ময়দানে বড়-বড় ক্লাবদের স্কোরার রাখার চল ছিল পূর্বে। নিজেদের রেকর্ড সংরক্ষণের অভিলাষে। কিন্তু স্কোরিং নিয়ে মাঝে গন্ডগোল বাঁধায় সে প্রথা তুলে দিয়েছে সিএবি। বেশ কয়েক বছর হল। এখন সব সিএবি নিযুক্ত স্কোরার। ক্লাবেরা আর ব্যক্তিগত স্কোরার রাখে না। তবে তাতে বদল বিশেষ আসেনি কিছু। থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোরের গড্ডালিকা প্রবাহ জীবন আছে তেমন, আগে ছিল যেমন।
২১.
ওরা থাকে ওধারে। প্লাস্টিকের চেয়ারে। খোপ-খোপ স্কোরবোর্ডের গায়ে। নিরলস। নির্বিকার।
ওরা নড়ে না। চড়ে না। দুপুরে ভাতঘুম দিলে ওদের চলে না। ওরা নিরুপায়। ওদের মাঠের দিকে চেয়ে থাকতে হয় ঠায়।
ওরা পায় না কিছু। আহামরি অর্থ। যশ। খ্যাতি। প্রচার। কিছু না, কিছুমাত্র না। বিলাস বলতে দুপুরে খেলার মাঠে বারোয়ারি ভাত-ডাল, ছুটকো পাখার হাওয়া।
তবু ওরা ছুটে আসে। দলে-দলে। জল-স্থল পেরিয়ে, বাস-ট্রাম-ট্রেনে। নিবাস কারও মেদিনীপুর। কারও বহরমপুর। কেউ থাকে সিউড়ি, কেউ বা বোলপুর। শ’য়ে-শ’য়ে ওরা ঢুকে পড়ে রোজ, এ শহরের কোলে-কাঁখে, শেষে সেঁধিয়ে যায় ময়দানে। মাঠে-ঘাটে। ঝুপ করে বসে পড়ে এককোণে। খাতা-কলম টেনে। খেলার মাঠে সংখ্যার খেলা খেলতে। তার সঙ্গে প্রেম করতে। সংখ্যা সেখানে যেন অভিমানী বড়লোক প্রেমিকা, আর ওরা তার ফুটো পকেটের প্রেমিক! অধিকার নেই জেনেও যাকে ওরা ছুঁতে চায়। গালভরা নাম আর ট্যাঁকখালির ইজ্জত নিয়ে।
স্কোরার, নাম ওদের স্কোরার।
আসলে সংখ্যা মাঝে-সাঝে তত্ত্ব বটে, তবে সব সময় কখনওই নয়। মনুষ্য প্রয়োজনে সে জীবিকা। যাপন। ভালোবাসা। বিশ্বাস না হলে বেরিয়ে পড়ুন একদিন, ঘুরে বেড়ান ময়দানে, কথা বলে দেখুন ওদের সঙ্গে। বল পিছু যারা সংখ্যা বদলে চলে, শুধু যাদের জীবন বদলায় না। পুরাকালে যা ছিল, আজও প্রায় তাই। পরিবর্তন নেই। পরিণাম নেই।
এই যেমন বাংলার বর্ষীয়ান স্কোরার গৌতম রায়। এক জীবনে ক্রিকেটকে সমর্পণ করেছেন যা, বিনিময়ে পাননি তেমন কিছু। ফোন করলে কী একখানা কার্ড নিয়ে নিত্য বলেন (মনেও থাকে না ছাই), সিএবি যা তাঁকে আজও দিয়ে উঠতে পারেনি। পেশা থেকে অর্থকড়িও বিশেষ পেয়েছেন বলে মনে হয় না। একা গৌতম নন। ময়দানে আজ যারা মাঠে-মাঠে স্কোর লেখার ‘ক্ষুন্নিবৃত্তি’ করে বেড়ান, বছরে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে জোটে এক লক্ষ। তা-ও সত্তর-আশিটা ম্যাচ করলে। ভারতীয় বোর্ড হালফিল অনেকটাই দেয় তার নিযুক্তদের, কিন্তু সে আশীর্বাদধন্য আর হয় কতজন?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
দৈনন্দিন দৈন্যদশা থেকে স্কোরারদের স্বীকৃতি দেওয়ার কাজ সর্বপ্রথম করেন প্রয়াত বোর্ড সচিব জয়বন্ত লেলে। নয়ের দশকের মধ্যভাগে। ভদ্রলোক অতি সজ্জন ছিলেন। যে দু’একবার দেখেছি, প্রত্যাশিত ঠাঁটবাটের ছোঁয়া পাইনি বিন্দুমাত্র। তা, লেলেই নাকি ঠিক করেন বোর্ড নিযুক্ত স্কোরার থাকবে মাঠে। অতীতে আম্পায়ারদেরই স্কোরারের কাজ করতে বলে দেওয়া থাকত। কিন্তু লেলে সে পাট তুলে দেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ভাবা যায়, নয়ের দশকের মধ্যভাগের আগে স্কোরারের কাজ করে একটা পয়সা পাওয়া যেত না! না বোর্ড থেকে, না রাজ্য থেকে। গাড়ি ভাড়া পর্যন্ত কপালে জুটত না! আবেগ বিক্রি হত তখন বিনামূল্যে। ক্রিকেটের এত বড় এক কর্মযজ্ঞ চলত সম্পূর্ণ নিখরচায়, স্রেফ এবং স্রেফ ভালোবাসার স্বর্ণমুদ্রায়!
দৈনন্দিন দৈন্যদশা থেকে স্কোরারদের স্বীকৃতি দেওয়ার কাজ সর্বপ্রথম করেন প্রয়াত বোর্ড সচিব জয়বন্ত লেলে। নয়ের দশকের মধ্যভাগে। ভদ্রলোক অতি সজ্জন ছিলেন। যে দু’একবার দেখেছি, প্রত্যাশিত ঠাঁটবাটের ছোঁয়া পাইনি বিন্দুমাত্র। তা, লেলেই নাকি ঠিক করেন বোর্ড নিযুক্ত স্কোরার থাকবে মাঠে। অতীতে আম্পায়ারদেরই স্কোরারের কাজ করতে বলে দেওয়া থাকত। কিন্তু লেলে সে পাট তুলে দেন। ঠিক করেন, প্রতিটা রাজ্য থেকে দু’জন করে আসবে, খরচা দেবে বোর্ড। পরীক্ষা হবে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাবে। চাইলে আরও দু’জন আসতে পারে, তবে ব্যক্তিগত খরচে। কালে-কালে লেলে এ দেশে ক্রিকেটের নতুন ‘প্রজাতি’-র ‘জন্ম’ দিলেন, হাতে দিন পিছু ছ’শো টাকা ধার্য করলেন। লোকগুলোও বড় খুশি হল। ওরা পেত না যে আগে কিছু। ক্লাব ক্রিকেট, রনজি ট্রফি দূরস্থান, আন্তর্জাতিক ম্যাচেও না। কপাল ভালো থাকলে বড়জোর টেস্টের ‘রেস্ট ডে’-তে নৈশভোজে আমন্ত্রণ, ব্যস। শোনা যায়, বাংলার নামী আম্পায়ার সুব্রত পোড়েল স্কোরারদের দুরাবস্থা জানতে পেরে উপরমহলে কথা বলে গাড়ি ভাড়ার বন্দোবস্ত করে দেন। নিজ উদ্যোগে।
অথচ মাঠে এদের গুরুত্ব কিছু কম ছিল না। গল্প এদের কাছে আজও বড় কম নেই। যা লিখতে গেলে কৃত্তিবাসের রামায়ণ হয়ে যাবে। ইমরান খান থেকে হ্যান্সি ক্রোনিয়ে, এদের না খুঁজে পেলে নাকি চোখে অন্ধকার দেখতেন! গৌতমবাবুই বলছিলেন। যাঁর কথা পূর্বে লিখেছি। ক্রিকেটের সেই ‘প্রাগৈতিহাসিক’ যুগে চারজন করে ‘অ্যানালিস্ট’ ঘুরত টিমের সঙ্গে। স্কোরারকে গোটা দিন সংখ্যা-রক্ষা শেষে বলতে হত, বিপক্ষের অমুক ব্যাটসম্যান কোন দিকে সবচেয়ে বেশি শট খেলেছে। ঘরের টিমকে একজন স্কোরার দেওয়া থাকত। অতিথি টিমকে আর একজন। গৌতমবাবু যেমন ‘ভিজিটিং’ টিম দেখতেন। প্রয়াত কৌশিক সাহা দেখভাল করতেন ‘হোম’ টিমের। ইমরান-আক্রম-ক্রোনিয়েরা বহুবার গৌতমকে বলেছেন, লাঞ্চের সময় এসো। কিংবা খেলা শেষে একেবারে হোটেলে চলে এসো। এসে গ্রাফ করো। পেন দিয়ে এঁকে বোঝাও সব। বোঝাতেন গৌতমবাবুরা। দেখাতেন সমস্ত ছবি এঁকে। আম্পায়ারিং করার ফাঁকে যিনি স্কোরারের গুরভারও পালন করতেন। হাসিমুখে। ভালোবাসার টানে। বয়ঃসন্ধিতে পাড়ার মাঠে যা শুরু হয়েছিল। বুড়ো বয়সেও সে ভালোবাসা হাত ছাড়েনি।
আন্তর্জাতিক আম্পায়ারদের সঙ্গেও স্কোরারদের গভীর সখ্যতা হয়ে যেত কখনও-সখনও। প্রখ্যাত আম্পায়ার সাইমন টাফেলকে নিয়েই যেমন একটা গল্প পাওয়া গেল। টাফেল নাকি খেলার আগের দিন মাঠে নিজের বসার জায়গা থেকে উঠে পিচের দিকে হাঁটতে শুরু করতেন। সম্পূর্ণ মৌনব্রতে। কারণ, সে সময় তিনি দেখে নিতেন পিচের কাছে যেতে সময় লাগছে কতক্ষণ! খেলার দিন তাঁকে ঠিক কোন সময় চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়তে হবে! যে কাহিনি কোনও আম্পায়ার নয়, এক স্কোরারের থেকে শোনা। যিনি সব দেখেছিলেন, দেখে জনে-জনে বলে দিয়েছিলেন।
ময়দানে বড়-বড় ক্লাবদের স্কোরার রাখার চল ছিল পূর্বে। নিজেদের রেকর্ড সংরক্ষণের অভিলাষে। কিন্তু স্কোরিং নিয়ে মাঝে গন্ডগোল বাঁধায় সে প্রথা তুলে দিয়েছে সিএবি। বেশ কয়েক বছর হল। এখন সব সিএবি নিযুক্ত স্কোরার। ক্লাবেরা আর ব্যক্তিগত স্কোরার রাখে না। তবে তাতে বদল বিশেষ আসেনি কিছু। থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোরের গড্ডালিকা প্রবাহ জীবন আছে তেমন, আগে ছিল যেমন (বাড়তি বলতে এক লক্ষের মেডিক্লেম)। রেস্ত থাকলে মেস। না থাকলে ভোর-ভোর ট্রেনে চেপে হাওড়া বা শিয়ালদহ। নেমে ছোটা চিরাচরিত গোপন ‘অভিসারে’, দিন শেষে পাঁচশো না হাজার, একবিন্দু না ভেবে। পরিশেষে সেই চার-ছয়-ডট বলের আঁক কষা, জ্যালজ্যালে চাঁদোয়া বা উন্মুক্ত আকাশের তলায় বসে, ঘড়ঘড়ে পাখার হাওয়ায়, রোদ-জল নির্বিশেষে, এক ফাঁপা প্রেমের তাড়নায়।
ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরেও শাহজাহানকে বন্দিদশা সহ্য করতে হয়েছিল। সংখ্যার শাহজাহানরাও বা বিচার পাবেন কেন?
(চলবে)
…পড়ুন খেলাইডোস্কোপ-এর অন্যান্য পর্ব…
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২০: প্রতি গুরু-পূর্ণিমায় প্রথম ফুল দেব সব্যসাচী সরকারকেই
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৯: ময়দানের ছবিওয়ালাদের কেউ মনে রাখেনি, রাখে না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৮: যারা আমার মাঠের পরিবার
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৭: অহং-কে আমল না দেওয়া এক ‘গোল’ন্দাজ
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৬: যে দ্রোণাচার্যকে একলব্য আঙুল উপহার দেয়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৫: সাধারণের সরণিতে না হাঁটলে অসাধারণ হতে পারতেন না উৎপল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৪: মনোজ তিওয়ারি চিরকালের ‘রংবাজ’, জার্সির হাতা তুলে ঔদ্ধত্যের দাদাগিরিতে বিশ্বাসী
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৩: অনুষ্টুপ ছন্দ বুঝতে আমাদের বড় বেশি সময় লেগে গেল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১২: একটা লোক কেমন অনন্ত বিশ্বাস আর ভালোবাসায় পরিচর্যা করে চলেছেন বঙ্গ ক্রিকেটের
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১১: সম্বরণই বঙ্গ ক্রিকেটের বার্নার্ড শ, সম্বরণই ‘পরশুরাম’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১০: যাঁরা তৈরি করেন মাঠ, মাঠে খেলা হয় যাঁদের জন্য
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৯: খণ্ড-অখণ্ড ভারতবর্ষ মিলিয়েও ক্রিকেটকে সম্মান জানাতে ইডেনতুল্য কোনও গ্যালারি নেই
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৮: ২০২৩-এর আগে আর কোনও ক্রিকেট বিশ্বকাপ এমন ‘রাজনৈতিক’ ছিল না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৭: রোহিত শর্মার শৈশবের বাস্তুভিটে এখনও স্বপ্ন দেখা কমায়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৬: বাংলা অভিধানে ‘আবেগ’ শব্দটাকে বদলে স্বচ্ছন্দে ‘বাংলাদেশ’ করে দেওয়া যায়!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৫: ওভালের লাঞ্চরুমে জামাইআদর না থাকলে এদেশে এত অতিথি সৎকার কীসের!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৪: ইডেনের কাছে প্লেয়ার সত্য, ক্রিকেট সত্য, জগৎ মিথ্যা!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৩: এ বাংলায় ডার্বিই পলাশির মাঠ
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২: গ্যালারিতে কাঁটাতার নেই, আছে বন্ধনের ‘হাতকড়া’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১: চাকরি নেই, রোনাল্ডো আছে