Robbar

মনোজ তিওয়ারি চিরকালের ‘রংবাজ’, জার্সির হাতা তুলে ঔদ্ধত্যের দাদাগিরিতে বিশ্বাসী

Published by: Robbar Digital
  • Posted:February 3, 2024 8:34 pm
  • Updated:February 3, 2024 8:42 pm  

‘আপোস’ শব্দটা তাঁর অভিধানে নেই। ছিল না কোনওকালেই। তাই বারবার উপেক্ষা, অবহেলা জুটেছে। তা সত্ত্বেও নিজেকে একচুলও বদলাননি। ক্রিকেটজীবনের সায়াহ্নে পৌঁছেও একইরকম রয়ে গিয়েছেন। কুঁকড়ানো আপস নয়, প্রতিবাদ যাঁর রন্ধ্রে। তিনি, মনোজ তিওয়ারি। বঙ্গ-ক্রিকেটের দলপতি, বাংলা ক্রিকেটের ‘মন্ত্রীমশাই’।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

মনোজ তিওয়ারির একটা বড় দোষ আছে। মনোজ তিওয়ারি কিছুতেই নতশির হতে শিখলেন না!

জল-হাওয়ার দূষণের সঙ্গে এদেশে মানুষ ছোট থেকে বড় হয় একটা শব্দ কোলে-কাঁখে নিয়ে। আপস। ডাল-ভাতের মতোই যা সহজাত জীবনে। ব্যবসাপত্তর, চাকরি-বাকরি, হাট-বাজার। ঘর-সংসার। অদৃশ্য ছায়ার মতো নর-শরীরের পাশেপাশে এ-শব্দ চলতে থাকে। মাইনে বাড়ানোর লোভে ঊর্ধ্বতনের অন্যায়ের সঙ্গে আপস। ব্যবসায়িক শাখাপ্রশাখা বিস্তারের কামনায় রাজনৈতিক নেতার অঙ্গুলিহেলনের সঙ্গে আপস। সংসারে শান্তির তাড়নায় মুখরা গিন্নির সঙ্গে আপস। ক্রিকেট কিংবা ফুটবল মাঠও আলাদা কিছু নয়। সেখানেও মানিয়ে-গুছিয়ে চলতে হয়। মন সায় না দিলেও সয়ে নিতে হয়‌। কারণ, মানুষের বড় হওয়ার সাধ, অনেক বড়। মনোজ তিওয়ারি এ-সবের কিছুই পারলেন না। মনোজ তিওয়ারি আপসটাই করতে পারলেন না।‌ মনোজ তিওয়ারি তাই বড় ক্রিকেটারও হলেন না!

Manoj Tiwary | Manoj Tiwary rescinds retirement, vows to lead Bengal cricket to Ranji Trophy glory - Telegraph India
মনোজ তিওয়ারি

আজ আক্ষেপ হয় না? মনে হয় না যে, জীবনকে রিওয়াইন্ড করার একটা সুযোগ পেলে সব ভুল একে-একে শুধরে নিতাম? আইপিএল কেরিয়ার মধ্যগগনে যখন, কেকেআর অধিনায়ক গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে ঝামেলা বাঁধিয়ে দিলেন। দেশের হয়ে সেঞ্চুরির পর‌ অবিচারের শিকার হলেন যখন, শান্ত থাকতে পারলেন না।‌ আবার মুখ খুলে বসলেন। বাংলার জাতীয় নির্বাচককে পর্যন্ত ছাড়লেন না।‌ এখন মনে হয় না, যদি একটু আপস করে নিতাম? কী আর এমন যেত-আসত?

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

‘অভাগীর স্বর্গ’-এর কাঙালির মতো মনোজকেও পলকহীন দেখতে হয়েছে রনজি জয়ের স্বপ্ন-ধোঁয়া ঘুরে-ঘুরে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে! এক-আধবার নয়, চার-চার বার! চার বার রনজি ফাইনালে উঠেও শূন্য হৃদয়ে ফিরতে হয়েছে বঙ্গ ক্রিকেটের বর্তমান নৃপতিকে। যা খেলছে বাংলা, এবারও হয়তো হবে না। এবারও হয়তো সে সাধ কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকবে। মনোজকেও চলে যেতে হবে, কিটব্যাগের আলিঙ্গন ছেড়ে, কালের নিয়মে। এ-বছরই যে শেষ!

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

এ আজকের কথা নয়। বছরখানেক আগের‌ এক আড্ডার।‌ উদাসীন হাসিতে বাংলা অধিনায়ক উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার আগে খুব মাথা গরম হয়ে যেত। মাথা গরম করে কিছু ভুলও করে ফেলেছি। যা করা আমার উচিত হয়নি। আমাকে আমার স্ত্রী অনেক শান্ত করেছে বলতে পারো। কিন্তু আপস আমি কখনও করতে পারিনি। আজও পারি না। ওটা আমার ধাতে নেই। তাই কোনও আক্ষেপও নেই।’ ঈষৎ আনমনা হয়ে শেষে যোগ করেছিলেন, “আর আমি কিছুই পাইনি কে বলল? মানছি, আমার ভারতের কেরিয়ার মন মতো হয়নি। কিন্তু বাংলা? বাংলা কি আমাকে কম কিছু দিয়েছে? দু’দশক ধরে বাংলার হয়ে খেলছি।‌ অধিনায়কত্ব করেছি। একটা রনজি ট্রফি জেতার সাধ আছে। জানি না, হবে কি-না? না পেলে অপূর্ণতা থাকবে। কিন্তু দুঃখ থাকবে না।”

তা পেয়েছেন বটে মনোজ। এই ক’দিন আগে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১০,০০০ রান পূর্ণ করলেন। বাংলা তাঁকে প্রাচুর্যে ভরিয়ে দিয়েছে। আবার দেয়ওনি। ‘অভাগীর স্বর্গ’-এর কাঙালির মতো মনোজকেও পলকহীন দেখতে হয়েছে রনজি জয়ের স্বপ্ন-ধোঁয়া ঘুরে-ঘুরে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে! এক-আধবার নয়, চার-চার বার! চার বার রনজি ফাইনালে উঠেও শূন্য হৃদয়ে ফিরতে হয়েছে বঙ্গ ক্রিকেটের বর্তমান নৃপতিকে। যা খেলছে বাংলা, এবারও হয়তো হবে না। এবারও হয়তো সে সাধ কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকবে। মনোজকেও চলে যেতে হবে, কিটব্যাগের আলিঙ্গন ছেড়ে, কালের নিয়মে। এ-বছরই যে শেষ!

Ranji Trophy | Manoj Tiwari scores 201 not out against Madhya Pradesh in Ranji Trophy dgtl - Anandabazar

একদিক থেকে দেখলে, কাঙালির চেয়ে কম অভাগা নন‌ মনোজ। প্রতিভার সূর্য যে সময় প্রখর তাপ ছড়াচ্ছে, টেস্ট অভিষেক প্রহর গুনছে, চোট লেগে গেল। সেই যে সুযোগ সটকে পড়ল, সহজে আর ফিরে এল না। পরে ওয়ান ডে-তে সুযোগ পেলেন। সেঞ্চুরি করলেন। প্রতিদানে তাঁকে ১৪ ম্যাচ বসিয়ে দিল ধোনির ভারত। আইপিএল ফাইনালে ক্যামিও খেলে কেকেআরকে চ্যাম্পিয়ন করলেন। দু’দিন পর সেই টিমেরই অধিনায়ক, মনোমালিন্যের জেরে বাস থেকে নামিয়ে হোটেল ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। গুমরে উঠতেন একটা সময় পর্যন্ত মনোজ।‌ হাহাকার করতেন‌ নির্জনে বসে। মৃত স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতেন অলীক আশাবাদের সার-জল দিয়ে। ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে চার নম্বর নিয়ে ভারত যখন খাবি খাচ্ছে, মনোজ কেন কে জানে ভেবেছিলেন, তাঁকে ভাবা হতে পারে। চার নম্বরে। কিন্তু দ্রুতই বুঝে যান, সে আশা গুড়ে বালি। তৎকালীন পূর্বাঞ্চল নির্বাচক দেবাং গান্ধীকে বারবার ফোন করতেন সে-সময় মনোজ। নিজের রোডম্যাপ জানার অভিলাষে। দেবাং ফোনটাই ধরেননি!

