নকুলদানার মতো মাইনে, দিন শেষে দশ পয়েন্টে এক চিলতে নাম। কখনও কখনও তা-ও এডিটরের ভুলে তার জায়গা হয় না। অন্যান্য ‘বিট’-এর ফোটোগ্রাফারদের কথা বলতে পারব না। কিন্তু ময়দানের ফোটোগ্রাফাররা রোজগার-সম্মানে ‘গ্রপ ডি’ স্টাফ মেরেকেটে। তার চেয়ে বেশি নয়, কিছুতেই নয়।
লোকটা আর নেই। চলে গিয়েছে। কোভিডে। চিরতরে। ছিল যদ্দিন, প্রথম দর্শনে নজরে পড়ত লোকটার উলোঝুলো গোঁফ। কাঁচাপাকা চুল। ইয়া এক ক্যামেরা। আর চোখে পড়ত হাসি। নির্মল এক হাসি। ঝরঝরে এক হাসি।
মার্চ এলে লোকটাকে বড় মনে পড়ে। আচ্ছা, বছর পাঁচেক আগের এক দুঃখী মার্চেই লোকটা প্রথম অসুস্থ হয়ে পড়েছিল না? রাজকোটে? বাংলা বনাম সৌরাষ্ট্র রনজি ট্রফি ফাইনাল ‘কভার’ করতে গিয়ে? কী জানি, ভুল হতে পারি। ঠিক হতে পারি। সময় আজকাল খুব সরে-সরে যায়। সন-তারিখ অবাধ্যতা করে। কিন্তু এটুকু মনে আছে, গায়ে জ্বর নিয়ে রাজকোট থেকে ফিরেছিল লোকটা। গোঁয়ার্তুমি করে ডাক্তারের কাছেও যায়নি। দেশে তখন সবে কোভিড আসছে। মাস্ক-স্যানিটাইজার-পালস অক্সিমিটার ক্রমশ প্রাত্যহিক রাহাখরচের একাংশ দাবি করছে। লোকটা শোনেনি। লোকটা মানেনি। লোকটা তাই চলেও গিয়েছিল।
লোকটার নাম রনি রায়। আমাদের রনিদা। আমার কাছে যাঁর শেষ স্মৃতি এক ঠোঙা পাঁউরুটি-কলা!
নাহ্, আমার সঙ্গে দারুণ সৌভ্রাতৃত্ব ছিল না ‘আজকাল’-এর রনিদার। মাঠে-ঘাটে দেখা হত। ঈষৎ মুচকি হাসি। মৃদু কুশল বিনিময়। ব্যস। যেমন হত ‘দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া’-র প্রদীপদা, ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এর সন্তোষদাদের সঙ্গে। যেমন আজও হয় রুবিদিদের (রুবি সরকার) সঙ্গে। কর্মজীবনে সবচেয়ে বেশি যে স্পোর্টস ফোটোগ্রাফারের সঙ্গে টহল দিয়েছি, তাঁর নাম উৎপল সরকার। ‘আনন্দবাজার’-এ ছিলেন। প্রকৃতার্থে ম্যানেজ-মাস্টার! একখানা ভাল ছবির জন্য অমুকের মাথায় হাত বুলোনো, তমুককে ‘পট্টি’ পরানো যে কী অবলীলায় করে চলতেন ভদ্রলোক, না দেখলে বিশ্বাস হয় না! ক্ষ্যাপাটে উল্কার মতো যাতায়াত ছিল। কখন অফিস আসতেন, কখন বেরিয়ে যেতেন ঠাওর পেতাম না। এই আছে, এই নেই! এ মুহূর্তে অফিসে, পরমুহূর্তে মাঠে! সময়-সময় ভাবতাম, এ মানুষ না অরণ্যদেব রে বাবা! আলোর গতিতে অমন ঘরে-বাইরে করতে রক্তমাংসের মনিষ্যি পারে নাকি? তখন শুনতাম, ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর (যা আমার বর্তমান কার্যগৃহ) স্পোর্টস ফোটোগ্রাফার সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে নাকি পেশাগত বিরোধ প্রবল উৎপলদার। ইনি এক হলে, উনি দুই। ইনি দুই হলে, উনি এক। জানি না সত্যিটা কী। তবে যা চর্মচক্ষে দেখতে পেতাম, তা হল উৎপলদার বুনো প্যাশন। হুটহাট বড়-বড় টুর্নামেন্ট কভার করতে চলে যাওয়া। অফিস টাকা দিলে ভাল। না দিলে আরও ভাল! শুনেছি, ফুটবল বিশ্বকাপের মতো এক মাসের টুর্নামেন্ট পর্যন্ত উৎপলদা করে এসেছেন নিজের ট্যাঁকের জোরে। অফিস নাকি টাকা ছোঁয়ায়নি!
ট্যাঁক! ট্যাঁকের জোর! ইদানীং মনে হয়, সাংবাদিকতায় আসতে গেলে পারিবারিক রেস্ত-র জোর থাকা খুব দরকার। কিংবা পেশার সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে কিছু একটা চালানো প্রয়োজন। না হলে যে পেট চলবে না! উৎপলদার একাধিক স্টুডিও ছিল, উৎপলদা তাই আজ বুরুলে বাড়ি বানিয়ে থাকতে পারছেন। দু’হাতে জোড়া ইলিশ নিয়ে ফেসবুকে ছবি দিতে পারছেন। শঙ্করদা পারছেন না। অর্থাৎ, শঙ্কর নাগ দাস। ‘আজকাল’, ‘আনন্দবাজার’, ‘সংবাদ প্রতিদিন’– তিন কাগজে যিনি কর্মজীবনে ঘুরে বেরিয়েছেন যাযাবরের মতো (যাঁর একমাত্র চাহিদা ছিল পদবিটা যাতে জুড়ে দেওয়া না হয়)। অমন উদয়াস্ত খাটতে, রোদ-ঝড়-জল অগ্রাহ্য করে বছরে পর বছর রাস্তা-ঘাট-মাঠকে ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলতে আমি আর কাউকে দেখিনি। কিন্তু চাকরির মেয়াদ ফুরনোর আগেই শঙ্করদার টাকা ফুরিয়ে গিয়েছিল। না, না, নেশাভাঙ কিংবা অন্য বদভ্যাস ছিল না ভদ্রলোকের। টাকা হয়নি। একটা জীবন পুরো খরচ করেও যা জমেনি। জানি না, শঙ্করদার আর্থিক অবস্থা এখন কেমন। জানি না, শঙ্করদার সন্তান জীবনে দাঁড়িয়ে গিয়েছে কি না? গেলে ভালো। ভদ্রলোক একটু শান্তি পাবেন।
এবং আমি নিশ্চিত, এ রকম সহস্র শঙ্করদা মাঠে-ময়দানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আজও। সহস্র নামে। ফুটো পকেটে। খেলার প্রতি একবুক ভালবাসা নিয়ে। সাংবাদিকরা হুইস্কি গ্লাস হাতে দুঃখ করে যে, পরিশ্রমের অনুপাতে তারা কিছুই অর্থ পায় না। হক কথা। ঠিক। আমার শৈশবের সমস্ত বন্ধুবান্ধবদের রোজগার আমার চেয়ে বেশি। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের চেয়ে আমার পরিচিতি বেশি। ছবিওয়ালাদের যে সেটুকুও নেই। নকুলদানার মতো মাইনে, দিন শেষে দশ পয়েন্টে এক চিলতে নাম। কখনও কখনও তা-ও এডিটরের ভুলে তার জায়গা হয় না। অন্যান্য ‘বিট’-এর ফোটোগ্রাফারদের কথা বলতে পারব না। কিন্তু ময়দানের ফোটোগ্রাফাররা রোজগার-সম্মানে ‘গ্রপ ডি’ স্টাফ মেরেকেটে। তার চেয়ে বেশি নয়, কিছুতেই নয়। ‘আ পিকচার ইজ ওয়ার্থ আ থাউজ্যান্ড ওয়ার্ডস’-এর গালভরা প্রবাদ ভেবে যারা নিজেদের প্রবোধ দেয়। প্রতিনিয়ত। ইদানীং মোবাইল ক্যামেরার অলুক্ষণে উৎপাতে হাঁড়িতে টান পড়ছে আরও। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সবাই সাংবাদিক, সবাই ফোটোগ্রাফার। কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং ছবি তুলে ফেসবুকে ছেড়ে দিলেই হল!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সাংবাদিকরা হুইস্কি গ্লাস হাতে দুঃখ করে যে, পরিশ্রমের অনুপাতে তারা কিছুই অর্থ পায় না। হক কথা। ঠিক। আমার শৈশবের সমস্ত বন্ধুবান্ধবদের রোজগার আমার চেয়ে বেশি। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের চেয়ে আমার পরিচিতি বেশি। ছবিওয়ালাদের যে সেটুকুও নেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অথচ এঁরা দিনভর প্রাণপাত করেন। দিন শেষে পরিবারের মুখে এঁদেরও অন্ন তুলে দিতে হয়। নির্দ্বিধায় লিখছি, আমাদেরই পিন্টুদা (‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর পিন্টু প্রধান, ফোটোগ্রাফার প্রজাতির অলরাউন্ডার) কিংবা অমিত মৌলিক এই পেশাকে যা সময় দেয়, যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে, তার সিকিভাগ আমি দিলে আরও উন্নতি করতে পারতাম। কী করা যাবে, উপায় যে নেই অমিতদের। সাংবাদিক স্পটে না গিয়েও খবর করে দিতে পারে। ফোন-টোন করে। কিন্তু অমিত, পিন্টুদাদের সেই সুবিধে নেই। ছবি মিস হলে অন্য কাগজের ফোটোগ্রাফারের দাক্ষিণ্যই ভরসা তখন। আর এঁদের অনেকের খবরের গন্ধ সাংবাদিকের চেয়ে ভালো। ‘আনন্দবাজার’-এর সুদীপ্ত ভৌমিককেই দেখেছি নিজের কাগজের রিপোর্টারকে খবর নিয়ে আগাম সতর্ক করে দিতে। ‘মামা’ আর একজন। বর্তমানে ‘রেভস্পোর্টস’-এ কর্মরত দেবাশিস সেন। নিত্য হিল্লি-দিল্লি-বিলেত করছে। এবং সব করছে! গ্রাউন্ড রিপোর্টিং। ভিডিও রেকর্ডিং। কাগজের জন্য স্টিল ছবি তোলা। বাদ রাখে না কিছু।
আশ্চর্যের হল, তারপরেও ফোটোগ্রাফাররা সাংবাদিকদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে না! সম-নাগরিকত্ব না পেয়েও! বরং অনুভব করে, সহমর্মিতা দেখায়। জীবনের প্রথম ক্রিকেট কভার করতে গিয়ে যখন সমস্যার আটলান্টিক মহাসাগরে পড়েছিলাম, আমায় উদ্ধার করেছিল ‘মামা’। হোটেল, হোটেলের রুম নম্বর খুঁজে বের করে।
কথায়-কথায় রনিদারটা লিখতেই ভুলে গেলাম। লেখার আদিভাগে যা লিখছিলাম, পাঁউরুটি-কলার গল্প।
রাজকোটে সকাল-সকাল বেরোতে হত। সকাল ন’টা-সাড়ে ন’টা থেকে শুরু হয়ে যেত রনজি ফাইনাল। প্রাতরাশের অবকাশ থাকত না বিশেষ। সে-দিনও বেরিয়েছিলাম তেমনই, কাঁধে ল্যাপটপ, পায়ে ব্যস্ততা নিয়ে। ঠিক অটো ধরার মুখে পাকড়াও করল রনিদা। একই হোটেলে ছিলাম আমরা দু’জন।
‘অ্যাই ছেলে, খেয়েছিস?’
‘না গো। সময় নেই।’
‘কাজ তুই একা করিস নাকি? এটা রাখ। অটোয় যেতে যেতে খেয়ে নিস।’
দেখি, একটা ঠোঙা। ঠোঙায় পাঁউরুটি-কলা। কিছুই নয় হয়তো। আবার অনেক কিছু। নিজের জন্যই নিয়ে যাচ্ছিল বোধহয় রনিদা। আমায় দেখতে পেয়ে ধরিয়ে দিয়েছে।
রুক্ষ রাজকোটে অভিভাবকত্বের মৃদুমন্দ ছোঁয়া পেয়ে সে দিন মন্দ লাগেনি। অটোয় বসে ঠোঙা হাতে মনেও হয়েছিল, রাত্তিরে রনিদার ঘরে যাব একবার। বসব এক পাত্তর নিয়ে। যাওয়া আর হয়নি। যাওয়া আর হবেও না। যেমন এঁদের অনেকের সঙ্গেই একটা সময়ের পর কখনও দেখা হবে না। কখনও কথা হবে না। আমি জানি, এঁরা তাতে কিছু মনেও করবেন না। কারণ, দিন শেষে একটা সারসত্য এঁরা জানেন।
ছবিওয়ালাদের কেউ মনে রাখেনি। ছবিওয়ালাদের কেউ মনে রাখে না। পায়ের চিহ্ন পড়লেও। না পড়লেও!
…পড়ুন খেলাইডোস্কোপ-এর অন্যান্য পর্ব…
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৮: যারা আমার মাঠের পরিবার
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৭: অহং-কে আমল না দেওয়া এক ‘গোল’ন্দাজ
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৬: যে দ্রোণাচার্যকে একলব্য আঙুল উপহার দেয়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৫: সাধারণের সরণিতে না হাঁটলে অসাধারণ হতে পারতেন না উৎপল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৪: মনোজ তিওয়ারি চিরকালের ‘রংবাজ’, জার্সির হাতা তুলে ঔদ্ধত্যের দাদাগিরিতে বিশ্বাসী
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৩: অনুষ্টুপ ছন্দ বুঝতে আমাদের বড় বেশি সময় লেগে গেল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১২: একটা লোক কেমন অনন্ত বিশ্বাস আর ভালোবাসায় পরিচর্যা করে চলেছেন বঙ্গ ক্রিকেটের
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১১: সম্বরণই বঙ্গ ক্রিকেটের বার্নার্ড শ, সম্বরণই ‘পরশুরাম’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১০: যাঁরা তৈরি করেন মাঠ, মাঠে খেলা হয় যাঁদের জন্য
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৯: খণ্ড-অখণ্ড ভারতবর্ষ মিলিয়েও ক্রিকেটকে সম্মান জানাতে ইডেনতুল্য কোনও গ্যালারি নেই
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৮: ২০২৩-এর আগে আর কোনও ক্রিকেট বিশ্বকাপ এমন ‘রাজনৈতিক’ ছিল না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৭: রোহিত শর্মার শৈশবের বাস্তুভিটে এখনও স্বপ্ন দেখা কমায়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৬: বাংলা অভিধানে ‘আবেগ’ শব্দটাকে বদলে স্বচ্ছন্দে ‘বাংলাদেশ’ করে দেওয়া যায়!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৫: ওভালের লাঞ্চরুমে জামাইআদর না থাকলে এদেশে এত অতিথি সৎকার কীসের!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৪: ইডেনের কাছে প্লেয়ার সত্য, ক্রিকেট সত্য, জগৎ মিথ্যা!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৩: এ বাংলায় ডার্বিই পলাশির মাঠ
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২: গ্যালারিতে কাঁটাতার নেই, আছে বন্ধনের ‘হাতকড়া’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১: চাকরি নেই, রোনাল্ডো আছে