প্লেনটা যতক্ষণে ওহায়ো-তে নামল, ততক্ষণে এই গানটির প্রথম তিনটি স্তবক লেখা হয়ে গিয়েছে পিট সিগারের– ‘হোয়ার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ার্স গন’। সুরটার মধ্যে কসাক লালাবাই-এর ছোঁয়া আছে, কিন্তু সেই সুরটাকে মার্কিন লোকসুরের উপযোগী করেন তিনি। তবে পিট সিগার মাত্র একটাই লাইন জুড়েছিলেন, এবং সেটা লিখেছিলেন গ্রাম্য ইংরেজিতে– long time passing. এই লাইনটা ইংরেজি ব্যাকরণ মানে না। কিন্তু তবুও আমরা, শ্রোতারা বুঝতে পারি সময়ের নদী বয়ে চলেছে কত না দীর্ঘকাল ধরে। যুদ্ধও চলছে অনেকদিন ধরে।
২.
হোয়ার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ার্স গন, পিট সিগার, ১৯৬২
একটা প্লেন উড়ে চলেছে, প্লেন থেকে নীচে দেখা যাচ্ছে সুবিস্তীর্ণ ঘাসজমি, ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা জলের নিশানা। কিন্তু কোনও মানুষ দেখা যাচ্ছে না। সেই প্লেনে রয়েছেন এক বিখ্যাত মার্কিন লোকসংগীতশিল্পী। তাঁকে আজকাল বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে গান গাইতে হয়। কারণ মার্কিন সরকার তাঁর টেলিভিশন, রেডিও, পাবলিক কনসার্ট হলে গান গাওয়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। তাঁকে ম্যাককারথিয়ান-বিরোধী বলে দোষারোপ করা হয়েছিল। এই শিল্পীর নাম পিট সিগার। তিনি চলেছেন ওবারলিন কলেজে গান গাইতে। ওপর থেকে ওই জনমানবশূন্য পৃথিবীপৃষ্ঠ দেখতে দেখতে তাঁর মনে পড়ল মিখাইল শলোখভের ‘অ্যান্ড কোয়ায়েট ফ্লোজ দ্য ডন’ উপন্যাসটার কথা। সেখানে একটি বর্ণনা ছিল–
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কসাক সৈন্যরা মাঠের পর মাঠ, খেতের পর খেত, গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে। তারা যাচ্ছে জারের সৈন্যদের যোগ দিতে। তারা যুদ্ধে যাচ্ছে, তারা মাঠ-বন্দর পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এত দীর্ঘ পথ খাঁ-খাঁ করছে কেন? কেন কোথাও কোনও প্রাণের চিহ্ন নেই? কেন সবুজ ঘাসগুলো শুকিয়ে গেছে, কেন ফুলগুলো ঝরে গেছে? শুধু ডন নদীটা একা একা বয়ে চলেছে, গ্রামের পর গ্রাম, নগরের পর নগর, খেতের পর খেত। নদীর জলছল শব্দ শোনার জন্যও কেউ আর বেঁচে নেই। কসাক সৈন্যের দল, নিঃসঙ্গ পৃথিবীর মাঝে দাঁড়িয়ে ভাবছে সবাই কোথায় গেল?
এক সৈন্য জবাব দিচ্ছে, সবাই হয় পালিয়েছে বা সৈন্য হতে চলে গেছে বা মারা গেছে।
প্লেনটা যতক্ষণে ক্লিভল্যান্ড ওহায়ো-তে নামল, ততক্ষণে এই গানটির প্রথম তিনটি স্তবক লেখা হয়ে গিয়েছে পিট সিগারের– ‘হোয়ার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ার্স গন’। সুরটার মধ্যে কসাক লালাবাই-এর ছোঁয়া আছে, কিন্তু সেই সুরটাকে মার্কিন লোকসুরের উপযোগী করেন তিনি। তবে পিট সিগার মাত্র একটাই লাইন জুড়েছিলেন, এবং সেটা লিখেছিলেন গ্রাম্য ইংরেজিতে– long time passing. এই লাইনটা ইংরেজি ব্যাকরণ মানে না। কিন্তু তবুও আমরা, শ্রোতারা বুঝতে পারি সময়ের নদী বয়ে চলেছে কত না দীর্ঘকাল ধরে। সময়ের বহমানতা শুধু এই একটা বাক্যেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে, গানটাও কি সময় পেরচ্ছে না তারই সঙ্গে হাত মিলিয়ে? যুদ্ধের এক চিরকালীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা বুঝতে পারি, যুদ্ধ চলছে অনেক দিন ধরে।
Where have all the flowers gone?
Long time passing
Where have all the flowers gone?
Long time ago
Where have all the flowers gone?
The girls have picked them, every one
Oh, when will they ever learn?
Oh, when will they ever learn?
Where have all the young girls gone?
Long time passing
Where have all the young girls gone?
Long time ago
Where have all the young girls gone?
They’ve taken husbands, every one
Oh, when will they ever learn?
Oh, when will they ever learn?
Where have all the young men gone?
Long time passing
Where have all the young men gone?
Long time ago
Where have all the young men gone?
They’re all in uniform
Oh, when will they ever learn?
Oh, when will they ever learn?