কাঁহাতক আর উপেক্ষা-অবিচার সহ্য হয় মানুষের? কত দিন আর শাসকের চাবুকের ভয়ে ঠোঁটে তালাচাবি ঝুলিয়ে বসে থাকা যায়? বিস্ফোরণ তাই অবধারিত ছিল। যা হয়েছে। প্রকাশ্যে। বিভিন্ন সময়ে। আক্রান্ত কখনও হয়েছেন গম্ভীর, কখনও দেবাং, কখনও ধোনির তৎকালীন ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট। দোষ দেওয়াও যায় না মনোজকে। প্রতিটা ঘটনার সঙ্গে জড়িত ‘অপরাধ’কে শুধরোনোর পর্যাপ্ত সময় দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কোথায় আর পেয়েছেন প্রাপ্য প্রায়শ্চিত্ত! ‘গুস্তাখি’ মাফও তাই হয়নি! আসলে ‘সেকেন্ড ফিডল’-এর ন্যাদাভোঁদা জীবন কোনওকালে পছন্দ ছিল না মনোজের। পারতেন না ‘জো হুজুর’-এর জীবন কাটাতে। চিরকালের ‘রংবাজ’ ক্রিকেটার তিনি। জার্সির হাতা তুলে ঔদ্ধত্যের দাদাগিরিতে বিশ্বাসী। প্রতিবাদ যাঁর রন্ধ্রে। কুঁকড়ানো আপস নয়।

ক্যাপ্টেন মনোজেই আস্থা, বাংলার রঞ্জি দলে একঝাঁক নতুন মুখ - Bengali News | Ranji Trophy 2024: Bengal Squad announced for first two matches, Veteran batter Manoj Tiwari to Lead | TV9 Bangla News

আর হ্যাঁ, লেখার মধ্যভাগে ভুল লিখেছি। ভুল লিখেছি যে, মনোজ তিওয়ারি বড় ক্রিকেটার হতে পারলেন না। আমাদের মধ্যবিত্ত মানসিকতার পাপী-তাপী জীবনে প্রকৃত বড়-র বোধটা বড় ছোট। ব্যাঙ্ক ব্যালান্স, ট্রফির বাইরেও একটা ব্যালান্স-শিট পড়ে থাকে। জীবন সায়াহ্নে মানুষকে মেলাতে যা বসতে হয়। যে ব্যালান্স-শিটে মানসম্মান-মর্যাদা-শিরদাঁড়ার দুষ্প্রাপ্য মুদ্রা একমাত্র চলে। সেখানে নিশ্চিত জিতে যাবেন মনোজ। সে ময়দান তিনি ছাড়তে পারবেন উন্নত শির নিয়ে। অবলীলায়।

শ্রীযুক্ত মনোজ তিওয়ারি, তথাকথিত বড় ক্রিকেটার আপনি হতে পারেননি। শুধু মানুষের মতো মানুষ হয়েছেন মাত্র!

…পড়ুন খেলাইডোস্কোপ-এর অন্যান্য পর্ব…

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৩: অনুষ্টুপ ছন্দ বুঝতে আমাদের বড় বেশি সময় লেগে গেল

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১২: একটা লোক কেমন অনন্ত বিশ্বাস আর ভালোবাসায় পরিচর্যা করে চলেছেন বঙ্গ ক্রিকেটের

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১১: সম্বরণই বঙ্গ ক্রিকেটের বার্নার্ড শ, সম্বরণই ‘পরশুরাম’

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১০: যাঁরা তৈরি করেন মাঠ, মাঠে খেলা হয় যাঁদের জন্য

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৯: খণ্ড-অখণ্ড ভারতবর্ষ মিলিয়েও ক্রিকেটকে সম্মান জানাতে ইডেনতুল্য কোনও গ্যালারি নেই

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৮: ২০২৩-এর আগে আর কোনও ক্রিকেট বিশ্বকাপ এমন ‘রাজনৈতিক’ ছিল না

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৭: রোহিত শর্মার শৈশবের বাস্তুভিটে এখনও স্বপ্ন দেখা কমায়নি

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৬: বাংলা অভিধানে ‘আবেগ’ শব্দটাকে বদলে স্বচ্ছন্দে ‘বাংলাদেশ’ করে দেওয়া যায়!

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৫: ওভালের লাঞ্চরুমে জামাইআদর না থাকলে এদেশে এত অতিথি সৎকার কীসের!

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৪: ইডেনের কাছে প্লেয়ার সত্য, ক্রিকেট সত্য, জগৎ মিথ্যা!

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৩: এ বাংলায় ডার্বিই পলাশির মাঠ

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২: গ্যালারিতে কাঁটাতার নেই, আছে বন্ধনের ‘হাতকড়া’

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১: চাকরি নেই, রোনাল্ডো আছে