বাবা কিংবা একজন অভিনেতাকে, পিতৃসম যে অভিনেতারা সেই সময় টিনের বাক্সের ওপরে বসে সাজতেন, তাদের দেখে আমার মনে হত এঁরা সব জীবন-পটুয়া। এঁরা জীবন আঁকছেন মুখে। জীবনযাপন করা বেশ কিছু লোক মাটির ওপর বসে, চটের ওপর বসে, শীতের রাত্রে, হিম হিম ভিজে ভিজে ভাব নিয়ে, তাঁরা তাঁদের নিজস্ব সত্তা, নিজস্ব মান-অভিমানকে আবিষ্কার করবেন এই জীবন-পটের মধ্য দিয়ে।
আমরা যে সময়ে বেড়ে উঠছি, তখন আমাদের বন্ধুবান্ধব, আমাদের সহপাঠী, তাদের বাবারা কেউ-ই অভিনেতা বা অভিনেত্রী ছিলেন না। ‘তোমার বাবা কী করেন? তুমি কোথায় থাকো?’ এইসব প্রশ্নের উত্তরে বলতাম, ‘আমার বাড়ি ২৭ নম্বর জীবনকৃষ্ণ মিত্র রোড, কলকাতা-৭০০০৩৭, আমরা চার ভাই, এক বোন, আমার মা গৃহবধূ, আমার বাবা অভিনেতা’। যে-ই এটা বলতাম, দেখতাম সবাই নড়েচড়ে বসত।
অচেনা মানুষ হঠাৎ খুব আগ্রহী হয়ে পড়তো অথবা অবাক হয়ে যেত। ‘আচ্ছা, তা কোথায় করেন’, ‘কীসের পাঠ’, ‘আচ্ছা, উনি কি বাইরে থাকেন’, ‘আচ্ছা, উনি কী সাজেন’, ‘তুমি শিখেছ’, ‘তুমি কি বাবার লাইনে যাবে’– এইসব নানানরকম প্রশ্ন আসতে থাকত। কিন্তু এতদসত্ত্বেও আমার মনে হত, আমার বাবা যে কাজটি করছেন, সেই কাজটির মধ্যে অন্যের চোখে নিজেকে দেখা রয়েছে। মনে হত, দেখতেই যদি হয় নিজেকে, যখন নিজে নিজেকে দেখতেই পাব না, তখন অনেক মানুষের চোখে নিজেকে দেখি। জোড়া জোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে, আমাকে বুঝে নেবে, আমার শরীরের মধ্যে, আমার মনের মধ্যে, আমার ত্বকের মধ্যে, আমার শিরা-উপশিরার মধ্যে প্রবাহমান যে সংলাপ, উচ্চারিত-অনুচ্চারিত, দৃশ্যমান-অদৃশ্য– সেইগুলি তারা আবিষ্কার করবে এবং তারা সেইগুলি আমাকে জানান দেবে। একই রকম, একই আসরে বসে একজন মানুষকে অনেক রকমভাবে দেখবে। কেউ দেখবে প্রেমিক হিসেবে, কেউ দেখবে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে, কেউ দেখবে বেইমান হিসেবে, কেউ দেখবে উদাসীন হিসেবে, কেউ দেখবে স্বার্থপর হিসেবে, কেউ দেখবে মরিয়া হিসেবে। একটা ঘটনার মধ্যে যে এতরকম ভাবে নিজেকে চিনে ফেলার যে ঘটনা বা যে বিস্ফোরণ, এটা আর কোথায় হতে পারে? এইটা আমাকে দারুণ মুগ্ধ করত।
আমার মনে হত, বাবা আসলে শুধু অভিনয়ই করছেন না। আরও একটা কাজ উনি করে চলেছেন আড়ালে। সামাজিক স্থিতি অনুযায়ী বা সমাজের চাহিদা অনুযায়ী যে কাজগুলো নির্দিষ্ট হয়ে আছে তাঁর জন্য, তা আমি জানি না, কিন্তু আমি জানি ওই যে আয়নার সামনে তাকিয়ে থাকা একটা মুখ, কে কাকে আঁকছে জানি না, কিন্তু নিজেকে দেখতে চেয়েও দেখতে না পাওয়ার যে আক্ষেপ, যে অসম্পূর্ণতা, সেইটাকে উনি সম্পূর্ণ করে তুলছেন এইভাবে। আহা! এ একটা দারুণ জীবন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
জন্মের পর হয়তো প্রথম যে রঙিন জায়গাটিতে গিয়ে পৌঁছলাম, সেটা হল কোনও যাত্রার আসর। তারপরে সিনেমা দেখেছি, নাটকও দেখেছি অনেক। কিন্তু নাট্যকারের সংলাপ ধার করে বলতে পারি– ময়ূর পালকের মতো বিচিত্র সব আসরে, ওই চন্দ্রাতপের নিচে গিয়ে দাঁড়ানো, চরিত্র সেজে দাঁড়ানো– এ একটা অদ্ভুত ব্যাপার। এই যে, ময়ূর পালকের মতো বিচিত্র সব আসরে চরিত্র সেজে দাঁড়ানো– তার মানে একটা রঙিন, ঝলমলে, অদ্ভুত রংদার হাতছানিতে সাড়া না দিয়ে উপায় নেই, তাতে যেতেই হয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
যখন বড় হচ্ছি, ওই কথাগুলো সাজাতে পারছি মনের ভিতরে, তখন বাবাকে দেখে মনে হত, বাবা কিংবা একজন অভিনেতাকে, পিতৃসম যে অভিনেতারা সেই সময় টিনের বাক্সের ওপরে বসে সাজতেন, তাদের দেখে আমার মনে হত এঁরা সব জীবন-পটুয়া। এঁরা জীবন আঁকছেন মুখে। জীবনযাপন করা বেশ কিছু লোক মাটির ওপর বসে, চটের ওপর বসে, শীতের রাত্রে, হিম হিম ভিজে ভিজে ভাব নিয়ে, তাঁরা তাঁদের নিজস্ব সত্তা, নিজস্ব মান-অভিমানকে আবিষ্কার করবেন এই জীবন-পটের মধ্য দিয়ে। জীবনে জীবনে ধাক্কাধাক্কি লাগবে, তার যাপন, এই গল্পের যাপনের সঙ্গে মিলেমিশে কোথাও চকমকি পাথরের মতো জ্বলে উঠবে বা কোথাও জ্বালাতে চেয়েও ব্যর্থ হবে। কোথাও আক্ষেপ করবে ওই সামনে বসে থাকা দর্শক। যে আহা! উনি তো পারলেন, আমি কেন পারব না। আমাকেও পারতে হবে। কাল পারিনি, পরশু পারব অথবা এ কীরকম বিপথগামী হল! আমি ওই পথে কোনও দিন যাব না, কখনও না, কিছুতেই না, ঈশ্বরের দিব্যি আমি যাব না। এই যে কথোপকথন, এই যে আঁকা একটা জলরঙের মতো, তেলরঙের মতো মিলিমিশে সব কিছুর সঙ্গে লেপ্টে গিয়ে একটা অবয়ব তৈরি করা এবং তা একমাত্রিক থেকে বহুমাত্রিক হয়ে যাওয়া।
এ একটা অদ্ভুত ঘটনা। অভিনয়। তা যে মাধ্যমেই হোক না কেন। আমি যে অমোঘভাবে এরমধ্যে এসে পড়লাম, এসে পড়তে না চেয়েও পড়লাম, এটাও একটা পর্বের মতো। আমি অনেকরকম ভাবে ভেবেছি যে, এই কাজটা করব না, আরও ওই রকম কাজ আছে। জীবন দেখার, জীবন যাপনের বা জীবন-পটুয়া হওয়ার আরও অনেক শিল্পমাধ্যম আছে। হতে পারে আমি তার কোনও একটাতে যেতে পারি। কিন্তু এই যে অভিনয়, এইটা কিন্তু আমার ভিতরে তাঁবু খাটিয়ে সে নিজের মতো করে বসেছিল। বসেছিল তার কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে আবারও মনে পড়ে আমি জন্মইস্তক দেখছি আমার বাবা অভিনেতা। জন্মের পর হয়তো প্রথম যে রঙিন জায়গাটিতে গিয়ে পৌঁছলাম, সেটা হল কোনও যাত্রার আসর। তারপরে সিনেমা দেখেছি, নাটকও দেখেছি অনেক। কিন্তু নাট্যকারের সংলাপ ধার করে বলতে পারি– ময়ূর পালকের মতো বিচিত্র সব আসরে, ওই চন্দ্রাতপের নিচে গিয়ে দাঁড়ানো, চরিত্র সেজে দাঁড়ানো– এ একটা অদ্ভুত ব্যাপার। এই যে, ময়ূর পালকের মতো বিচিত্র সব আসরে চরিত্র সেজে দাঁড়ানো– তার মানে একটা রঙিন, ঝলমলে, অদ্ভুত রংদার হাতছানিতে সাড়া না দিয়ে উপায় নেই, তাতে যেতেই হয়।
গোড়ার কারণটা হয়তো, আমার জমিতে একটা তাঁবু খাটানোই ছিল, আর হয়তো একটা বাঁশ। তিনটি বাঁশের মধ্যে একটা বাঁশ আমি পুঁতেছি, একটি আমার পিতৃদেব বা আমার পূর্বপুরুষ পুঁতেছেন। আর একটি পুঁতেছেন অগণিত দর্শক, যাঁরা দ্যাখেন, যাঁরা আসেন কষ্ট করে, জীবন্ত মানুষের কারবার দেখতে। চোখের সামনে একটা মানুষ বেঁচে আছে, সে অভিনয় করছে, তার কথা আমি শুনতে পারছি, আমি যদি চিৎকার করি, সে-ও আমার কথা শুনতে পাবে। এখানে কোনও মায়ার বন্দোবস্ত নেই। যা নাকি অন্য শিল্পমাধ্যমে থাকে। ও যদি অসুস্থ হয়, আমার চোখের সামনে দুম করে মরে পড়ে যাবে, আমি চোখের সামনে দেখতে পাব। আমি যদি অসুস্থ হই, নাটক বন্ধ হয়ে যাবে। এখানে একটা গোলযোগ শুরু হবে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও বন্ধ হবে। ওই অভিনেতা জানবে যে, একজন কেউ কষ্ট পাচ্ছে, ওই অভিনেতা কষ্ট পেলেও আমি অনেক সময় জানতে পারি বা পারব, এই যে দেওয়া-নেওয়া, এই যে অন্যের চোখের মধ্য দিয়ে নিজের চোখের নিচে একটা কালো অঞ্জন পরানো, এই যে অন্যের চোখে দেখে নিজেকে রাঙিয়ে তোলা– এইটা তো পটুয়ার কাজ, তাকে নাটুয়া বা নাটুবাবুও বলা যেতে পারে।
…পড়ুন নাটুয়া-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১। বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved