নিজের জন্মদিনের উৎসবে রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণ, ‘এই যেখানে তোমাদের সকলের সঙ্গে আমি আপন হয়ে বসেছি, এ আমার সংসারলোক নয়, এ মঙ্গললোক। এখানে দৈহিক জন্মের সম্বন্ধ নয়, এখানে অহেতুক কল্যাণের সম্বন্ধ।’ ‘একটি মঙ্গললোকের সম্বন্ধে তোমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমি তোমাদের আপন হয়েছি, সেইটে তোমরা হৃদয়ে জেনেছ– এবং সেইজন্যেই আজ তোমরা আমাকে নিয়ে এই উৎসবের আয়োজন করেছ, এ কথা যদি সত্য হয়, তবেই আমি আপনাকে ধন্য বলে মনে করব; তোমাদের সকলের আনন্দের মধ্যে আমার নূতন জীবনকে সার্থক বলে জানব।’