বড় বড় প্রকাশনী সংস্থার স্টলের সামনে দেখেছ, কী লম্বা লাইন। আরও ছোট ছোট স্টলগুলোয় দেখো, পা ফেলার জায়গা পাবে না। শুধু কি নামী লেখকের বই বিকোচ্ছে। কত নতুন লেখক বেস্টসেলার হয়ে উঠছে। কে বলেছে, বাঙালির বই পড়ায় ভাটা পড়েছে। ও সব মেকি বচন। বলে বাজার গরম করা যায়। নিজেকে হামবড়া গোছের প্রমাণ করা যায়। আসলে বইয়ের সঙ্গে পাঠকের যোগটা আন্তরিক। কোনও উপপাদ্য দিয়েই সেটা ভুল প্রমাণ করা যায় না।
সন্ধে গড়িয়ে রাত। বইমেলা ভাঙা হাট। জনস্রোত তখন বাদুড়ঝোলা বাসে বাড়িমুখো। সেই মরা গাঙে একটু ফুরসত পেয়ে আকাশপাতাল ভাবছিলাম। অদূরে এক নামজাদা প্রকাশনীর স্টল। সদ্য প্রবেশদ্বারে তালা পড়ল। প্রস্থান দরজায় তালা পড়েনি, কারণ ভিতরে তখনও জনাকয়েক বইসন্ধানী মাথা– ফেরার তাগাদার মধ্যেই মেটাতে চাইছে মনের তৃষ্ণা, একটা বই– কোনও নামী কিংবা অনামী লেখকের। কিনতে পারলেই যেন আলিবাবার রত্নভাণ্ডার উদ্ধার করা যাবে, গ্রন্থব্যাকুলদের চোখেমুখে তেমনই অভিপ্রায়। এসব সাত-পাঁচ ভাবনার মধ্যেই দেখছিলাম নিজের অতিকায় ছায়াটিকে। ছায়ামানবের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আনমনে ভাবছিলাম, আমি যদি নামজাদা লেখক হতাম, তবে সইশিকারিদের ঢল নামত কি না? এসব বেখেয়ালি ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ একটা ক্ষুদ্র শব্দ হল, ‘ম্যাও’!
সচকিতে চারদিকে ঘাড় নাড়ালাম, লক্ষবস্তু চোখে পড়ল না। হঠাৎ মনে হল, আমার লেখকসত্তা কি আচমকা ‘ম্যাও’ করে ডেকে উঠল? নিন্দুকরা প্রস্থে এবং দৈর্ঘ্যে আমার লেখনীর গুণাগুণ বিচার করুন ক্ষতি নেই, এ ব্যাপারে আমি নির্লিপ্ত সন্ন্যাসীসম। নিন্দা হোক কিংবা প্রশংসা গায়ে মাখি না। কিন্তু তাই বলে অন্তরাত্মা ‘ম্যাও’ করে ডেকে উঠবে, এমন ভাবসমাধি কালে! এ কি মেনে নেওয়া যায়? ভাবতেই মনটা কেমন তেলেভাজার ঠোঙার মতো চুপসে গেল। ‘মন তোমার এই ভ্রম গেল না’ বলে নিজেকে প্রবোধ দিতে যাব, আবার জোড়াকানে একসঙ্গে শুনলাম– ‘ম্যাও’!
বুঝলাম, ভ্রম নয়, এ নিখাদ বাস্তব। পকেট থেকে রুমাল বার চশমা মুছলাম। ভালো করে নজর ফেলতেই দেখলাম যে, অন্তরাত্মা নয়, একটি লোমশ চতুষ্পদ, ল্যাজবিশিষ্টি বিড়াল। নিজেকে যখন নামী লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠাদানে মানসকল্পনায় ব্যস্ত ছিলাম এবং সই বিলোনোর স্বপ্ন বুনছিলাম, সেই ব্রাহ্মমুহূর্তে মার্জারসুন্দরী প্রকট হয়েছেন, খেয়াল করিনি। বইমেলার এমন ভাঙা-হাটে এক সজ্জন ব্যক্তি ফ্যালফ্যাল করে একটি বই বিপণি-স্টলের দিকে তাকিয়ে কি আকাশকুসুম রচনা করছে, হয়তো তা জানার অভিপ্রায়ে কয়েকবার জনৈক বিড়ালের ‘ম্যাও’ সম্ভাষণ, কিন্তু আমার আনমনা মন তা ধরতে পারেনি। এহেন উপেক্ষায় কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়েই স্থানত্যাগে উদ্ধত মার্জারসুন্দরী। আমি তার পথরোধ করে ভ্রুপল্লব নাচাই, ইঙ্গিতে জানতে চাই– ‘কী ব্যাপার, এ তো বইমেলা, মাছের বাজার নয়। তাহলে এই অসময়ে ভুল স্থানে আপনি কী করছেন!’