পিট সিগার এইটুকু লিখেছিলেন, যতটুকু বর্ণনা ছিল, ততটা নিয়ে প্রাথমিকভাবে গানটা তৈরি হয়। কিন্তু গানটি এখানেই থেমে যায়নি। জো হেকারসন নামক এক শিল্পী এই গানটিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দেন। তিনি একটা আশ্চর্য কাজ করেন, গানের একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ করেন। উনি বলবেন–
–ফুলগুলো সব কোথায় গেল
–অল্পবয়সি মেয়েরা তুলে নিয়ে চলে গেছে
–অল্পবয়সি মেয়েরা কোথায় গেছে
–ওদের সব বিয়ে হয়ে গেছে
–ওদের বরেরা কোথায় গেছে
–ওরা সব সৈন্য হতে গেছে
–সৈন্যরাই বা কোথায় গেল
–ওরা সবাই করবে চলে গেছে
–কিন্তু কবরগুলো তো দেখছি না
দেখবে কী করে, ওগুলো তো সব ফুল দিয়ে ঢাকা। কবরগুলোতে ফুল দেওয়ার জন্যই তো সব ফুল তুলে আনা হয়েছে।
এইখানে এসে বৃত্তটা শেষ হয়।
Where have all the soldiers gone?
Long time passing
Where have all the soldiers gone?
Long time ago
Where have all the soldiers gone?
Gone to graveyards, every one
Oh, when will they ever learn?
Oh, when will they ever learn?
Where have all the graveyards gone?
Long time passing
Where have all the graveyards gone?
Long time ago
Where have all the graveyards gone?
Gone to flowers, every one
Oh, when will we ever learn?
Oh, when will we ever learn?
জো হেকারসন গানের একেবারে শেষে আকস্মিক একটা মোচড় দেন। আমরা হঠাৎ শুনি গানটা আমাদের সরাসরি প্রশ্ন করছে। শুরু থেকে ‘when will they ever learn?’ বলে আসছিল, আমরাও অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম এই কথার দুলুনিতেই। শেষে এসে হয়ে গেল ‘when will we ever learn?’ এবার নিজেদের দিকে তাকাতে বলেন তিনি। ‘they’ থেকে ‘we’ হয়ে গেল। ওরা-আমরা একাকার হয়ে গেলাম। যুদ্ধক্ষেত্রে না থেকেও আমরা যুদ্ধেরই সৈনিক। যুদ্ধ বন্ধ করার কোন প্রয়াস নিয়েছি আমরা? আমরাও কি যুদ্ধবাজ নই?
তবে এই গানের সঙ্গে আরও একজন জড়িত। তিনি বিখ্যাত অভিনেত্রী মার্লিন দিত্রিশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি এই গানটা গেয়েছিলেন জার্মান ভাষায় (পরে অবশ্য ইংরেজি ও ফরাসি ভাষাতে তিনি লাইভ পারফর্ম করেন)। জার্মানি যখন বিশ্বযুদ্ধে নারকীয় হত্যালীলা চালাচ্ছে, বিরোধী ভাষ্যকে গলা টিপে খুন করছে, দেশ ছেড়ে পালাতে হচ্ছে মানুষকে, তখন মার্লিন দিত্রিশ জার্মান ভাষাতেই গাইলেন যুদ্ধবিরোধী গান– ফুলগুলো সব কোথায় গেল।
কিন্তু গান কি সমাজ বদলাতে পারে? যুদ্ধ থামাতে পারে? এই প্রশ্নটা দিয়েই এই কলামটা শুরু হয়েছিল। এখন উত্তরটা দেওয়ার সময় এসেছে। না, বদলাতে পারে না। কিন্তু সমাজ বদলানোর প্রচেষ্টা চিরকাল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সময়ের সরণিতে। বিপ্লবের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে রাখে গান। গান সম্ভাবনাময়, গান বার্তাবাহক। গান ছড়িয়ে পড়ে লোকের মুখে মুখে, লোকের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে সম্ভাবনার কথা, লোক থেকে লোকান্তরে ছড়িয়ে পড়ে লড়াইয়ের খবর।
প্রতিটি প্রজন্ম যুদ্ধ দেখেছে, আমি দেখেছি ভারত-চিন যুদ্ধ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। আমার পরের প্রজন্ম দেখেছে কারগিলের যুদ্ধ, ইউক্রেনের যুদ্ধ, এখন প্রত্যক্ষ করছে প্যালেস্তাইনের গণহত্যা।
আমরা বুঝতে পারি যুদ্ধ চলছে, যুদ্ধ চলবে। কিন্তু কবে আমরা বুঝব? কবে আমরা যুদ্ধ বন্ধ করব?
…পড়ুন গানস অ্যান্ড রোজেজ-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১। বব ডিলানের এই গান ভবিষ্যৎবাণীর মতো নিদান দেয়– যুদ্ধ আসন্ন
রিয়েঙ্কা ইউক্রেনের স্থানীয় ফুটবল দল নাইভা-র হয়ে গলা ফাটাত মাঠে গিয়ে। যুদ্ধের সময় চার মাস রুশ সেনার অধীনে বন্দিত্ব এবং ছাড়া পেয়ে ফ্রন্টলাইনে রাইফেল নিয়ে থাকা। গত ২১ মে মাত্র ২১ ছোঁয়া রিয়েঙ্কা চলে যায় গানশটে! গ্যালারিতে সেই মুখ, টিফো– লেখা– ‘পিস হ্যাজ আ প্রাইস’।
যখন আমরা, তথা সকল ব্যতিক্রমী লিঙ্গ-যৌনমানস ঠিক করব কোন ধরনের স্বাধীন সিদ্ধান্ত আমরা নেব, কিংবা জড়বৎ বাঁচা থেকে নিজেদের বের করে নিয়ে এসে, অপরের সিদ্ধান্তকে নিজের বলে প্রচার করা বন্ধ করব, তখন-ই আমাদের এই জড়বৎ অস্তিত্ব, অপরের শর্তে তৈরি করা জগৎ থেকে মুক্ত পাব।