কিছু কিছু পুরনো প্রথা, পুরনো খেলা প্রায় শেষ হয়ে এল– যেমন ঘুড়ি ওড়ানো, ডাংগুলি খেলা, গুলি খেলা, লাট্টু ঘোরানো, বিজয়া করতে যাওয়া, সিদ্ধি খাওয়া, রোয়াকের আড্ডা– এরকম কত কী। কিন্তু ‘হোলি হ্যায়’ তো উঠলই না, বরং বছরে বছরে বাড়ছে। আগে ছেলেদের মুখে হোলির চিহ্ন পরদিনই মুছে যেত, মেয়েদের মুখে দু’-একদিন থেকে যেত। এখন দেখি হোলির দু’-দিন আগে থেকেই ছেলেমেয়েদের মুখে রং ছোপ! দু’দিন পরেও থেকে যায়। মেয়েদের চুলও রঙিন। আগে সাদা চুল কালো করার জন্য চুলে কলপ করত। পুরুষেরাই এটা বেশি করত। এখন কালো চুল সাদা করে। মেয়েরাই বেশি করে। শুধু সাদাই নয় অবিশ্যি, নানারকম রং করে।
৪.
দোল উৎসব বা বসন্ত উৎসব কিংবা হোলি যাই বলি না কেন, শব্দটা কানে এলে চোখে যে ছবিটা ভেসে ওঠে সেটা হল রং। নানা রকমের রং। যাঁরা গাঁয়ের দিকে থাকেন, তাঁরা এই সময় চারিধারে নানারকমের রং দেখতে পান– যেটা প্রকৃতির রংবাজি। নতুন পাতা বেরোয় অনেক গাছে। কোনও কোনও পাতা প্রথমে ম্যাজিক ম্যাজিক ম্যাজেন্টা। পরে আস্তে আস্তে সবুজ হয়ে যায়। যেমন নিমপাতা, জামপাতা, খলিশ পাতা। সবুজের কত রকমের শেড।
শিমুলের লাল, অশোকের লাল আলাদা। পলাশ কত রকমের। শহরেও দেখি কংক্রিট ফাটিয়ে এক একটা গাছ সারাটা গা ফুলের গয়নায় ভরিয়ে হা-হা হাসছে। দু’দণ্ড থমকাই। মনের ভিতরে কিছু একটা তা তা থই থই হয়। বিশ্বজুড়েই তো দেখি প্রকৃতির নতুন সাজ আর সমাজ কেমন মিশে যাকে। শীতকে ঝেড়ে ফেলে বসন্ত এলে পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজ নিজের মতো করে বসন্ত বরণ করে। জাপানে চেরিফুল পাগলের মতো ফোটে, ওরা করে হানামি উৎসব। মানভূম অঞ্চলে বাহা পরব। ইরানে নওরোজ, থাইল্যান্ডে সংক্রান। এই উৎসবে এ ওর গায়ে জল ছেটায়। মেস্কিকোতে ফুলে পাপড়ি ছেটায়, চিনে রঙিন কাগজের কুচি, ইতালিতে টমেটো। আমরা রং ছেটাই। আগের রাত্তিরে ইয়াবড় একখানা দুষ্টু মিষ্টি চাঁদ ওঠে, দখিন থেকে হাওয়া দেয় হালকা হালকা, আম-বকুলের গন্ধ ছাড়ে, আমাদের সমস্ত লেন বাইলেন, সমস্ত ওয়ার্ডগুলোর গাছগুলোতেও কেমন যেন বউদি বউদি ভাব। আমরা সবাই প্রশ্রয় পাওয়া দেওর। আমাদের ভিতরে প্রভূত রবি ঘোষ জন্ম নেয় যে বলে– মাসিমা মালপোয়া খামু।
এমন একটা অবস্থার ভিতরে হেলির পরব আসে রাধা-কৃষ্ণর গল্পটা ঝোলায় ভরে নিয়ে।
বাঁকুড়া জেলায় কোনও এক গ্রামে হোলি লীলার পালা শুনেছিলাম-অনেকটা এরকম।
কৃষ্ণ॥ সুবলসখা, ও সখা গো, রাধার কাছে যিতে আমার শরম লাগে দমে। উ বেটিট গোরা বটেক। দুধের লেগে মিসমিনি আলতা। ঠোঁট দুটা পাকা করমচা আর আমার দিকে চেয়ে দেখ, কালো রং, ঠোঁট দুটা পোড়া আংরা।
সুবল॥ ছি ছি ছি আমার কিষ্টো সখা। কেমন করে এমন ধারা ভাবতে পাইল্লে। আমি ললিতা বিশাখাকে বলছি গিয়ে।
কৃষ্ণ গালে হাত দিয়ে বসে রইল। একটু পরেই সুবল সখা এসে বলল–
সুবল॥ শ্রীরাধা কী বলেছে শুনবে সাঙ্গাত? সে বলেছে কৃষ্ণর যদি এমন মনে হয় সে কালো আর আমি ধলা বটি, তবে যেন সে যে রঙে খুশি হামাকে রং লাগিয়ে দেয়। যেমন উর মন চায়। কালো কইল্লে কালো, আমার সেই ভালো। হলুদ যদি করে করে, হামারও মন ভরে। যদি করে লাল, হামি আনন্দে বেতাল।
………………………………
দোলের দিনের দুপুরগুলো মনে পড়ে। রং ছাড়াচ্ছে সব। ফুটপাথে চাপকল ছিল। ওখানে গঙ্গার জল আসত। ছেলেরা সব চাপাকলে। কেউ কেউ গঙ্গায়। সমস্ত কলতলাগুলো রঙিন। পরদিন পাড়ায় যারা বেরুচ্ছে, ওদের গলার কাছে রং লেগে আছে, কানের গর্তে রং। বাড়িগুলোর রেলিং, সিঁড়ি, সবকিছুতেই রঙের ছোপ। মিত্তির বাড়ির ম্যানেজার লোক লাগিয়ে শ্বেতপাথরের সাদা পরিটার গায়ে সোডার গুঁড়ো লাগিয়ে রং ছাড়াচ্ছে।
……………………………….
আমাদের কৈশোরে মনুদাকে দেখেছি, ওর উপর কেষ্টঠাকুর ভর করত। ও ছিল, খুব জনপ্রিয় দেওর। বউদিদের ম্যাটিনি শোয়ের টিকিট কেটে দিত। বউদিদের পোষা টিয়াপাখির জন্য লাল লাল লঙ্কা নিয়ে আসত আর হোলির দিন সব বউদিদের রং দিত। দাদাদের যে একেবারেই দিত না, এমন নয়। নারায়ণকে সিন্নি দিলে গণেশকেও একটা ডালা দিতে হয়। তবে রংবাজ ছিল কালুয়া। ও কাজ করতে। মোটর গ্যারেজে। ও ছিল রং বিশেষজ্ঞ। যেমন ঘুড়ির মাঞ্জা বিশেষজ্ঞ থাকে, যারা কাঁচের গুঁড়ো, ছোটদানার সাবু চিটেগুড় মিশিয়ে এক আশ্চর্য মাঞ্জা করত। কাচেরও আবার জাত বুঝত। বাল্ব ভাঙা কাচের ধার, বয়াম ভাঙা কাচের চেয়ে বেশি বলত। তেমন কেউ ছিল তুবড়ি বিশেষজ্ঞ। গন্ধক-সোরা-কাঠকয়লার কী ভাগ হবে, কোন কাঠের কয়লা ভালো, কোন গন্ধকে তেজ বেশি– এসব বলতে পারত। তেমন রং বিশেষজ্ঞও ছিল। পোড়া মবিলের সঙ্গে রং মিশিয়ে দু’-হাতে নিয়ে মুখে মাখিয়ে দাও, ব্যস সেঁটে গেল। কত সাবান ঘষবে ঘষো, গালের ছাল উঠে যাবে, কিন্তু রং উঠবে না। ও আবার গঁদের আঠা, তার্পিন তেলে অ্যালুমনিয়ামের গুঁড়ো মেশানো রং দিয়ে মুখে মাখার কায়দা বের করেছিল। মুখটা রুপালি হয়ে থাকবে। আবার বাদুরে রংও ছিল।
দোলের দিনের দুপুরগুলো মনে পড়ে। রং ছাড়াচ্ছে সব। ফুটপাথে চাপকল ছিল। ওখানে গঙ্গার জল আসত। ছেলেরা সব চাপাকলে। কেউ কেউ গঙ্গায়। সমস্ত কলতলাগুলো রঙিন। পরদিন পাড়ায় যারা বেরুচ্ছে, ওদের গলার কাছে রং লেগে আছে, কানের গর্তে রং। বাড়িগুলোর রেলিং, সিঁড়ি, সবকিছুতেই রঙের ছোপ। মিত্তির বাড়ির ম্যানেজার লোক লাগিয়ে শ্বেতপাথরের সাদা পরিটার গায়ে সোডার গুঁড়ো লাগিয়ে রং ছাড়াচ্ছে।
ফাল্গুনের দোলের পরেও কয়েকটা বিয়ের দিন থাকে। আমরা যে বাড়িতে ভাড়া ছিলাম, সে বাড়িতে বাবলুদার সঙ্গে জ্যোৎস্নাদির ইয়ে ছিল। কিন্তু জ্যোৎস্নাদি ওর বাবার অবাধ্য হয়ে বাবলুদাকে বিয়ে করেনি। বাবলুদা দোলের দিন কালুয়ার রং-ফরমুলায় এমন কালো রং জ্যোৎস্নাদির মুখে মাখিয়ে দিয়েছিল যে, বিয়ের দিনও কালচে ভাব যায়নি। বাবলুদা বলেছিল জ্যোৎস্নার বাপ আমার সঙ্গে রংবাজি করতে এসেছিল। দেখিয়ে দিয়েছি রংবাজি কাকে বলে।
কিছু কিছু পুরনো প্রথা, পুরনো খেলা প্রায় শেষ হয়ে এল– যেমন ঘুড়ি ওড়ানো, ডাংগুলি খেলা, গুলি খেলা, লাট্টু ঘোরানো, বিজয়া করতে যাওয়া, সিদ্ধি খাওয়া, রোয়াকের আড্ডা– এরকম কত কী। কিন্তু ‘হোলি হ্যায়’ তো উঠলই না, বরং বছরে বছরে বাড়ছে। আগে ছেলেদের মুখে হোলির চিহ্ন পরদিনই মুছে যেত, মেয়েদের মুখে দু’-একদিন থেকে যেত। এখন দেখি হোলির দু’-দিন আগে থেকেই ছেলেমেয়েদের মুখে রং ছোপ! দু’দিন পরেও থেকে যায়। মেয়েদের চুলও রঙিন। আগে সাদা চুল কালো করার জন্য চুলে কলপ করত। পুরুষেরাই এটা