তবু বর্ষার আছে একটা বাইশে শ্রাবণ, আছে রুপোলি শস্য ইলিশ। আর আছে এক পাহাড়প্রমাণ কনফিউশন। কী খাবেন– বিরিয়ানি নাকি খিচুড়ি? আনমনা মন কী শুনবে জর্জ বিশ্বাস নাকি রিমঝিম গিরে সাওন? ভেজা জামা বারান্দায় মেলবেন নাকি ঘরের উত্তর মেরু-দক্ষিণ মেরু জোড়া দড়ি টাঙাবেন? আদা চায়ে গলা ভেজাবেন নাকি কফি ভালো জমবে? চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোবেন নাকি মেখে নেবেন জানলা খুলে একটু জলের ছাঁট?
২৪.
আকাশ নিয়ে বাঙালির একটা বিচ্ছিরি রকমের আদিখ্যেতা আছে। এই ধরুন, আশ্বিন মাস, শরৎকাল পড়ল কি পড়ল না, আকাশে তুলোটে মেঘ দেখলেই বাঙালির মন ঢাক কুরকুর করে বেজে ওঠে। তেলচিটে রেডিওটাকে নস্ট্যালজিয়ায় চুবিয়ে মহালয়ার টিউনিং সেট করে। বোঝে না, পৃথিবীটা এখন গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ে চলছে। সকালে সাদা মেঘ দেখেছেন তো কী, ভরদুপুরে দেখবেন– আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে, সুয্যি গেছে পাটে! তখন আবার থরেথরে সাজানো মায়াকাজল মাখা মেঘের বুকে সাদা বক দেখে মূর্চ্ছা গেলে মুশকিল, জগৎসংসার আপনাকে ‘ঠাকুর… ঠাকুর…’ বলে চিয়ার আপ করবে। মাঝখান থেকে আপনি ‘কনফিউশন’-এ ঢোঁক গিলে ভাবতে বসবেন– ‘হু অ্যাম আই?’ গব্বর না গদাই!
বেশি তলিয়ে ভেবে লাভ নেই। কনফিউশন কোনও মারণব্যাধি নয়। বরং ওটা বাঙালির মজ্জাগত। বাঙালি জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রীত্ব দিতে গিয়ে কনফিউশনে পড়ে যায়। শিল্প না কৃষি– কোনটা ভিত্তি, আর কোনটা ভবিষ্যৎ, তা ঠিক করতে গিয়ে হিমসিম খায়। সেখানে দলবদলু নেতার মতো আকাশের রংবদল দেখে আমার-আপনার কনফিউশনের চোয়াঢেঁকুর উঠবে, এতে অবাক হওয়ার কী আছে!
কনফিউশনের কথাই যখন হচ্ছে, তখন বলুন তো, বাঙালির কাছে বর্ষাকাল কি সবথেকে কনফিউজড ঋতু? হওয়ার একটা হাই চান্স তো রয়েছেই। আরে মশাই, এ তো আর কালিদাসের ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ নয়, যে টলটলে যৌবনভরা মেঘ দেখে যক্ষের মনে প্রেম উতলে উঠবে। এ হল বাংলার ভাগ্যাকাশে বর্ষার ঘনঘটা। সেটাও অচানক। এই রোদ, তো এই মেঘ। বৃষ্টিতে কাকচান করার আগেই দেখবেন, সুয্যিমামা ফের আকাশে ভেসে উঠেছেন। তা বলে ছাতা রাখবেন না সঙ্গে, এই ভুল করলে মুষলধারায় মাশুল গুনবেন। খেয়াল করলে দেখবেন, বৃষ্টিবাদলার চেয়ে আজকাল রোদ্দুরটাই বর্ষাকালে পোহাতে হয় বেশি। বৃষ্টি যেন লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট– দেখা দিয়েই গায়েব!
তবে ইদানীং আবহাওয়া দপ্তর টিভিতে স্নো-পাউডার মাখা জ্যোতিষ-বিশারদদের সঙ্গে সমানে সমানে পাল্লা দিচ্ছে। প্রায় হাতে-কলমে তিথি-নক্ষত্র-সমেত মিলিয়ে দিচ্ছে– মঙ্গলে নিম্নচাপ, বুধে বৃষ্টি। আর বলিহারি মিডিয়া। ফেসবুক খুলে দু’-দণ্ড শান্তি নেই! নিউজ ফিডে ক্রমাগত আপডেটের ঝড়– ‘প্রবল নিম্নচাপে ভাসবে রাজ্যের এই জেলা’! দুরুদুরু বুকে ক্লিক করলেই হল– দেখবেন, সব ফস্কা গেরো! বৃষ্টি আপনার কান ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়েছে অন্য জেলায়!