আমার ভ্রু-নৃত্যে কোনও অশালীন ইঙ্গিত ছিল না। তা সত্ত্বেও বিড়াল-মহীয়সী যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়ে বলে, ‘ম্যাও’! বুঝলাম, সওয়াল-জবাব আসন্ন। বিড়াল আবার দন্তবিকশিত করে বলল– ‘ম্যাও’! ততক্ষণে দিব্যকর্ণ লাভ করেছি। ‘ম্যাও’-এর অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে সমস্যা হল না। বুঝলাম, বিড়াল বলছে, ‘মাছের বাজারে বিকিকিনি কি বিড়াল আর মাছের মধ্যে হয়? মনুষ্যকুল কি সেখানে বৈষ্ণব কবি সেজে উপস্থিত থাকেন?’ কঠিন প্রশ্ন। বুঝলাম, শুরুতেই ভুল চাল দিয়ে ফেলেছি। এবার ঘর সামলানোর পালা। নয়তো চেকমেট। বললাম, তা, নয়। মাছেরবাজার মানুষের উদরপূর্তির বিশেষ উপায়। সেখানে মানুষের প্রয়োজন গুরুতর, বিড়ালেরটা গৌণ। পাল্টা প্রশ্ন ধেয়ে এল, ‘মাছের বাজারে যদি মানুষের অবাধ যাতায়াত থাকতে পারে, তাহলে বইমেলায় বিড়াল এলে গাত্রজ্বালা কেন?’ ইষ্টনাম জপ করতে করতে ভাবছিলাম, ‘রক্কে করো রঘুবীর, এ যাত্রায় মান বাঁচাও।’ আরও গুটিয়ে গিয়ে বললাম, ‘তা নয়।
বইমেলা হল বাঙালির বারো মাসে চোদ্দ পার্বণ। সারা বছরের প্রতীক্ষার ফল। মানুষের পায়ের ধুলো আর মনের খোরাক মেটে এই তীর্থে এসে। সেখানে বিড়াল-সমাজের কী পুণ্য? তাই আপনার আগমনে চমকে গিয়েছিলাম, একটু।’ হাতের নরম থাবায় একবার জিভ বুলিয়েই মার্জার-সুন্দরী এবার ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘বাঙালি বাঙালি করে আর গর্ব করো না। তোমরা হলে গিয়ে মেয়োনিজ কাঁকড়া। স্বজাতির পায়ে মরণকামড় দাও রসিয়ে রসিয়ে।’
বইমেলা আমার সৃষ্টি নয়, বঙ্গসমাজে মাছবাজার আমার অনুপ্রেরণায় তৈরি হয়েছে, এটাও বুক ঠুকে বলতে পারব না। কিন্তু বাঙালি হিসেবে আালাদা গর্ব রয়েছে। সে যতই ওপার বাংলায় বাঙালিরা নিজেদের নাক নিজেরা কাটুক। ফলে মনুষ্য-বিজাতীয় এক বিড়াল বইমেলায় বসে আমায় জাত তুলে গাল পাড়বে, আর সেটা মুখ বুঝে মেনে নেব, এমন কাপুরুষ আমি নই। হাতের পাশে ঢেলা-ইট খুঁজছিলাম, যথোচিত জবাব দিতে। সে-সব দেখে বিড়াল একটু সরে বসে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল– ‘ম্যাও’! মর্মার্থ এই– ‘জ্বললে পরে বার্নল লাগাও, কিন্তু মাথা খাটিয়ে দেখো, ভুল কি কিছু বলেছি? তোমরা কাঁকড়ার জাত নও? নিজেদের মঙ্গলের বদলে সর্বদা সর্বনাশ করতে সিদ্ধহস্ত। বইমেলা শুরু হয়ে শেষ হতে চলল। অথচ শুরু থেকে ধামসা-মাদল বাজিয়ে গেয়ে চলেছ, বাঙালি এখন বইবিমুখ। বইটই পড়ে না। সবটাই শো-অফ। বইমেলায় ভিড় জমায় রিলে রিলে গ্রাম ভরিয়ে দেবে বলে। টিপ্পনি সেটাও কি কম করো? তোমাদের মতো গর্বিত বাঙালিই তো বলে, বইমেলা না খাদ্যমেলা– তা ধরতে পারবেন না! এ কথা শুনে তোমাদের কান পচে না? আয়নায় মুখ দেখো?’
শীতকাল অপগত। কিন্তু ভরা-বসন্তে এমন ত্রাহ্যস্পর্শ সহ্য করতে হবে, কল্পনায় ছিল না। মার্জার-সুন্দরী তখনও অনর্গল, ‘অথচ দেখো বইমেলায় যেন মানুষের ঢল নেমেছে। বড় বড় প্রকাশনী সংস্থার স্টলের সামনে দেখেছ, কী লম্বা লাইন। আরও ছোট ছোট স্টলগুলোয় দেখো, পা ফেলার জায়গা পাবে না। শুধু কি নামী লেখকের বই বিকোচ্ছে। কত নতুন লেখক বেস্টসেলার হয়ে উঠছে। কে বলেছে, বাঙালির বই পড়ায় ভাটা পড়েছে। ও সব মেকি বচন। বলে বাজার গরম করা যায়। নিজেকে হামবড়া গোছের প্রমাণ করা যায়। আসলে বইয়ের সঙ্গে পাঠকের যোগটা আন্তরিক। কোনও উপপাদ্য দিয়েই সেটা ভুল প্রমাণ করা যায় না।’ বিড়ালের যুক্তির ধারে তখন শুধু দিব্যকর্ণ নয়, দিব্যচক্ষুও আমার খুলে গিয়েছে। সাশ্রুনেত্রে ভাবছি, সত্যি তো। পাঠকের সঙ্গে বইয়ের যোগ তো আজকের নয়। বাঙালির বইপ্রীতিও সুবিদিত। গোটা দেশে সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারক-বাহক রূপে তার আলাদা মানমর্যাদা রয়েছে। অথচ তার মাঝেই আমরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই। অহরহ ‘গেল… গেল…’ আর্তনাদ করি। অতীতের ঘিয়ের গন্ধ শুকতে বসে এদিকে পাতের ভাত ঠান্ডা হয়ে যায়। বাঙালি বই পড়ে না, কেনে না– এসব গা-উজানো গুজবে ভেসে যাই। কিন্তু বইমেলা বারবার বুঝিয়ে দেয় এবং দিচ্ছে, বই আর বাঙালি ঠিক যেন দ্রাবিড় আর ধৈর্য। একে অপরের সঙ্গে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আছে। জনস্রোতের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। বইয়ের পাহাড় নিয়ে ‘বইপোকা’রা ফিরছে। তাদের মুখে তৃপ্তির হাসি। সাধারণের এই সাধ্যসাধনা সে তো ছলনা হতে পারে না!
আমায় ভাবুক হতে দেখে মার্জার-সুন্দরীরও মন বোধহয় নরম হল। গাত্রোত্থান করে অন্যত্র যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই চোখ মুছে জিজ্ঞাসা করলাম– ‘এত কথা হল, আপনার পরিচয় তো জানা হল না?’ ঈষৎ এগিয়ে গিয়ে আড়মোড়া ভেঙে বিড়াল-মহীয়সী বলল– ‘তুমি আমায় ঠিক চিনবে না, পারলে কমলাকান্তকে জিজ্ঞেস করো, তিনি চিনিয়ে দেবেন।’
অবাক হয়ে মার্জার-সুন্দরী প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, হঠাৎ চোখ পড়ল এক স্টলের ব্যানারে, সেখানে লেখা: ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।’ এই না-হলে বাঙালি! শুধু মনে একটা প্রশ্ন, বারেবারে আঘাত করে যায়: প্রতিবারই গত বছরের তুলনায় বেশি টাকার বই বিক্রির কারণ কি বইয়ের দাম না পাঠকের সংখ্যা?
…………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ১৫: সেন ‘মায়েস্ত্রো’কে ভুলে বাঙালি দেখিয়েছে, সে আজও আত্মবিস্মৃত
পর্ব ১৪: শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসই বাঙালির প্রকৃত সান্তা
পর্ব ১৩: প্রবাসে, দোতলা বাসে, কলকাতা ফিরে আসে
পর্ব ১২: না-দেখা সেই একটি শিশিরবিন্দু
পর্ব ১১: ঘোর শত্রুর বিদায়বেলায় এভাবে বলতে আছে রজার ফেডেরার?
পর্ব ১০: অভিধানের যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি মনুষ্যরূপ ধারণ করেছে
পর্ব ৯: জোট-অঙ্কে ভোট-রঙ্গ
পর্ব ৮: দক্ষিণ বিসর্জন জানে, উত্তর জানে বিসর্জন শেষের আগমনী
পর্ব ৭: পুজো এলেই ‘সর্বজনীন’ নতুবা নিঃসঙ্গ?
পর্ব ৬: এক্সক্লুসিভের খোয়াব, এক্সক্লুসিভের রোয়াব
পর্ব ৫: শাসন-সোহাগের দ্বন্দ্বসমাস
পর্ব ৪: পাঁকাল সাধনায় নাকাল
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
পর্ব ২: মহাবিশ্বে যে টোকে না, সে বোধহয় টেকেও না
পর্ব ১: অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে