পোড়া প্রতিমা গঙ্গায় জলের বিছানা পেয়েছিলেন, পোড়া মানুষী ধর্মের নিয়মে আবার পুড়লেন। প্যান্ডেল পুড়ে যাওয়ার পরের দিনগুলোর মতোই কিছুদিনের জন্য গলির ওই অংশটায় একটু কালো দাগ লেগে রইল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ কেউ আড়চোখে দেখতেন, ঘাড় নাড়তেন। বাবুসোনা দ্রুত পায়ে পেরিয়ে যেত ওই অঞ্চল। কারণ অজানা এক আতঙ্ক, না কি অসহায়তা?
‘বাবুসোনা, ওদিকে যেও না, আগুন আছে।’ গনগনে উনুনের ভিতর থেকে ঠিকরে বেরনো আলো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। কাছে টানে। শিশু সাবধানবাণীর মানে বোঝে না। যতক্ষণ না গায়ে আঁচ লাগছে, এগিয়ে যায়। তারপর একটা হ্যাঁচকা টানে সে নিরাপদ আশ্রয়ে। আকর্ষণ রয়ে যায়। শৈশব একলাফে অনেকটা বড় হয়, নিজেই কয়লার উনুন ধরাতে শেখে। খবরের কাগজ জ্বালিয়ে মা মূল আগুনটি ধরিয়ে দিলে সে নীচু হয়ে ফুঁ দিতে থাকে। কয়লা জ্বলে ওঠে, আর জ্বলে বাবুসোনার চোখ। কিন্তু আগুন আর সে যখন কাছাকাছি, এক বিকেলে উঠোনে উদাসীন পদচারণাকালে, একটি জ্বলন্ত কয়লার টুকরো তার পায়ে গেঁথে যায়। তার ফলে পরিবারের সঙ্গে নিউ ব্যারাকপুরে নৈশভোজের নিমন্ত্রণে যাওয়া হয় না। আসলে আর কোনও দিনই নিউ ব্যারাকপুর যাওয়া হয় না। ওই ঘটনায় বাবুসোনার আগুনের ওপর রাগ হয় এবং সে উনুন ধরানোর মতো উত্তেজক কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে বাড়ে লোডশেডিং। নিয়ম করে সন্ধ্যায়। বিশেষত গ্রীষ্মকালে। তখন মোমবাতি জ্বালানোর জন্য আবার আগুনের সঙ্গে ভাব করতে হয়। দেশলাই। একটা-দুটো কাঠি নিভে গেলেও তৃতীয় কাঠির ঘষা লেগে ঠিক জ্বলে ওঠে বারুদ, ফসস্ শব্দ করে। মোমবাতির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের অজান্তেই ডানহাতের তর্জনী এগিয়ে যায় শিখার দিকে। একটু ঠেলা দিলে শিখা কাঁপে, যেন ভয় পায়। বাবুসোনা মজা পায়, কারণ আগুন তাকে ভয় পাচ্ছে– এই ধারণা ক্রমশ বদ্ধমূল হয়। কিন্তু এক শীতকালের রাতে ভয় ফিরে আসে। কাঁথার আস্তরণ ভেদ করে দমকলের ঘণ্টি কানে আসে গলির মোড় থেকে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে সে শুনতে পায় বাড়ির বড়দের কথোপকথন। সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেলে আগুন লেগেছে। পরদিন ভোরে উঠে এক দৌড়ে অকুস্থলে। পোড়া বাঁশ, ভেজা ত্রিপলের টুকরো। ঠাকুরের মুখ কেউ ঢেকে দিয়েছে কিন্তু দু’-হাতে দ্গদগে ঘা দৃশ্যমান। সাদা রাজহাঁস আলকাতরা মেখে বসে আছে যেন। জানা গেল পাশের কোনও একটি বাড়ি থেকে, রাতের শেষ সিগারেট কেউ টোকা মেরে ফেলেছিল জানলা দিয়ে। একটা স্ফুলিঙ্গ থেকে দপদপিয়ে বেড়ে ওঠা আগুন খাক করে দিল দোতলা সমান প্যান্ডেল। ওই প্যান্ডেল নিয়েই হাহুতাশ চলে সারাক্ষণ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
প্রতিমা নিয়ে চিন্তিত নয় কেউ। তার কারণ, তখনও বড় রাস্তার বাজারে কয়েকটি অবিক্রীত সরস্বতী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে কেউ, ছোট বা মাঝারি সাইজের। পুজো হয় সেবার, কিন্তু ওই ঘটনার রেশ থেকে যায় বহুদিন। একদিন পাড়ার দু’প্রান্তের দুই ক্লাব মিলে গিয়ে আরও বড় পুজো হয়, অন্য জায়গায়। বাবুসোনাও বড় হবে একদিন, সিগারেট ধরবে। লোডশেডিংয়ে দেশলাই ধরানোর অভিজ্ঞতা অবশেষে কাজে আসবে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
প্রতিমা নিয়ে চিন্তিত নয় কেউ। তার কারণ, তখনও বড় রাস্তার বাজারে কয়েকটি অবিক্রীত সরস্বতী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে কেউ, ছোট বা মাঝারি সাইজের। পুজো হয় সেবার, কিন্তু ওই ঘটনার রেশ থেকে যায় বহুদিন। একদিন পাড়ার দু’প্রান্তের দুই ক্লাব মিলে গিয়ে আরও বড় পুজো হয়, অন্য জায়গায়। বাবুসোনাও বড় হবে একদিন, সিগারেট ধরবে। লোডশেডিংয়ে দেশলাই ধরানোর অভিজ্ঞতা অবশেষে কাজে আসবে। মনে হবে জ্বলন্ত সিগারেটের আগুন দেখতে অনেকটা কয়লার আগুনের মতোই। কিন্তু প্রত্যেকবার সিগারেট ধরানোর সময় মনে পড়বে ওই পুজোর কথা, মাটির প্রতিমা পুড়ে যাওয়ার কথা। এবং নিতান্ত কাকতালীয়ভাবেই প্রায় একই অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশে অন্য এক মানুষীর পুড়ে যাওয়ার কথা। সেদিন বিকেল। শীত, গ্রীষ্ম, কি বসন্ত, মনে আছে কারও? তবে বর্ষা ছিল না এটা নিশ্চিত। কারণ যে মানুষী জ্বলছিলেন দাউদাউ করে, নিজের বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে, তাঁর গায়ে বৃষ্টি পড়েনি। বাবুসোনার বন্ধুরা তাকে ডাকতে এসেছিল সে দৃশ্য দেখার জন্য, কিন্তু সে পিছপা হয়। কারণ, আগুনের ওপর তার রাগ জন্মেছিল, বা ফিরে এসেছিল শৈশবের ভয়। সব চুকেবুকে যাওয়ার পর পাড়ার রকে মূলত আগুনের দমক নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তার দোতলার জানলা ছুঁয়ে ফেলা উচ্চতা, দুষ্প্রাপ্য কাঠের দরজা পুড়িয়ে দেওয়ার অহম নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। ঝলসানো শরীর নিয়ে কাউকে কিছু বলতে শোনা যায়নি, অন্তত বাবুসোনা শোনেনি।
পোড়া প্রতিমা গঙ্গায় জলের বিছানা পেয়েছিলেন, পোড়া মানুষী ধর্মের নিয়মে আবার পুড়লেন। প্যান্ডেল পুড়ে যাওয়ার পরের দিনগুলোর মতোই কিছুদিনের জন্য গলির ওই অংশটায় একটু কালো দাগ লেগে রইল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ কেউ আড়চোখে দেখতেন, ঘাড় নাড়তেন। বাবুসোনা দ্রুত পায়ে পেরিয়ে যেত ওই অঞ্চল। কারণ অজানা এক আতঙ্ক, না কি অসহায়তা? একদিন সেই বাড়ি রং হল। এবং নিঃশব্দে নতুন বধূ এলেন। ঠিক যেভাবে আড়ম্বরহীন পুজো হয়েছিল প্যান্ডেল পুড়ে যাওয়ার পর। জানলা গলে কানে আসা তাঁর হাসির শব্দে, শাঁখা-পলা-নোয়ার ঠোকাঠুকির শব্দে পাড়ার লোকজন আবার ঘাড় সোজা করে হাঁটতে শিখলেন। কিন্তু বাবুসোনা বুঝতে পারল, ওই দুই বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের কোনওটাই প্রত্যক্ষ করার সাহস হয়নি বলে তার মধ্যে এক অদ্ভুত হীনম্মন্যতার জন্ম নিয়েছে। যা তাকে দগ্ধ করবে সারা জীবন।
…পাল্টি-র অন্যান্য পর্ব…
পাল্টি পর্ব ২২: বাংলা মদের মতো বাংলা ভাষার নেশাটাও যদি চিরস্থায়ী হত!
পাল্টি পর্ব ২১: সাদা কাঠির ডগায় লাল আলো
পাল্টি পর্ব ২০: যে কারণে বুলাদির মর্তে আগমন
পাল্টি পর্ব ১৯: আরে নামের সামনেই পেছন নিয়ে ঘুরছিস?
পাল্টি পর্ব ১৮: ‘আসল হিজড়ে’ কথাটা সোজা মাথায় আঘাত করে
পাল্টি পর্ব ১৭: গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে মাথা রেখে কোথায় চলেছেন অ্যাপ ক্যাবের ড্রাইভার?
পাল্টি পর্ব ১৬: কো-এড কলেজে পড়তে এসে বুঝি পিরিয়ড খুব একটা সুখের ক্লাস নয়
পাল্টি পর্ব ১৫: পচা ইলিশ ঝোলানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হত পাড়ার মেজরিটি পাবলিক
পাল্টি পর্ব ১৪: গুরু তুমি তো ফার্স্ট বেঞ্চ
পাল্টি পর্ব ১৩: আমের সিজন ফুরিয়ে গেলে ল্যাংড়া তার আসল অর্থ খুঁজে পায়
পাল্টি পর্ব ১২: টিবি হয়েছে বলে আড়ালে বন্ধুটির নাম দেওয়া হয় ‘কিশোর কবি’
পাল্টি পর্ব ১১: ডোমেরা জানে, আগুনের তর সয় না
পাল্টি পর্ব ১০: আমেরিকায় খুন হওয়ার থেকে স্বদেশি দুর্ঘটনায় মৃত্যু ভাল
পাল্টি পর্ব ৯: মানুষ হয়ে জন্মেছি, ব্যাং কী করে জন্মায়, তা জেনে কী হবে?
পাল্টি পর্ব ৮: খোকাবাবু, ম্যাডাম স্যুইটে আছেন, এক ঘণ্টায় ৪০০ দেবেন বলছেন
পাল্টি পর্ব ৭: ও তো সন্ধে থেকেই গিরিশ ঘোষ
পাল্টি পর্ব ৬: যে দোকানের বেবিফুডে বেড়ে উঠলাম, সেখান থেকেই বীরদর্পে কন্ডোম কিনেছি
পাল্টি পর্ব ৫: প্রায়শ্চিত্ত রোল অ্যান্ড কর্নার
পাল্টি পর্ব ৪: দু’অক্ষর কথা, চার-অক্ষর কথা
পাল্টি পর্ব ৩: ‘টুকলি’ ঈশ্বরের দয়ার শরীর
পাল্টি পর্ব ২: পাগলি তোমার সঙ্গে
পাল্টি পর্ব ১: প্যান্টি যেন বদ্বীপ, লাজুকলতা নরম কাপড় জুড়ে যাবতীয় গোপনীয়তা