কলকাতায় যেমন পাড়ার মোড়ে চাউমিনের দোকান– এগ, চিকেন, ভেজ সবরকম চাউমিন পাওয়া যায়। ঢাকায় তেমনই অসংখ্য খিচুড়ির দোকান– নিরামিষ খিচুড়ি থেকে গরুর ভুনার খিচুড়ি সবই পাওয়া যায়; তফাত একটাই, কলকাতার রোলের দোকানগুলো সন্ধেতে খোলে, ঢাকার খিচুড়ির দোকানগুলো সারাদিন খোলা থাকে।
১৭.
খিচুড়ি নাকি বর্ষার খাবার। আকাশ কালো হয়ে অঝোরে বৃষ্টি নামলে সেটা নাকি খিচুড়ি খাওয়ার দিন। যদি তাই হয়, তাহলে দুর্গা পুজো, লক্ষ্মী পুজো আর সরস্বতী পুজোয় খিচুড়ি হয় কেন? কেনই বা খুব শীতের দিনে ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি খেয়ে লেপের তলায় সেঁধিয়ে যাওয়াকে পৃথিবীর অন্যতম সেরা সুখ বলে মনে হয়? কলকাতায় যেমন পাড়ার মোড়ে চাউমিনের দোকান– এগ, চিকেন, ভেজ সবরকম চাউমিন পাওয়া যায়। ঢাকায় তেমনই অসংখ্য খিচুড়ির দোকান– নিরামিষ খিচুড়ি থেকে গরুর ভুনার খিচুড়ি সবই পাওয়া যায়; তফাত একটাই, কলকাতার রোলের দোকানগুলো সন্ধেতে খোলে, ঢাকার খিচুড়ির দোকানগুলো সারাদিন খোলা থাকে। আসলে খিচুড়ি এক নির্ঝঞ্ঝাট খাবার, যা বানাতে বেশি ঝক্কি সামলাতে হয় না, যার সঙ্গে ল্যাদের এক অবৈধ সম্পর্ক আছে।
খিচুড়ির ইতিহাস খুঁজে সময় নষ্ট করার মানে হয় না, সিন্ধু বা মেসোপটেমীয় সভ্যতার কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে হয়তো এঁটো খিচুড়ি লেগে আছে। বরং খিচুড়ির বিভিন্ন রকমফেরের দিকে তাকানো যাক। তামিল মুসলমানরা যে ‘নম্বু-কাঞ্জি’ খেয়ে রমজান মাসের উপবাস ভঙ্গ করে, সেটা আদপে খিচুড়ি– তফাত এটা চাল আর ডালের সঙ্গে নারকোলের দুধ দিয়ে রান্না হয়। মজার ব্যাপারটা হচ্ছে, এই রোজা ভাঙার খাবারের উৎস হচ্ছে আদি পেরুক্কু নামে এক প্রাচীন হিন্দু পার্বণ, যা আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে বৃষ্টির দেবী আম্মানের উদ্দেশ্যে পালন করা হত বাজরা দিয়ে পায়েস বানিয়ে। কর্ণাটকের বিসি-বেলে-বাতকে যতই লোকে প্রাচীন কন্নড় কাট্টোগারা নামের এক ঝোল-ভাতের পদের সঙ্গে সাযুজ্য খুঁজে পাক, এই পদের উৎপত্তি রাজপ্রাসাদের বাইরে হতেই পারে না, খিচুড়িতে কাজুবাদাম আর দারচিনির আধিক্য সেই কথাই বলে।
যে কেডগেরিকে ইংল্যান্ডে সকালের জলখাবারের টেবিলে দেখা যায়, সেটা আদপে আমাদের দেশের খিচুড়ি। ব্রিটিশ অফিসারদের হাত ধরে এদেশের অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের রান্না করা খিচুড়ি যা ভিক্টোরীয় যুগে ইংল্যান্ডে পৌঁছেছিল। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা আগের রাতের খাবারে বেঁচে থাকা ভাত আর ডাল ফেলে না দিয়ে নতুন করে রান্না করে সুস্বাদু করে তুলত– স্বাদ বাড়াতে মাছ আর ডিম দিত তাতে। সেই খিচুড়িকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা নিজেদের উচ্চারণের সুবিধের জন্য ‘কেডগেরি’ বলত, যা আজকের ইংল্যান্ড বলে থাকে। চাল, ডাল, ম্যাকরনি দিয়ে রান্না মিশরের জাতীয় খাবার ‘কোশ্রি’ আদপে যে আমাদের খিচুড়ি, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতীয় সৈনিকদের হাত ধরে মিশরে প্রবেশ করেছিল, বাঙালি নোবেলজয়ী অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জির লেখায় পড়েছিলাম।
এবার একটু মধ্যযুগের ভারতবর্ষের দিকে তাকানো যাক। হুমায়ূন বাদশা শের শাহ্র কাছে তাড়া খেয়ে ভারতবর্ষ থেকে পালিয়ে যখন পারস্যে পৌঁছন, সেখানকার শাহকে নেমন্তন্ন করে ভারতীয় খিচুড়ি খাইয়ে তাঁকে হাত করেছিলেন, যাতে সেখান থেকেও উৎখাত না হতে হয়। হুমায়ূনের প্রচেষ্টা বিফল হয়নি, খিচুড়িতে বোল্ড আউট শাহ হুমায়ূনকে পারস্যে আশ্রয় দেওয়া মনস্থ করেন। সিংহাসন পুনরুদ্ধার করার পরে যে খিচুড়ির প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ বজায় ছিল, সেটা বোঝা যায় আকবরের জমানায় আবুল ফজলের লেখা ‘আইন-ই-আকবরি’তে সাতরকম খিচুড়ির রেসিপি লেখা দেখে। আকবর-বীরবলের গপ্পে অবধি আছে যে, বীরবল কীভাবে খিচুড়ি রান্নার মাধ্যমে আকবরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। মোঘল বাদশাদের খিচুড়ি-প্রীতি পুরুষানুক্রমে চলেছিল। গুজরাতে স্থানীয় ভুট্টার খিচুড়ি খেয়ে জাহাঙ্গির তৎক্ষণাৎ তাকে মোঘলাই হেঁশেলে স্থান দেন। আর শাহ্জাহান পর্তুগিজ পর্যটক সেবাস্তিয়ান মান্রিখকে যে পেস্তা-বাদাম আর গরম মশলা দেওয়া খিচুড়ি খাইয়েছিলেন, সাহেবের তা খেয়ে ধারণা হয়েছিল তিনি মণি-মাণিক্যের খিচুড়ি খাচ্ছেন।
খিচুড়ি নিয়ে অনেক গপ্প। সেইরকম একটা গপ্প দিয়ে আজকে শেষ করা যাক। যখন চিতোর থেকে মেওয়ারের রানা কুম্ভের কাছে উৎখাত হয়ে যোধপুরের প্রতিষ্ঠাতা রাও যোধা পালিয়ে বেরাচ্ছেন আর তাঁর চিতোর পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা বারবার বিফল হচ্ছে, তাঁর প্রচেষ্টা অবশেষে সফল হয়েছিল এক বাটি খিচুড়ির কল্যাণে। রাও যোধা নিজের সৈন্য-অশ্ব সব খুইয়ে নিজের পরিচয় লুকিয়ে পথে ঘুরতে ঘুরতে এক জাঠ চাষার বাড়িতে খাবার ভিক্ষা চান। সেখানে তাঁকে খিচুড়ি পরিবেশন করলে গরম খিচুড়িতে আঙুল ডুবিয়ে ক্ষুধার্ত যোধা তাঁর আঙুল পুড়িয়ে ফেলেন। চাষার বউ তখন যোধাকে বলে, ‘তুমি আমাদের রাজা রাও যোধার মতো ভুল করছ। খিচুড়ির মাঝখানটা সবচেয়ে গরম থাকে আর ধারগুলো ঠান্ডা। ধারগুলো থেকে খেতে শুরু করো।’ রাও যোধা এরপর আবার চিতোর পুনরুদ্ধারের চেষ্টা না করে অন্যান্য দুর্গ জয়ের দিকে মনোনিবেশ করেন। আর পনেরো বছর বাদে অবশেষে এক সময় নিজের রাজত্ব ফিরে পান।
আমাকে মাঝে মাঝে বম্বে ডাইং-এর ফ্যাক্টরিতে পাঠাতেন মিসেস ওয়াড়িয়া। তোয়ালে, বিছানা চাদর, বালিশের ওয়াড় এমনকী, লুঙ্গিরও ডিজাইন। শিল্পের এই বিচিত্র ব্যবহার ভুলব না। লোকে বলে, ফ্যাশন ধনীদের জন্য। আসলে সমস্ত কিছুই শেষ পর্যন্ত চাপানো হয় দরিদ্র শ্রেণি আর সাধারণ নাগরিকের ঘাড়ে।