সত্যি কথা হল, ভিক্তর লিদিও হারা মারতিনেজ তাঁর জীবনসঙ্গিনী, নৃত্যশিল্পী জোয়ান হারা-কে এই চিঠি লেখেননি। লিখতে পারেননি। কারণ ১৯৭৩-এর ১১ সেপ্টেম্বরেই ইউনিভার্সিটি থেকে আরও অনেকের সঙ্গে অতিপরিচিত মুখ ভিক্তরকে গ্রেফতার করে চিলে স্টেডিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানেই ১৬ তারিখ তাঁকে হত্যা করা হয়।
“জোয়ান! মিলিটারি সান্তিয়াগোর মধ্যিখানটা পুরো সিল করে দিয়েছে! আমি কোনওক্রমে আভিনাদো মাত্তা ধরে হাঁটছি। আমাকে খুব তাড়াতাড়ি টেকনিক্যাল ইউনির্ভাসিটি পৌঁছতে হবে, খুব তাড়াতাড়ি। প্রেসিডেন্ট আলেন্দের শুরুতে বলার কথা। মনে হচ্ছে আজকেই গণভোটের সিদ্ধান্ত হবে। এদিকে রাস্তায় রাস্তায় ট্যাংক ঘুরছে দেখছি! এ-গলি সে-গলি দিয়ে গুলিগোলা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে কোনওক্রমে হাঁটছি। মেশিনগানের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ বাড়ি থেকে? এক্ষুনি কানে এল যে মোনেদা প্যালেসে বম্বিং হয়েছে! প্রেসিডেন্ট কোথায় কে জানে! উফফ্! এই ইউনিভার্সিটিটাও সেই কোন চুলোর প্রান্তে!
–––––––––
জোয়ান! প্রিয়তমা! ওই এগারো তারিখের পর থেকে তোমার সঙ্গে আমার আর কথা হয়নি। হবে কী করে? ওই এগারোতেই তো ইউনিভার্সিটি থেকে আর সবার সঙ্গে আমাকেও মিলিটারি গ্রেফতার করেছে! আমাদের প্রত্যেককে নিয়ে কোথায় রেখেছে, জানো তুমি? চিলে স্টেডিয়ামের ভেতরে, আমার সঙ্গে আরও কম করে হলেও হাজার পাঁচেক, আর সব মিলিয়ে চল্লিশ হাজার মানুষ এখানে বন্দি। সাংঘাতিক পরিস্থিতি! এখানে বসেই শুনলাম, ওই এগারো তারিখ রাতেই না কি প্রেসিডেন্ট তাঁর ভবনে আত্মহত্যা করেছেন! বিশ্বাস করো তুমি? আমি করি না। ওঁকে মিলিটারিই মেরে ফেলে এসব গল্প সাজাচ্ছে। ভাবতে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি– অগাস্তো পিনোশের মতো একটা ছিঁচকে মিলিটারি অফিসার একটা ক্যু দে’তা ঘটিয়ে এত সহজে আমাদের নির্বাচিত পপ্যুলার ইউনিটি সরকারকে উচ্ছেদ করে দিল! নিক্সন আর হেনরি কিসিঙ্গারের মাথা আর সিআইএ-র সরাসরি মদত ছাড়া এটা সম্ভব, তুমিই বলো? বিস্ফারিত চোখে শুনতে পাচ্ছি, আমাদের সোশ্যালিস্ট পার্টি কোনও প্রতিরোধই না কি গড়ে তুলতে পারেনি, একতরফা মার খেয়ে শেষ হয়ে গেছে! সান্তিয়াগোর রাস্তায় আর মোনেদা প্যালেসের চারপাশে শুনলাম যেটুকু প্রতিরোধ, তা না কি চালিয়ে গেছে শুধু প্রেসিডেন্ট প্যালেসের গ্যাপ স্নাইপার আর ওই এমআইআর-এর গেরিলারা। আমরা কি এতটাই শক্তিহীন ছিলাম, বলো তুমি? অথবা আমাদের নেতা সালভাদোর আলেন্দের এই নির্বাচনে জিতে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রে পৌঁছনোর রাস্তাটাই ভুল ছিল? সমাজতন্ত্রের শত্রুরা যে শান্ত, সহিষ্ণু, অহিংস নয়, তা কি আমরা ভুলে বসেছিলাম? মনে পড়ে, এই তো ক’দিন আগে… এমআইআর দলের এক বন্ধু আমাকে বলেছিল– নতুন সমাজের প্রসবকালে রক্তপাত এক অনিবার্য সত্য, এটা অস্বীকার করার মানে ভাবের ঘরে চুরি করা– আমি, আমরা তাকে, তাদের ‘অতি-বাম’ বলে গাল পেড়েছিলাম। আজকে, এস্তাদিও চিলে-র এই মৃত্যুশিবিরে বসে মনে হচ্ছে, তারাই বোধহয় কোথাও ঠিক ছিল। আমরা শ্রমিকশ্রেণির জন্য একটা মুক্ত দেশ গড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু শ্রমিকশ্রেণিকে বলিনি, এটা তাদেরই লড়াই। তাই এগারোর রাত্তিরে চিলে-র কোথাও শ্রমিকরা ব্যারিকেড গড়তে বেরিয়ে আসেনি ঘর ছেড়ে! জোয়ান আমার! সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে কেমন…! এর শেষ কোথায়, তুমি জানো? নেরুদা কোথায় জানো কি? আমাদের পাবলো নেরুদা?
গতকাল রাতে কয়েকজন ছাত্র অন্ধকারের মধ্যে গুঁড়ি মেরে আমার গা ঘেঁষে এসেছিল। আমাকে তারা বলেছিল– তুমি ভিক্তর হারা, তোমার লেখা পড়ে, তোমার নাটক দেখে, তোমার লেখা গান গেয়ে আমরা মুক্ত চিলে-র স্বপ্নকে জিইয়ে রাখতে শিখেছিলাম। আজকে তুমি নীরব কেন? কিছু লেখো, কিছু গাও, কিছু শোনাও আমাদের। আমি ওদের থেকে এক টুকরো কাগজ জোগাড় করেছি, একটা ভোঁতা কলমও। ওই ময়লা কাগজে নিব ঘষে ঘষে আমি একটা কবিতা লিখেছি আজ বিকেলে। জোয়ান আমার, জোয়ান! এটাই সম্ভবত আমার শেষ কবিতা।
এস্তাদিও চিলে
আমরা হাজার পাঁচেক মানুষ এখানে,
শহরের এই এক চিলতেয়।
পাঁচহাজার মানুষ।
সব মিলিয়ে মোট কতজন সারা শহরে
আর সারা দেশ জুড়ে, কে জানে!
আমরা এখানে, দশহাজারটা হাত
যে হাতগুলো বীজ বোনে আর
কারখানাগুলো চালু রাখে।
মানবতা এখানে খিদেয়, শীতে, যন্ত্রণায় কাঁপছে।
ছ’জন হারিয়ে গেছে নক্ষত্রের নীলে।
…দশহাজার অক্ষম হাত?
সারা দেশে আমরা কতজন?
আমাদের নেতার রক্ত কি বোমা আর বন্দুকের চেয়ে
জোরে আমাদের হাতে শিরায় স্পন্দিত হচ্ছে না?
গান! কী কঠিন যে তোমাকে গাওয়া–ভয়ে ভয়ে, সংকোচে!
ভয়! যাতে বেঁচেছি, মরেছিও যাতে।
ভয়ের মাঝখানে নিজেকে দেখতে পেয়ে,
শেষ না হতে চাওয়া কালরাত্তিরে নিজেকে দেখতে পেয়ে
এই নীরবতা আর কান্না গানের লক্ষ্য হয়েছে আজ।
এভাবে দেখিনি কখনও। এভাবে বুঝিনি।
আজ প্রতি পলে দেখছি, বুঝছি যে
প্রতিটি পল বিস্ফোরণের ইচ্ছায় উন্মুখ।”
সত্যি কথা হল, ভিক্তর লিদিও হারা মারতিনেজ তাঁর জীবনসঙ্গিনী, নৃত্যশিল্পী জোয়ান হারা-কে এই চিঠি লেখেননি। লিখতে পারেননি। কারণ ১৯৭৩-এর ১১ সেপ্টেম্বরেই ইউনিভার্সিটি থেকে আরও অনেকের সঙ্গে অতিপরিচিত মুখ ভিক্তরকে গ্রেফতার করে চিলে স্টেডিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানেই ১৬ তারিখ তাঁকে হত্যা করা হয়। মেরে ফেলার পর তাঁর দেহ সহ-বন্দিদের দেখানোর জন্য স্টেডিয়াম গেটে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল, পরে তা বাইরে অনেক লাশের গাদায় ফেলে দেওয়া হয়। সেখানে একজন সরকারি অফিসার ভিক্তরকে চিনতে পেরে জোয়ানকে খবর দেন। বস্তুত জোয়ানই পরে ভিক্তরের অন্য সহ-বন্দিদের মুখের টুকরো টুকরো কথাকে গেঁথে পুরো ঘটনাটি পৃথিবীর সামনে উপস্থাপিত করেছিলেন।
এস্তাদিও চিলে (চিলে স্টেডিয়াম) কবিতাটিই ভিক্তরের শেষ রচনা। এটি লেখার দু’ঘণ্টার মধ্যেই তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। তাঁর মৃতদেহ খচিত ছিল চল্লিশটি বুলেটের ক্ষতে! সে সময়ে চিলের জনবন্দিত এই গীতিকার, কবি, নাট্যকার, গায়কের বয়স ছিল ঠিক ৪০ বছর।
চিলে স্টেডিয়ামের এখনকার নাম এস্তাদিও ভিক্তর হারা।
….আরও পড়ুন কবি ও বধ্যভূমি….
প্রথম পর্ব: বিপ্লব, প্রেম ও কবিতাকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন দ্রোণাচার্য ঘোষ