স্বাধীন ভারতে ভূমিহীন শ্রমিকদের সঙ্গে বহু বহু যুগ আগে বুড়ি কাজের খোঁজে এই নদীর পারে এসে বাসা বেঁধেছিল। তার মনে মজুতদারদের প্রতি বিদ্বেষ জন্মানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। বেচারি কাঠবেড়ালিটি সে যাত্রায় প্রাণে বাঁচলেও শীতের শুরুতে বুড়ির নজর এড়িয়ে পরিযায়ী পাখিদের ডেরা ভেঙে খুব বেশি জমাতে পেরেছিল মনে হয় না। বুড়িকে সেদিন আমরা পাঁজাকোলা করে নামিয়ে নিয়ে আসি। মইটা মনোহরের সাইকেলে বেঁধে ইলেকট্রিক অফিসের হিসেবরক্ষক মদন তিরকির বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, এবং বুড়ি ফের অমন লক্ষ্মীবাই মার্কা আচরণ করলে ঘরে তালা-চাবি মেরে রাখা হবে ইত্যাদি থ্রেটনিং দিয়ে যাদবজি ঘরে ফেরেন।
১৫.
এয়ারপোর্ট মোড়ে বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটার গা ঘেঁষে ঢাল গড়িয়ে নদী-পানে নেমে যাওয়ার দু’ধারে দোতলা সমান উঁচু ফণীমনসার ঝোঁপে একদিন এমনি কিচিরমিচির যে, কান পাতা দায়! পুজোর ছুটি ফুরিয়ে এল বলে। গাঢ় নীল পাহাড় অবধি গোটা ঢেউ খেলানো সমতল জুড়ে দু’-এক পশলা বৃষ্টির পর শীর্ণ নদীগুলো হঠাৎ আবার ফুলেফেঁপে উঠেছে। স্বর্ণাভ বাদামি ছোপ ধরা দিগন্ত জুড়ে ফের সবজেটে পোঁচ। এই খেলা চলবে বেশ কিছুদিন। তারপর আবার গুরবক্স সিং-এর গ্যারেজের দোতালায় বসে আচার পাহারা দেওয়া পাঞ্জাবি মেয়েগুলোর বিন্দু বিন্দু ঘামে ভেজা চিবুকের মতো পাকা গমের রং ধরবে এলিফান্টা ঘাসের জঙ্গলে, এ-ওর গায়ে নুয়ে পড়বে, রসিক বাতাস আলতো স্বরে কে জানে কী বলে গেলে। তাতে কী! শুকনো পাতায় ঢাকা নদীর চরের ওপর হাঁটা যে কী কঠিন এবং শ্রমসাধ্য কাজ, সে বিষয়ে মনোহরের বিলাপ ক্ষুদ্র বিস্কুট কারখানার নানাবিধ আওয়াজ ছাপিয়ে সারাদিনে বার দশেক কানে আসবে– সঙ্গে রামগোপাল যাদবের খুব নোংরা ভাষায় গালাগাল-সহ ‘না পোষালে ফুটে গেলেই তো পারিস, শালা অশিক্ষিত খোট্টার বাচ্চা।’
যাদবজি নালন্দা স্কুলের গোড়ার দিককার ছাত্র, এবং শিলিগুড়ি কলেজে কয়েক বছর হাড়ভাঙা মেহনতের পর ইদানীং পাকা ব্যবসায়ী। সমস্ত অবাঙালিকে ‘খোট্টা’ বলে গালাগাল দিতে কোনও বিহারিকে সেই প্রথম শুনি– সপ্রাণ নিষ্প্রাণ সমস্ত বস্তু এবং অবস্তুর যৌন অভ্যাসের সঙ্গে জনা পাঁচেক কর্মচারীর চোদ্দো পুরুষের, এবং বাছা বাছা মহিলা আত্মীয়দের দৈহিক মিলনের নানাপ্রকার অসম্ভব চিত্রকল্প নির্মাণেও ওঁর বুৎপত্তি ছিল হাড়হিম করা। টিরানোসোরাসের সঙ্গে যে কারও বোনকে বিছানায় তুলে ছোট ছোট কুকুরের বাচ্চা পয়দা করিয়ে দেওয়া যাদবজির ফোঁটা তিলক কেটে স্নান সেরে ফেরার পথে গামছা নিংরানোর চাইতেও কম মেহনতের কাজ! একটানা ‘হরি ওম হরি ওম হরি ওম’ আওড়ানোর ফাঁকে ময়দা, চিনি, ভাঙা কেকের প্রায় ফসকে যাওয়া সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসেব দেওয়া-নেওয়ায় যেমন সিলি পয়েন্টে সোলকারের ক্ষিপ্রতাকে হার মানাতেন, তেমনই কার ঘাড় ধরে গলায় গামছা দিয়ে পাউরুটির গাড়ি আটকে বকেয়া আদায় অবশ্য কর্তব্য– সে নির্দেশও চলত একবারের তরেও না হাঁপিয়েই। দমের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল অকল্পনীয়– দিওয়ারের অমিতাভের কায়দায় দাঁতে বিড়ি চেপে, টুক করে এদিক-ওদিক চেয়ে মনোহর বলেছিল, ‘রেওয়াজি ফেবরা, বেশক!’
পড়ুন ভয়বাংলা-র আগের পর্ব: কৈশোরে জাতের খোঁজ কেউ কখনও নিয়েছে বলে মনে পড়ে না
সে প্রত্যুষে যাদবজিও চুপ। এমন ঘটনা খুব বেশি ঘটেনি আমাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে। নদীর অপর প্রান্তে ফাঁকা জমিতে ফুটবল খেলে ফেরার পথে ওঁকে ডানহাতে পুজোর ঘট, ধূপকাঠির ‘পাকিট আউর ই শালা চুতিয়া মাচিস’, বাঁহাতে কাচা জামাকাপড়, সাবানের কেস, পেতলের বালতি, এবং, আরেক হাতে দোতলায় পাইপ বেয়ে ওঠার চাইতেও শক্ত মুঠিতে মনোহরের কবজি পাকড়ে বিস্ফারিত নয়নে পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনেকেই প্রথমে ভেবেছিল একছুটে বাড়ির সদস্যদের ডেকে আনবে। কিছু ঘটনা এমনই, যেগুলো কৌম অভিজ্ঞতার অংশ হিসেবে যতখানি আরামের, একা ততখানি নয়। গুষ্টিসুখের প্লেজারই অর্জি-নাল সিন! সে যাক! আমরা যাদবজিকে প্রস্তরখণ্ডে পরিণত করা বিষয়টির দিকে চোখ ফেরাতে বিস্ময়ের কারণটি নজরে এল। ফণীমনসা গাছের হেলে পড়া মোটকা কাণ্ড বরাবর মাটি থেকে সাড়ে তিন-চার হাত উঁচুতে জিতু-মিতুর ঠাকমাবুড়ি একটা ল্যাগব্যাগে মইয়ে প্রিকারিয়াসলি ব্যালান্সড্ পজিশনে বাঁহাতে বেশ খানিকটা খড়, কাঠি, ছেঁড়া ন্যাতা পাকড়ে ডান হাতে পেল্লাই এক তরোয়াল বাগিয়ে অতি ক্ষুদ্র এক কাঠবেড়ালিকে একনাগাড়ে থ্রেটনিং দিয়ে চলেছে– ‘ফির আয়ি তো কাট ডালুঙ্গি কসমসে!’ বুড়ির হাত থেকে টানা কাঠি, খড় এবং ছেঁড়া তোশক, বালিশ, গদির সুতো, ইত্যাদি বাসা বানানোর সামগ্রী নিয়ে ডানা ঝাপটে চলেছে শ’খানেক নানা মাপের, নানা প্রজাতির পাখি– তারা উড়ে আসে, তারপর ঠোঁটে করে কাঠি সুতো নিয়ে ফের ঢুকে পড়ে ফণীমনসার দুর্ভেদ্য কলোনির ভিতরে। মাটিতে একটা বড় সরায় ধান, গম, ছোলা এবং ঘাসবীজের ব্রেকফাস্ট দেখলাম রেডি। ব্যবস্থাটিতে সকলেই অভ্যস্ত বুঝতে অসুবিধে হল না। কাঠবেড়ালিটি দেখলাম একেবারে ননচ্যালান্ট মুখে নানা অ্যাঙ্গেলে ঘাড় নেড়ে চারপাশ দেখছে– তবে এক চুল নড়ছে না নিজের অবস্থান ছেড়ে। মনে হল, অতবড় একখানা তরোয়ালের আস্ফালন যে গোটা ঘটনাটিকে আদতে রিডিকুলাসের পর্যায়ে নামিয়েছে, সে বিষয়টি সম্পর্কে সে ওয়াকিবহাল, বা এমনটাই হয়তো হয়ে আসছে রোজ।
পড়ুন ভয়বাংলা-র অন্য পর্ব: নবনাৎসিগুলোর কাছে আর একটু সফিস্টিকেশন এক্সপেক্ট করেছিলাম মশাই
জিতু-নিতু বলল আন্দাজের পরবর্তী অংশটাই ঠিক। কাঠবেড়ালিটির নাম রামপিয়ারি, এবং বুড়ির পোষা রডেন্ট। রাতে ওদের বাপের কোলে বসে দুধ-রুটি খান এবং রান্নাঘরে কোনও কৌটো খোলার আওয়াজ পেলে যেখানেই থাকুন না কেন ন্যাজ তুলে ছুটে আসা চাই। তারপর কৌটোয় তার খাওয়ার মতো কিছু আছে কি না, তাও দেখা চাই। থাকলে নেওয়াও চাই। সে সবই খায় কেবল বাতাসা দিয়ে দেখা গেছে ওইটিতে তার বড়ই অরুচি। আজকাল হপ্তাখানেক সে বুড়ির থ্রেটও খাচ্ছে, কারণ প্রথমতো বুড়ির পাগলামো বাড়ছে মাত্রাতিরিক্ত বলে বাড়ির সকলেই কাঁটা হয়ে আছে, এবং সে শীতের আগে পাখিদের বাসা বানানোর সমস্ত মাল সকলের চোখের সামনে থেকে নিমেষে হাপিস করতে শিখেছে। চুপ করে বসে লক্ষ করে পাখিগুলো কোন ফোকরে ঢোকে, তারপর সুযোগ বুঝে তুলো, ছেঁড়া ন্যাকড়া, সুতোর বান্ডিল নিয়ে পগারপার। এদিকে শিরিষ গাছে তার নিজের কোটোরখানার এমনি হাল যে সরকারি গোটাউন হার মেনে যাবে– নেতাকানি অর্ধেকই বাইরে ঝুলছে।
স্বাধীন ভারতে ভূমিহীন শ্রমিকদের সঙ্গে বহু বহু যুগ আগে বুড়ি কাজের খোঁজে এই নদীর পারে এসে বাসা বেঁধেছিল। তার মনে মজুতদারদের প্রতি বিদ্বেষ জন্মানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। বেচারি কাঠবেড়ালিটি সে যাত্রায় প্রাণে বাঁচলেও শীতের শুরুতে বুড়ির নজর এড়িয়ে পরিযায়ী পাখিদের ডেরা ভেঙে খুব বেশি জমাতে পেরেছিল মনে হয় না। বুড়িকে সেদিন আমরা পাঁজাকোলা করে নামিয়ে নিয়ে আসি। মইটা মনোহরের সাইকেলে বেঁধে ইলেকট্রিক অফিসের হিসেবরক্ষক মদন তিরকির বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, এবং বুড়ি ফের অমন লক্ষ্মীবাই মার্কা আচরণ করলে ঘরে তালা-চাবি মেরে রাখা হবে ইত্যাদি থ্রেটনিং দিয়ে যাদবজি ঘরে ফেরেন। অমন একটা তরোয়াল পেলে আগামী পুজোয় ‘মিথ্যাবাদী মিরজাফর’ নামিয়ে একেবারে তাক লাগিয়ে দেব– ইত্যাদি হল্লা করতে করতে আমরাও প্রত্যেকে যে যার বাড়ি ফিরেছিলাম।
জিতু-নিতুর বাবা তরোয়ালটা ভেঙে কুয়োয় ফেলে দিয়েছেন শুনে ভটচাজ কাকু বলেছিলেন, ‘যাক, শান্তি।’ কীসের এবং কেন শান্তি– সে তখন বুঝিনি– কাটাকাটি তো আর হত না রে বাবা! আমাদের ছোট্ট জনপদটিতে এই শব্দটি সকলেই দিনের কোনও না কোনও সময়ে একবার অন্তত আউড়ে নিত। যাদবজি সন্ধে নামার আগে দোকানের সামনে বিস্তীর্ণ উঠোনে পাতা খাটিয়ায় বসে শান্তি নাম ধরে হাঁক মারতেন– সেটি অবশ্য অন্য গল্প। তবু, অফিস-বাজার-বাড়ি, অথবা স্কুল-বাড়ি-খেলার মাঠ, বা আরও কিছুকাল পরে পাহাড়ের এদিকটা ভারত এবং ওদিকটা চিন ইত্যাদি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিসরগুলিকে এরকম কিছু শব্দের গভীরে আপাদমস্তক ঢাকা পড়ে যেতে দেখলাম। আজীবন সে খোলসের ভিতরে থাকার বন্দোবস্তও ছিল পাকা।