তিতিরের কথা শুনে শশব্যস্ত হয়ে উঠল হাতি আর মর্কট। শুঁড় তুলে হাতি নমস্কার করল, তাদের সঙ্গী পাখিটিকে। মর্কট সামনে ঝুঁকে শ্রদ্ধায় মাথা ছোঁয়াল মাটিতে। তিতিরকে তারা বলল, তুমি আমাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ। এবার থেকে তোমার খাদ্য-পানীয় সংগ্রহের দায়িত্ব আমরা নিলাম, তোমার বাসা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও আমাদের।
২১.
গৌতম বুদ্ধ জীবৎকালেই তাঁর ধর্ম সম্প্রদায়ের অধোগতি দেখে যান। দেখে যান, তাঁর প্রবর্তিত পবিত্র আধ্যাত্মিক ধারায় ইতোমধ্যেই বেনোজল ঢুকছে, নীতিহীনতার দূষণ ঘটছে; বিশৃঙ্খলতার পলি পড়ছে, আসছে ভাটার টান। সম্প্রদায়ের মধ্যেই একদল বিদ্রোহী মাথাচাড়া দিচ্ছিল। তাদের নেতৃত্ব দিত রূঢ়ভাষী, কলহপ্রিয় ছয় নেতা। তাদের বলা হত ‘ষড়্বর্গীয়’ বা ‘ষড়্বর্গিক’।
এদের অনুগামীদের যথেচ্ছাচার স্পষ্ট হল, শ্রাবস্তী নগরে বিহার উদ্বোধনের সময়। নির্ধারিত তিথির বেশ কয়েক দিন আগে, তারা সেখানে গিয়ে হাজির হল। অতিথিদের থাকার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল যেসব বাড়ি, তার অধিকাংশই তারা দখল করে নিল। পরে যখন বর্ষীয়ান স্থবিররা এলেন, তাঁরা অনেকেই থাকার জায়গা পেলেন না। এমনকী, প্রথম দিন এক গাছতলায় শুয়ে রাত কাটাতে হল, সারীপুত্রের মতো সম্মাননীয় শ্রমণকেও।
খবর পেয়ে বুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, এখনই এমন! তাহলে আমার পরিনির্বাণের পর সঙ্ঘজীবনে না জানি কত অরাজকতা চলবে।
পরদিনের প্রভাতি জমায়েতে তিনি সমাগত শিষ্যমণ্ডলীকে প্রশ্ন করলেন, বলো তো কে সবার আগে আশ্রয়, ভোজ্য ও পানীয় পাওয়ার অধিকারী?
নানা জনে, নানা উত্তর দিতে লাগল। কেউ বলল, যিনি প্রব্রজ্যাগ্রহণের পূর্বে ব্রাহ্মণ ছিলেন। কেউ বলল, যিনি সর্বাপেক্ষা ধনী। কেউ বলল, যিনি বিনয়ধর– অর্থাৎ ‘বিনয়’ নামক ধর্মশাস্ত্রে যাঁর ব্যুৎপত্তি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অতিথিদের থাকার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল যে সব বাড়ি, তার অধিকাংশই তারা দখল করে নিল। পরে যখন বর্ষীয়ান স্থবিরেরা এলেন, তাঁরা অনেকেই থাকার জায়গা পেলেন না। এমনকী প্রথম দিন এক গাছতলায় শুয়ে রাত কাটাতে হল, সারীপুত্রের মতো সম্মানীয় শ্রমণকেও।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কোনও উত্তরই বুদ্ধদেবের পছন্দ হল না। তিনি বললেন, তোমাদের বরং আমার পূর্বজন্মের এক কাহিনি শোনাই। সেই জন্মে আমি জন্মেছিলাম, তিত্তির হয়ে।
মানে ছোট্ট তিতির পাখি?
হ্যাঁ, হিমালয়ের পাশে এক বিশাল ন্যগ্রোধ বৃক্ষে আমি থাকতাম, ডালে ডালে উড়ে বেড়াতাম। মৌদ্গল্যায়ন আর সারীপুত্র সেই জন্মেও আমার নিত্যসঙ্গী ছিলেন। তোমরা তাঁদের চেনো তো?
তাঁদের কে না চেনে? তাঁরা দু’জন গৌতম বুদ্ধের অগ্রশ্রাবক। ‘শ্রাবক’ মানে ধর্মীয় বিষয় যিনি শ্রবণ-ধারণ-পালন করেন– সোজা কথায়, ‘শিষ্য’। তাই ‘অগ্রশ্রাবক’ মানে শিষ্যদের মধ্যে যিনি অগ্রগণ্য বা শ্রেষ্ঠ। সারীপুত্র জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ, মৌদ্গল্যায়ন ঋদ্ধিশক্তিতে।
তাঁরাও তিতির ছিলেন?
না, মৌদ্গল্যায়ন ছিলেন হাতি, সারীপুত্র ছিলেন মর্কট।
এই তিনের মধ্যে বন্ধুত্ব?
সেই জন্যই তো এ গল্প আশ্চর্য। গভীর বন্ধুত্ব ছিল এই তিনজনের। আমি থাকতাম ন্যগ্রোধ গাছের ডালে, আর ওর ছায়ায় ওরা বিশ্রাম করত। একদিন গল্প করতে করতে এই গাছ নিয়ে আমাদের শৈশব স্মৃতির কথা উঠল। সেখান থেকেই এই জাতক গল্পে প্রবেশ।
হাতি বলল, আমার ছেলেবেলায় এই গাছ এত ছোট ছিল যে, আমি আমার চার পায়ের ফাঁকে এই গাছকে রেখে যখন দাঁড়াতাম, এর মগডাল আমার নাভিদেশ কোনও রকমে স্পর্শ করত।
মর্কট তার সুখস্মৃতি হাতড়ে বলল, ছেলেবেলায় আমি মাটিতে বসে মুখ বাড়িয়ে এই গাছের আগডালের কচি পাতা খেতাম।
তাই শুনে হাতি তার শুঁড় দিয়ে মর্কটের পিঠে চাপড় দিয়ে বলল, তবে তো ভায়া আমরা দু’জন পিঠোপিঠি স্যাঙাৎ! তা তিতির, তুমি ছেলেবেলায় এই গাছকে কী অবস্থায় দেখেছ?
আমার ছেলেবেলায় এখানে ফাঁকা ঘাসজমি ছিল, রোদের তেজে পুড়ে যেত কচি তৃণ। দূরের এক বনে অন্য এক ন্যগ্রোধ বৃক্ষের ফল খেয়ে উড়ে এসে, এখানে আমি মলত্যাগ করি। সেই বীজ থেকেই এই গাছের অঙ্কুরোদ্গম।
তিতিরের কথা শুনে শশব্যস্ত হয়ে উঠল হাতি আর মর্কট। শুঁড় তুলে হাতি নমস্কার করল, তাদের সঙ্গী পাখিটিকে। মর্কট সামনে ঝুঁকে শ্রদ্ধায় মাথা ছোঁয়াল মাটিতে। তিতিরকে তারা বলল, তুমি আমাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ। এবার থেকে তোমার খাদ্য-পানীয় সংগ্রহের দায়িত্ব আমরা নিলাম, তোমার বাসা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও আমাদের। তুমি আমাদের পরামর্শ দেবে, উপদেশ দেবে, অভিজ্ঞতা ভাগ করে দেবে।
তা-ই চলতে থাকল। এই তিন প্রাণীর পারস্পরিক বোঝাপড়া আর গুরুজনকে অগ্রাধিকার দেওয়ার এই ধারা বৌদ্ধ সাহিত্যে ‘তিত্তির ব্রহ্মচর্য’ নামে পরিচিত হল।
গল্প শেষ করে, গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিষ্যমণ্ডলীর উদ্দেশে বললেন, এই গল্প আজ কেন তোমাদের শোনালাম, তোমরা বুঝতে পারলে?
মাথা নীচু করল, ষড়্বর্গীয়দের অনুগামীরা। তারা বুঝতে পেরেছে।
(সূত্র: তিত্তির জাতক)
…নব জাতক-এর অন্যান্য পর্ব…
নব জাতক পর্ব ২০: আফসোস যে শ্রেষ্ঠী-বালিকার পরিচয় অজ্ঞাত থেকে গেল
নব জাতক পর্ব ১৯: ছদ্মবেশে প্রজার সুখ দেখতে বেরিয়ে লজ্জিত হয়ে পড়লেন রাজা
নব জাতক পর্ব ১৮: ব্রাহ্মণের সন্তান হলেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না
নব জাতক পর্ব ১৭: এত ছোট চারাই যদি এমন হয়, বড় বৃক্ষ হলে না জানি কেমন বিষাক্ত হবে
নব জাতক পর্ব ১৬: প্রকৃত চরিত্রবানের পিছনে তলোয়ারের আতঙ্ক রাখার দরকার হয় না
নব জাতক পর্ব ১৫: নেপথ্য থেকে যে নেতৃত্ব দেয়, তাকে অস্বীকার করা যায় না
নব জাতক পর্ব ১৪: প্রাণীহত্যার মতো নির্মম আয়োজনে দেবতার সন্তুষ্টি হয় কী করে!
নব জাতক পর্ব ১৩: এক হাজার দস্যুর লাশ আর রত্ন পেটিকা
নব জাতক পর্ব ১২: সীতা যখন রামের বোন, দিতে হয়নি অগ্নিপরীক্ষাও
নব জাতক পর্ব ১১: শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় কোনও সন্ত্রাসবাদীকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা সে-ই বোধহয় প্রথম
নব জাতক পর্ব ১০: নিকটজনের অন্যায্য আবদারে রাজধর্মে বিচ্যুত হওয়া যায় না
নব জাতক পর্ব ৯: লকলকে লোভের আগুনে সদুপদেশ খাক হয়ে যায়
নব জাতক পর্ব ৮: যেখানে মৃত্যু প্রবেশ করতে পারে না, শুধু জীবনের জয়গান
নব জাতক পর্ব ৭: অভয় সরোবর সত্ত্বেও কেন ব্যাধ ফাঁদ পেতেছিল সুবর্ণহংসের জন্য?
নব জাতক পর্ব ৬: জন্ম-জন্মান্তরের বিষয়-আকাঙ্ক্ষা যখন হেলাফেলা করা যায়
নব জাতক পর্ব ৫: পলাশ গাছ ছায়া দিত কালো সিংহকে, তবু তারা শত্রু হয়ে গেল
নব জাতক পর্ব ৪: দৃষ্টি ক্ষীণ হলেও, অন্তর্দৃষ্টি প্রবলভাবে সজাগ
নব জাতক পর্ব ৩: শূকরের তাকানোয় বাঘের বুক দুরুদুরু!
নব জাতক পর্ব ২: আরও আরও জয়ের তৃষ্ণা যেভাবে গ্রাস করে অস্তিত্বকে
নব জাতক পর্ব ১: খিদে মেটার পরও কেন ধানের শীষ নিয়ে যেত পাখিটি?