বড় বড় অনুষ্ঠান ছাড়াও, বিশেষভাবে আমন্ত্রিত ঘরোয়া আসরে অথবা যখন কোথাও খানাপিনার দাওয়াত রক্ষা করতে যেতেন বেগম আখতার, সবসময় চাইতেন সঙ্গে থাকুক সেলিম ও শাহিদ। এঁরা দু’জনেও বেগম সাহিবার সঙ্গে এমন অনেক কথা খোলা মনে ভাগ করে নিতে পারতেন, যা হয়তো বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার কথা সেসব দিনে ভাবাই যেত না। সেলিমদের অনেক সমপ্রেমী/সমকামী বন্ধু সেসময় বেগম আখতারের গানের মধ্যে প্রেমের আকুতির কথা শুনে তাঁদের মনের স্পন্দন টের পেতেন।
৪.
ঠিক এক বছর আগে ২০২৩-এর ৩০ অক্টোবর লখনউয়ের ঠাকুরগঞ্জের এক মহল্লার মধ্যে এক সমাধির সামনে গোধূলিবেলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা ক’জন বন্ধু। প্রদীপ জ্বলছে। গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন উপস্থিত জনা পঞ্চাশেক মানুষ। সমাধির গা-ঘেঁষে একটা শিউলি গাছ। ফরাস-তাকিয়া বিছানো আছে সামনের উঠোনে। একটু পরেই শুরু হবে এক ঘরোয়া মেহফিল।
জায়গাটায় বেশ কিছু আমবাগান ছিল একসময়। তার মধ্যে একটা ছোট বাগানের মালকিন ছিলেন মুসতারি সাহিবা। এখানেই কবর দেওয়া হয় তাঁকে। এর বহু বছর পর যখন মুসতারির কন্যা আখতারি বাঈ ফৈয়জাবাদী বা বেগম আখতারের প্রয়াণ ঘটে, তখন তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মায়ের কবরের পাশে শুইয়ে দেওয়া হয় গজল-সম্রাজ্ঞীকে। আজ থেকে ঠিক ৫০ বছর আগে ৩০ অক্টোবর ১৯৭৪-এ চোখ বোজেন তিনি। তাই প্রতি বছর ওই দিনে বেগমের ‘বারসি’ বা বাৎসরিক মেহফিলের আয়োজন করা হয় তাঁর সমাধিস্থলে। সেটাতেই যোগ দিতে গিয়েছিলাম বন্ধু জামাল কিদওয়াইয়ের সহযোগে।
এই বাৎসরিক মেহফিল যে ৫০ বছর ধরেই হয়ে চলেছে, তা কিন্তু নয়। বহু বছর অনাদরে-অবহেলায় ছিল বেগমের কবরস্থান। একসময়কার আমবাগান অঞ্চলটা ধীরে ধীরে বদলে হয়ে গেল একটা ঘিঞ্জি এলাকা, যেখানে ঢুকতে হয় খুব সরু রাস্তার মধ্য দিয়ে। গজল-সম্রাজ্ঞীর ঘনিষ্ঠ দু’-চারজন ছাড়া সবাই ভুলে গেছিলেন তাঁর শেষ বিশ্রামস্থলের কথা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ওঁর প্রিয় শিষ্য, সুপরিচিত কণ্ঠশিল্পী শান্তি হিরানন্দ ও আমার বন্ধু জামালের নিজের মামা সেলিম কিদওয়াই। সেলিম ইতিহাসবিদ-লেখক-অনুবাদক ও ভারতে ক্যুইয়ার আন্দোলনের এক অগ্রপথিক। যে দু’জন তরুণ তুর্কির সঙ্গে বেগম আখতারের বন্ধুত্বের কথা নিয়ে এই লেখা, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন সেলিম।
শান্তি আপা ও সেলিম ভাই গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছিলেন বেগমের সমাধিস্থলের করুণ দশা। সংরক্ষণের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না দেখে তাঁরাই বছর ১২ আগে নিজেদের চেষ্টায় ও ভালোবাসায় জায়গাটা পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর করে তোলেন, যাতে কোনও সংগীতপ্রিয় মানুষ দু’-দণ্ড সেখানে বসে বেগম আখতারকে শ্রদ্ধা জানাতে পারেন, লখনউ থেকে যাতে বেগমের সব চিহ্ন মুছে না যায়। তাঁদের দু’জনের এই প্রচেষ্টার অংশীদার হন ‘সনতকাডা ট্রাস্ট’ নামে লখনউয়ের একটি নামী সংস্থা। সেই থেকে, অর্থাৎ ২০১২ থেকে হয়ে চলেছে ৩০ অক্টোবরের বাৎসরিক মেহফিল। শান্তি হিরানন্দ ও সেলিম কিদওয়াই দু’জনেই আজ প্রয়াত, কিন্তু বেগমের ‘বারসি’ বন্ধ হয়নি, তাঁর কবরস্থানে যত্নের ছাপ। জামালের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রেই জানতে পারি এসব কথা।
তাঁর মামা সেলিম ছোটবেলায় বেগমকে দেখেছেন দু’-চারবার, কেননা সেলিমের বাবার সঙ্গে গজল-সম্রাজ্ঞীর ভালোই হৃদ্যতা ছিল। এঁরা লখনউয়ের খানদানি পরিবার। ছোটবেলায় রেডিওতেও গান শুনেছেন আখতারি বাঈয়ের। তারপর লখনউ ছেড়ে দিল্লিতে পড়াশোনা করতে গিয়ে এক সংগীতসন্ধ্যায় শ্রোতা হিসেবে প্রথম দেখেন বেগম সাহেবাকে। ১৭ বছর বয়সের সেই দেখার কথা সেলিমের চিরকাল মনে ছিল। সুর খেলিয়ে শ্রোতার মনে জাদু বিস্তার, হৃদয়-হরণ হাসি এবং নাকছাবির হীরের ঝলকানি, গানের ফাঁকে শ্রোতাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ স্বরে আলাপ– সব মিলিয়ে মঞ্চে তাঁকে দেখা ও শোনার অভিজ্ঞতা ছিল অনন্য।
বেগম আখতারের প্রতিটি মেহফিলে এবার যাওয়া শুরু হয় মুগ্ধ সেলিমের। পারিবারিক যোগাযোগের দৌলতে যখন বেগমা সাহেবা জানতে পারেন এ কথা, কাছে টেনে নেন কলেজ-পড়ুয়া ছেলেটিকে। তাঁর আমন্ত্রণে, বেগমের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অনুষ্ঠানে যাওয়া শুরু করেন সেলিম। ততদিনে তিনি সেলিমের ‘আম্মি’– একাধারে স্নেহশীলা মা এবং ছটফটে মেয়ে, যাঁর মাথায় নানারকম দুষ্টুবুদ্ধি মাঝে মাঝেই খেলতে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ রীতিবিরুদ্ধ কাজ করায় যাঁর জুড়ি মেলা ভার।
একটা ঘটনার কথা সেলিম নিজেই বলে গেছেন। বেগম আখতার ক্যাপস্টান সিগারেট খেতেন এবং সেলিমের ধূমপানের অভ্যেস আছে জেনে তাঁর আড়ালে না খেয়ে সামনেই সিগারেট খাওয়ার কথা বলতেন। একবার ঈদের দিন সেলিম তাঁর বাবার সঙ্গে বেগম সাহেবার বাড়ি গেছেন। বাবা-ছেলে যে ঘরে বসে, সেখানে ঢুকে বেগম হঠাৎ বাবার দিকে পিছন ফিরে ছেলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার দিকে বাড়িয়ে দিলেন নিজের হাতের জ্বলন্ত সিগারেট এবং বলতে লাগলেন, ‘পিও, পিও’! সেলিম তাঁর বাবার সামনে সিগারেট খান না সেটা জেনেই ইচ্ছে করে সেলিমকে দিয়ে সিগারেটে একটা টান দেওয়ালেন বেগম এবং খুব আমোদ পেলেন নিজের এই দুষ্টুমিতে। ছেলেমানুষ হয়ে যাওয়া ও আশপাশের লোকেদের উষ্ণতায় ভরিয়ে রাখার একটা অদ্ভূত ক্ষমতা ছিল তাঁর।
কলেজে পড়ার এই সময়টাতে, অর্থাৎ ১৯৬৭-’৬৮ নাগাদ, সেলিমের সঙ্গে পরিচয় হয় দিল্লির অন্য একটি কলেজে পাঠরত কাশ্মীরের ছেলে আগা শাহিদ আলির, যাঁর কবি-জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেন বেগম আখতার। তিনি সেলিমের সঙ্গে সেই সাতের দশক থেকেই ক্যুইয়ার আন্দোলনে শরিক ছিলেন। সেলিম ও শাহিদ দু’জনের পরিবারের সঙ্গে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তনের ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সেই সূত্রেই ওঁদের প্রাথমিক আলাপ। কিন্তু দু’জনের বন্ধুত্ব গাঢ় হয় গজল-সম্রাজ্ঞীকে ঘিরে– বস্তুত বেগমের সঙ্গে সেলিমের ব্যক্তিগত যোগাযোগ থাকার কারণেই সম্ভবত শাহিদ প্রথমদিকে সেলিমের সঙ্গে বন্ধুত্বে আগ্রহী হন। বেগম আখতারের গুণমুগ্ধ এই দুই যুবক ১৯৬৮-’৬৯ থেকে ১৯৭৪-এ তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত, বছর পাঁচ-ছয়েক পেয়েছিলেন কিংবদন্তি গায়িকার নিবিড় সান্নিধ্য।
দু’টি অল্পবয়সি সংগীত-রসিক ছেলে তাঁকে সঙ্গ দিচ্ছে, খানিকটা ‘হিরো-ওয়ারশিপ’ করছে মা-জেঠিমার বয়সি শিল্পীকে, এটা নিশ্চয়ই বেগম সাহেবা বেশ উপভোগ করতেন। তাঁর স্বামী অনেক বছর আগে গত হন, এক বোন ছাড়া নিকট আত্মীয় বলে কেউ ছিল না তখন। কাছাকাছি যাঁরা সাধারণত থাকতেন, তাঁরা হয় বেগম আখতারের শিষ্য/সাগরিদ/যন্ত্রশিল্পী নয় সংগীত জগতের অন্যান্য লোকজন, যাঁদের সামনে তাঁকে হয় ‘গুরু’, নয় ‘স্বনামধন্য শিল্পী’-র ভাবমূর্তি বজায় রেখে চলতে হত। এই দু’টি ছেলে যেন হয়ে উঠল তাঁর স্বজন এবং কাছের বন্ধু, যাদের বিশ্বাস করে মনের কথা বলা যায় ও যাদের সামনে ‘ইমেজ’ রাখার ব্যাপার নেই। বরং একটা নির্ভার, খোলামেলা বন্ধুত্ব আছে, পার্টনার-ইন-ক্রাইম হয়ে ওঠার মজা আছে।
বড় বড় অনুষ্ঠান ছাড়াও, বিশেষভাবে আমন্ত্রিত ঘরোয়া আসরে অথবা যখন কোথাও খানাপিনার দাওয়াত রক্ষা করতে যেতেন, সবসময় চাইতেন সঙ্গে থাকুক সেলিম ও শাহিদ। এঁরা দু’জনেও বেগম সাহিবার সঙ্গে এমন অনেক কথা খোলা মনে ভাগ করে নিতে পারতেন, যা হয়তো বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার কথা সেসব দিনে ভাবাই যেত না। সেলিমদের অনেক সমপ্রেমী/সমকামী বন্ধু সেসময় বেগম আখতারের গানের মধ্যে প্রেমের আকুতির কথা শুনে তাঁদের মনের স্পন্দন টের পেতেন।
প্রতি মাসে দিল্লিতে কবে কবে বেগম আসবেন, সেগুলো ডায়েরিতে লিখে রেখে শাহিদ ও সেলিম দু’জন সেই দিনগুলোয় ‘আম্মি’র সঙ্গে কাটাতেন। ১৯৭১-’৭২ নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে দু’জনেই শুরু করেন ‘বাজম্-এ-রুহ-গজল’ নামে একটি সংস্থা। বেগম আখতারের নানা অভিনব অনুষ্ঠানের আয়োজন করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। বিজ্ঞাপন তুলে ব্রোশার ছাপিয়ে যে টাকা উঠত, ‘আম্মি’র হাতে বিজ্ঞাপনের সে টাকা প্রায় পুরোটাই তুলে দিতেন তাঁরা।
তারপর ১৯৭৪-এ একদিন আহমেদাবাদে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে আর ফিরলেন না বেগম আখতার। তাঁর হঠাৎ চলে যাওয়ার খবরে হতবাক সেলিম ও শাহিদ সেদিন দিল্লিতে। বেগম সাহেবাকে লখনউ নিয়ে আসা হচ্ছে জেনে এঁরা দু’জন টাকা ধার করে প্লেনের টিকিট কেটে পৌঁছে যান সেখানে। সেই আমবাগানে গজল-সম্রাজ্ঞীকে গোর দেওয়া হয়ে যাওয়ার পর, রাত জেগে শাহিদ লেখেন ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে একটি কবিতা, যে কবিতাটা পরে উৎসর্গ করেছিলেন সেলিমকে। এর বেশ কয়েক বছর পর শাহিদের একটা কবিতার বই বের হয় ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম ‘Call Me Ishmael Tonight: A Book of Ghazals’।
বেগম আখতারের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা সেলিম ও শাহিদকে কাছাকাছি এনেছিল। তাঁর অবর্তমানে বেগমকে নিয়ে দেশে-বিদেশে যা কিছু লেখা ও ছবি বেরত, সেগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতেন দু’জনে। এর দু’-এক বছর পর যখন শাহিদ আমেরিকা চলে যান, বেগমকে নিয়ে সব লেখা/ছবির দুটো কপি কিনে একটা পাঠিয়ে দিতেন সেলিম এয়ার-মেলে শাহিদের কাছে। বিদেশে কিছু বেরলে, শাহিদ একইভাবে পাঠাতেন সেলিমের জন্য। এভাবে তাঁরা একসঙ্গে ‘আম্মি’র কথা ভাবতেন, তিনি বেঁচে ছিলেন এই দু’জনের মনে, তাঁদের বন্ধুত্বের মধ্যে।
এছাড়া একটি বৃহৎ ‘ক্যুইয়ার’ পরিবারের অংশ ছিলেন তাঁরা, পরস্পরের সুখে-দুঃখে থেকে সমপ্রেমী মানুষদের সাহস ও ভালোবাসার উৎস ছিলেন এমন একটা সময়ে, যখন ‘ক্যুইয়ার’ মানুষদের আইনি ও সামাজিক অধিকার প্রায় কিছুই ছিল না। এই লেখাটা লিখছি জেনে জামাল আমাকে এঁদের দু’জনের আরেক বন্ধু, আমেরিকার সুপরিচিত ‘ক্যুইয়ার’ আন্দোলন কর্মী ও অধ্যাপক পাওলা বাচেটা-র একটা স্মৃতির টুকরো পাঠাল। সেখানে দেখছি পাওলা লিখেছেন শাহিদের কাছে একবার কয়েকদিনের জন্য গিয়ে সেলিমের হার্ট অ্যাটাক হওয়া ও বস্টনের হাসপাতালে বাইপাস সার্জারির কথা। হাসপাতালের তখনকার নিয়ম অনুযায়ী সেলিমের কাছে কেবল বাড়ির লোককে থাকতে দেওয়া হবে। বাড়ির লোক মানে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারভুক্ত লোক! নিয়মকে কাঁচকলা দেখিয়ে তখন শাহিদ হয়ে গেলেন সেলিমের নিজের ভাই এবং পাওলা সেই ভাইয়ের স্ত্রী। হাসপাতালে দশদিন তাঁরা একটা সোফা-কাম-বেডে ওইভাবে থাকলেন সেলিমের পাশে!
একসঙ্গে একটা ছবি তৈরি শুরু করেছিলেন সেলিম-শাহিদ বেগম আখতারকে নিয়ে। ২০০১ সালে শাহিদের অকস্মাৎ চলে যাওয়ার পর আরও ২০ বছর বেঁচেছিলেন সেলিম। কিন্তু যে ছবি দু’জনে সৃষ্টি করার কথা ছিল, সেটা শাহিদকে ছাড়া শেষ করেননি সেলিম।
কৃতজ্ঞতা ও ছবি সৌজন্য: জামাল কিদওয়াই
…পড়ুন দোসর-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩। বাণী-শ্যামলীর প্লাস্টার অফ প্যারিসে ঢালাই হওয়া বন্ধুত্ব
পর্ব ২। অমলেন্দুকে বিয়ে করেও সিঁদুর পরেননি কেন— ইন্টারভিউতে শুনতে হয়েছিল নাসিমাকে
পর্ব ১। ‘গীতাঞ্জলি’ আসলে বাংলা অনুবাদে বাইবেল, এই বলে জাপানিদের ধোঁকা দেন সুহাসিনী