বেশি করত। এখন কালো চুল সাদা করে। মেয়েরাই বেশি করে। শুধু সাদাই নয় অবিশ্যি, নানারকম রং করে। পুরুষেরা দাড়ি রাঙায় অনেকেই। আগে মৌলভি-হুজুরদের দাড়ির রং দেখতাম খয়েরি খয়েরি। ওটা মেহেন্দির জন্য। কিন্তু রামধনু রঙের দাড়ি দেখেছেন? সত্যি সত্যি ভিবজিওর। বেগুনি থেকে লাল– সাতটা তো আছেই, সেই সঙ্গে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট! মুখে রং, মাথায় রং এখন রংবাজি।
রং খেলা হয়ে গেলে তড়িঘড়ি ওঠার কোনও সামাজিক তাড়া নেই। বিজয়া দশমীর বিকেলে সিঁদুর খেলার ধূম দেখেছেন? রমণীগন কেমন রাঙা হয়ে রঙ্গবতী হয়ে ওঠে। রঙের যে রাজনীতি হয় ছোটবেলায় বুঝতাম না। মাঝবয়সে এসে বুঝলাম কিছুটা। নির্বাচনের ফলাফল বের হলে যদি গাড়ি নিয়ে ঘোরেন, মানুষের মুখমণ্ডলে মাখানো বিজয়ধূলি, মানে আবিরের রং দেখেই বুঝে যাবেন কোন পার্টি জিতল। দু’-হাজার বারো (২০১২) সালে এক ডেকরেটার বলেছিল কী মুশকিলে পড়লাম জানেন, ছশো প্লাস্টিকের চেয়ার বেকার হয়ে গেল। লাল চেয়ারের ডিমান্ড ছিল বলে লাল চেয়ার স্টক করেছিলাম, সবাই সবুজ চাইছে। কিনতে হল সবুজ। আগেরগুলো কী যে করি! একটা ব্যাপার লক্ষ করেছেন নিশ্চয়ই, কালীপুজো আর মার্কস-লেলিন পুজোর উপাচারের একই রং হয়। লাল। অনেক কমরেডরা লাল টুপি পরে, কালী সাধকরাও লাল পাগড়ি বাঁধেন। কালীসাধকরা আর মার্কস সাধকরা লাল উত্তরীয় রাখেন গলায়। কিন্তু তীব্র বামবিরোধী এক কালীভক্ত এক ফুলওলাকে বলেছিল– খুঁজে পেতে কিছু সবুজ জবা এনো। ফুলওলা বলেছিল, সবুজ জবা তো ভগবান তৈরি করেননি এখনও, কোথায় পাব বলুন? কালীভক্ত বলেছিল, তাহলে সাদা তো আনতে পারো।
ফুলওয়ালারা তো ফুটপাথে বসে ফুল বেচে। যারা কাচের দরজাওলা ঘরে বসে ফুলের তোড়া বিক্রি করে, ওরাও বলত– লাল গোলাপের বোকে এখন বিক্রি হয় না ততটা। সবুজ গোলাপ হয় না বলে হলদে গোলাপের খুব ডিমান্ড হয়েছে এখন।
কিছুদিন আগে আমর এক সহপাঠী ফোন করল। বলল খুব মুশকিলে পড়ে গেছিরে। আমাদের হাউজিংয়ের সেক্রেটারি আমাকে জিজ্ঞাসা করল– গেরুয়া আলো দেবে এমন রংমশালের ফরমুলাটা লিখে রাখবেন তো, দরকার আছে। যেহেতু কেমিস্ট্রি পড়াই, যেন এসব আমি জানি। গুগলে পেলাম না। লিথিয়াম লালচে হয়ে যাবে। ক্যালশিয়াম খয়েরি। গেরুয়াটা কীভাবে করা যায় তুই বলতে পারিস?
–না, এই রংবাজিটা পারিনি।
…পড়ুন এই কলামের অন্যান্য পর্বও…
৩. ফেরিওয়ালা শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ ‘ফির’ থেকে, কিন্তু কিছু ফেরিওয়ালা চিরতরে হারিয়ে গেল
২. নাইলন শাড়ি পাইলট পেন/ উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন
১. যে গান ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝতে হবে সেই গানই কালজয়ী