প্রতি রবিবার, ‘ইতি কলেজ স্ট্রিট’ প্রকাশিত হয় রোববার.ইন-এ। কলেজ স্ট্রিট, পুরনো কলকাতা, লেখক-প্রকাশকের চিঠি, প্রকাশকের চোখে দুরন্ত এক প্রকাশনা গড়ে তোলার স্বপ্ন– সব মিলিয়ে এই কলাম যেন এক মায়াবি ট্রাম, যা লেখকদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াত করছে অনবরত। তাঁদের বসাচ্ছে, গল্প করছে, স্মৃতি ছেনে বের করছে, আবার ফিরিয়ে দিচ্ছে পুরনো গন্তব্যে, নতুন করে। এই ট্রামের টিকিট, লেখক-প্রকাশকের মধ্যকার চিঠি। ট্রামচালক অবশ্যই সুধাংশুশেখর দে, ট্রামলাইন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়– যাঁর লিখনে এই কলাম তাড়াহুড়োহীনভাবে দিব্যি চলছে। একজন পাঠক, আন্তর্জালে লেখা পড়ে, হাতে-লেখা চিঠি পাঠাবেন, এ আমাদের কাছে বিস্ময়! তাই এই চিঠি সমস্ত পাঠকের, লেখকের হয়ে রইল।
শ্রদ্ধাস্পদেষু
সুধাংশুবাবু,
আপনার ‘ইতি কলেজ স্ট্রিট’ ধারাবাহিকটি ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর রোববার.ইন-এ পড়ে আমি যৎপরোনাস্তি মুগ্ধ। যেহেতু ভিতর থেকে একপ্রকার তাড়নায় আপনাকে আমার মতো এক নগণ্য ব্যক্তির এই পত্রলেখা।
উক্ত স্মৃতিকথাটি পড়তে পড়তে ৮-এর দশকের একেবারে শেষদিকে আরেক যশস্বী সাহিত্যিক বিমল কর মহাশয়ের ‘উড়ো খই’-এর কথা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল। এটিকেও বিমলবাবু তাঁর আত্মজীবনী নয়, স্মৃতিকথা হিসাবেই গ্রহণ করতে বলেছেন। যাই হোক, কত বছর পর, সেই ১৯৮৮-’৮৯ থেকে ২০২৪– সুদীর্ঘ দিন বাদে আপনার ‘ইতি কলেজ স্ট্রিট’ পড়তে পড়তে আরও একবার সেই অনুভূতি, সেই আবেগ, সেই সম উত্তেজনা পরতে পরতে অনুভূত হচ্ছে! আমার কাছে একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার স্মৃতি সরণি হচ্ছে এই ‘ইতি কলেজ স্ট্রিট’। যা অন্য প্রকাশকদের কাছেও এক দৃষ্টান্ত বলে আমি মনে করি। ফেলে আসা জীবনের যে সময় আজ অতীত, সেই বিগত কাল, তৎকালীন সামাজিক পরিবেশ, আর সেই পরিবেশের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বেশ কিছু সৎ-লড়াকু মানুষ, স্বনামধন্য কবি-সাহিত্যিকদের যে জয়গাথা আপনি শুনিয়েছেন এই অনবদ্য স্মৃতিকথায়, তাঁর জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
এই স্মৃতিকথা পড়তে পড়তে, বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে কেবল ভাবছি– একদা এমন সব সহজ-সরল-ভালো মানুষের দল আমাদের চারপাশে ছিলেন! যাঁদের দু’চোখে ছিল স্বপ্ন আর মনে ছিল অসম্ভব মানসিক জোর। আজ তাঁদের অনেকেই আর নেই। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যে দাগ রেখে গেছেন, তা চিরস্থায়ী। জীবন ছেনে তখনকার কিছু খণ্ডচিত্র যেভাবে এখানে গ্রথিত হয়েছে, যা আরও একবার ‘উড়ো খই’-এর কথা আমার স্মরণ করিয়ে দিল।
সেই সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেয়, সাহিত্যম থেকে প্রকাশিত বুদ্ধদেব গুহ’র ‘সারস্বত’-এ লেখা আপনার অল্প বয়সের বেশ কিছু কথা। যেটা ছিল দু’চোখে বড় প্রকাশক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর এক কিশোরের সলতে পাকানোর কঠিন সময়। যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ১৩৯ থেকে ১৪২। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ‘ইতি কলেজ স্ট্রিট’ পড়তে গিয়ে ১৮তম সংখ্যায় (সংখ্যা হিসেবে হয়তো ভুল হতে পারে) সেই কথা পড়তে গিয়ে আরও একবার শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ’র ‘সারস্বত’-এর কথাও মনে পড়ে গেল।
……………………………
এই স্মৃতিকথা পড়তে পড়তে, বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে কেবল ভাবছি– একদা এমন সব সহজ-সরল-ভালো মানুষের দল আমাদের চারপাশে ছিলেন! যাঁদের দু’চোখে ছিল স্বপ্ন আর মনে ছিল অসম্ভব মানসিক জোর। আজ তাঁদের অনেকেই আর নেই। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যে দাগ রেখে গেছেন, তা চিরস্থায়ী। জীবন ছেনে তখনকার কিছু খণ্ডচিত্র যেভাবে এখানে গ্রথিত হয়েছে, যা আরও একবার ‘উড়ো খই’-এর কথা আমার স্মরণ করিয়ে দিল।
…………………………
মনে পড়ে গেল আপনার ছোট ভাই, যাঁকে সবাই ‘বাবু’ বলে ডাকেন। আপনার ‘ইতি কলেজ স্ট্রিট’ পড়ে তাঁর সম্পর্কে দু’টি কথা জানলাম। প্রথমত, তাঁর ভালো নাম– সুভাষ। দ্বিতীয়ত, তিনি বইয়ের এনসাইক্লোপিডিয়া– সত্যিই তাই! আমি মানি। আমিই তা চাক্ষুষ প্রমাণ। একবার বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে কিছু রেফারেন্স দরকার হয়ে পড়ল। দে’জ-এ গিয়ে মঞ্জুশ্রী ঘোষের ‘বঙ্গ মিথিলার-বিভূতিভূষণ’ বইটি খোঁজ করতেই এক কর্মী ইতি-উতি দেখে বললেন বইটি নেই। সেই সময় বাবুদা শুনতে পেয়েই বললেন, ওদিকে অমুক জায়গায় দেখ। বললে বিশ্বাস হবে না, মিনিট তিনেক-এর মধ্যেই আমার আকাঙ্ক্ষিত বইটি আমার হাতের মুঠোয় চলে এল! সেদিন তিনি কাউন্টারে না থাকলে ভগ্ন-মনোরথ হয়েই ফিরতে হত। হয়তো বাবুদার এমন মগজাস্ত্র ম্যাজিক অনেকের সঙ্গেই হয়েছে। তাঁরা মুখ কালো নয়, আলো করেই দে’জ দপ্তর থেকে প্রিয় বইটি হাতে নিয়েই বাড়ি ফিরেছেন।
এই পত্র এখানেই শেষ করি। আপনার স্মৃতিকথা পড়তে পড়তে মনের কোণে বেশ কিছু কথা মেঘ হয়ে জমেছিল। যা এই পত্র মারফত বলতে পেরে বৃষ্টির ন্যায় ধুয়ে গেল। যদি এই পত্রে কোথাও বিন্দুমাত্র বাচালতা হয়ে থাকে, ক্ষমা করে দেবেন। আপনি ব্যস্ত মানুষ, জানি না, অধমের দেওয়া এই পত্র পড়ার সময় আপনার হবে কি না। ভাল থাকবেন।
ধন্যবাদান্তে,
তারকেশ্বর বিশ্বাস
উদয়রাজপুর, মধ্যমগ্রাম
কলকাতা ৭০০১২৯
…পড়ে নিন ইতি কলেজ স্ট্রিট-এর প্রকাশিত সবক’টি লেখা…
পর্ব ২১: ৩০০০ কপি বিক্রির মতো জীবিত বা মৃত লেখক আর হয়তো নেই
পর্ব ২০: কম বয়সে আমাদের রোববারের আড্ডা ছিল ২৮ নম্বর প্রতাপাদিত্য রোড, আশুদার বাড়িতে
পর্ব ১৯: ‘লেখা বড় হচ্ছে’ অভিযোগ আসায় খুদে হাতের লেখায় পাণ্ডুলিপি দিতেন প্রবোধবন্ধু অধিকারী
পর্ব ১৮: দু’বছরের মধ্যে সংস্করণ না ফুরলে অন্য জায়গায় বই ছাপার চুক্তি ছিল শরদিন্দুর চিঠিতে
পর্ব ১৭: পূর্ণেন্দু পত্রীর বাদ পড়া প্রচ্ছদ ও দিনেশ দাসের কবিতার শ্রেষ্ঠ দিনগুলি
পর্ব ১৬: সব প্রকাশনার যাবতীয় বইয়ের হদিশ পাওয়া যেত ‘সম্মিলিত গ্রন্থপঞ্জী’তে
পর্ব ১৫: নিছকই একটা পত্রিকা নয়, ‘কলেজ স্ট্রীট’ আমাদের আবেগ
পর্ব ১৪: খুদে পাঠকদের জন্য মিনিবই তৈরির কথা প্রথম ভেবেছিলেন অভয়দা
পর্ব ১৩: কয়েকটি প্রেসের গল্প
পর্ব ১২: দীর্ঘায়ু বই ও আইয়ুব পরিবার
পর্ব ১১: প্রেমের নয়, অপ্রেমের গল্প সংকলনের সম্পাদনা করেছিলেন সুনীল জানা
পর্ব ১০: ছোট্ট অপুকে দেখেই রঙিন ছবিতে ভরা টানটান গল্পের বই করার ইচ্ছে জেগেছিল
পর্ব ৯: চানঘরে গান-এ সত্যজিৎ রায়ের চিঠি থাকায় ব্যাপারটা গড়িয়েছিল কোর্ট কেস পর্যন্ত
পর্ব ৮: প্রকাশক-লেখকের কেজো সম্পর্কে বুদ্ধদেব গুহর বিশ্বাস ছিল না
পর্ব ৭: পুজো সংখ্যায় না-বেরনো উপন্যাস বই আকারে সুপারহিট
পর্ব ৬: মানবদার বিপুল অনুবাদের কাজ দেখেই শিশির দাশ তাঁর নাম দিয়েছিলেন– ‘অনুবাদেন্দ্র’
পর্ব ৫: সাতবার প্রুফ দেখার পর বুদ্ধদেব বসু রাজি হয়েছিলেন বই ছাপানোয়!
পর্ব ৪: লেখকদের বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছুই লিখতে হয়, প্রফুল্ল রায়কে বলেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র
পর্ব ৩: পয়লা বৈশাখের খাতায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় মজাচ্ছলে লিখেছিলেন, ‘সুধাংশুরা রাজা হোক’
পর্ব ২: বাংলা মাসের সাত তারিখকে বলা হত ‘গ্রন্থতিথি’, বিজ্ঞাপনেও বিখ্যাত ছিল ‘৭-ই’
পর্ব ১: সত্তরের উথাল-পাথাল রাজনৈতিক আবহাওয়ায় আমি প্রকাশনার স্বপ্ন দেখছিলাম