আসলে কী জানেন, বৃষ্টি হল প্রথম প্রেমের মতো। আপনাকে কনফিউশনের তাওয়ায় ওমলেটের মতো ভাজবে। ঝমঝমে চপলতায় লোভী মনকে বিষাক্ত স্লোয়ার দেবে– ভিজবেন নাকি গা বাঁচাবেন? মাথায় পড়লেই কিন্তু ঠান্ডা লাগার প্রবল আশঙ্কা। আবার বৃষ্টি পড়ছে বলে আদুর গায়ে একটু ভিজে নেবেন, এমন ‘মাস্টারপ্ল্যান’ ভেজে রাখলেও কিন্তু প্রবলেম আছে। দেখবেন হয় রাস্তায় কাদার প্যাচপ্যাচানি, নচেৎ খানাখন্দ। পুরো একটা খাটাল-খাটাল ফিলিং জাগবে মনে। আর যদি বর্ষার তোড়ে জলসমুদ্রে ভাসেন, তবে সাধু সাবধান, দেখে-শুনে পা ফেলুন। নতুবা দেখবেন মেট্রোর চোরা-সুড়ঙ্গে আপনিও ঢুকে পড়েছেন, গঙ্গা এফোঁড়-ওফোঁড় করা মেট্রোরেলের মতো।
তবু বর্ষার আছে একটা বাইশে শ্রাবণ, আছে রুপোলি শস্য ইলিশ। আর আছে এক পাহাড়প্রমাণ কনফিউশন। কী খাবেন– বিরিয়ানি নাকি খিচুড়ি? আনমনা মন কী শুনবে জর্জ বিশ্বাস নাকি রিমঝিম গিরে সাওন? ভেজা জামা বারান্দায় মেলবেন নাকি ঘরের উত্তর মেরু-দক্ষিণ মেরু জোড়া দড়ি টাঙাবেন? আদা চায়ে গলা ভেজাবেন নাকি কফি ভালো জমবে? চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোবেন নাকি মেখে নেবেন জানলা খুলে একটু জলের ছাঁট? কনফিউজড মন উত্তর-সন্ধানে বনলতা নয়, মুখোমুখি বসিবার জন্য বর্ষাকেই বেছে নেয়। সেই ডাউন মেমরি লেনে ভিড় করে আসে স্কুল-ফেরত ভেজা মোজা-জুতো, বাতাসের জোলো হাওয়ায় দোলা দিয়ে যায় বৃষ্টিভেজা মোহনবাগান মাঠে ব্যারেটোর ব্যাকভলি।
বৃষ্টি তখন কৃষ্ণকলি। আকাশের মতো মনকেও ভাসায়।
…………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ২৩: ও ক্যাপ্টেন! মাই ক্যাপ্টেন!
পর্ব ২২: শচীন-বিরাটরা আসেন-যান, ভারত থেকে যায়
পর্ব ২১: কিং কোহলি দেখালেন, ধৈর্যের ফল বিরাট হয়
পর্ব ২০: মনকে শক্ত করো টেস্ট, রাজা আর ফিরবেন না
পর্ব ১৯: মুকুল কিংবা ফিলিস্তিনি বালক, খুঁজে চলেছে যে যার ঘর
পর্ব ১৮: ধোনিবাদ: ধাঁধার চেয়েও জটিল তুমি…
পর্ব ১৭: সাদা সাদা কালা কালা
পর্ব ১৬: গতবারের বিক্রি প্রতিবারই ছাপিয়ে যায় বইমেলা, কারণ দামবৃদ্ধি না পাঠকবৃদ্ধি?
পর্ব ১৫: সেন ‘মায়েস্ত্রো’কে ভুলে বাঙালি দেখিয়েছে, সে আজও আত্মবিস্মৃত
পর্ব ১৪: শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসই বাঙালির প্রকৃত সান্তা
পর্ব ১৩: প্রবাসে, দোতলা বাসে, কলকাতা ফিরে আসে
পর্ব ১২: না-দেখা সেই একটি শিশিরবিন্দু
পর্ব ১১: ঘোর শত্রুর বিদায়বেলায় এভাবে বলতে আছে রজার ফেডেরার?
পর্ব ১০: অভিধানের যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি মনুষ্যরূপ ধারণ করেছে
পর্ব ৯: জোট-অঙ্কে ভোট-রঙ্গ
পর্ব ৮: দক্ষিণ বিসর্জন জানে, উত্তর জানে বিসর্জন শেষের আগমনী
পর্ব ৭: পুজো এলেই ‘সর্বজনীন’ নতুবা নিঃসঙ্গ?
পর্ব ৬: এক্সক্লুসিভের খোয়াব, এক্সক্লুসিভের রোয়াব
পর্ব ৫: শাসন-সোহাগের দ্বন্দ্বসমাস
পর্ব ৪: পাঁকাল সাধনায় নাকাল
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved