১৯৪৬ সালে শুরু হওয়া বহরমপুর গার্লস কলেজে প্রথমে যোগ দেন পূর্ণিমা, ১৯৫৭ সালে। তার এক-দেড় বছরের মধ্যেই সেখানে পড়াতে যান অজয়া ও শুভা। তিনজনেই এম.এ. পাশ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন তখন। বিয়ে করার কথা কেউই ভাবেননি, পরেও নয়। বাঁচতে চেয়েছিলেন অন্যরকমভাবে, বিবাহ-বন্ধনে জড়িয়ে নয়, যদিও রক্তের সম্পর্কিত পরিবারের অনেক দায়-দায়িত্ব সারা জীবন নিয়েছেন এই ত্রয়ী। আটের দশকেই একসঙ্গে জমি কিনে শান্তিনিকেতনের নির্জনতায় ও সবুজের মধ্যে নিজেদের বাড়ি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁরা। অজয়া-পূর্ণিমা-শুভার নাম-লেখা ফলক বসে তাঁদের ‘দিগন্ত’ নামের বাড়িতে।
৬.
একজনের দেশের বাড়ি রানাঘাট, অন্য দু’জনের ফরিদপুর ও ঢাকা। দেশভাগের সময় ওপার থেকে ভিটেমাটি ছেড়ে দু’জনকে চলে আসতে হয় কলকাতায়, স্কুলজীবনের শেষ পর্বে। নতুন করে তাঁদের জীবন শুরু হয় এ শহরে। অন্যজন খাস ঘটি, কোনও দিন পদ্মা-মেঘনা দেখেননি। তবু পার্টিশনের বছর দশেক পরে, ভাগীরথী তীরে বহরমপুর শহরে চাকরি করতে গিয়ে মিলিত হন তিন স্বাবলম্বী তরুণী, মিলে যায় তিনটি অভিন্ন হৃদয়। আমাদের সৌভাগ্য তাঁদের মধ্যে একজন, পূর্ণিমা দাসগুপ্ত, ৯২ বছর বয়সেও চিরনবীন এবং তাঁর দুই প্রাণের বন্ধুর সঙ্গে যৌথ জীবনের স্মৃতি প্রসঙ্গে উচ্ছল।
যে যুগে বাঙাল-ঘটির হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলত, সেই যুগ থেকেই ঢাকার অজয়া দাসগুপ্ত-র রান্নার তারিফ করতে করতে ও ফরিদপুরের পূর্ণিমার রসবোধে মুগ্ধ হতে হতে পূর্ববঙ্গের প্রতি এক অমোঘ টান অনুভব করেন রানাঘাটের জমিদার-বাড়ির মেয়েটি, যাঁর নাম শুভা গাঙ্গুলী। সেই টানেই বাংলাদেশের জন্মের পর, সাতের দশকে অজয়া ও পূর্ণিমার সঙ্গে তাঁদের ফেলা আসা জন্মভূমি দেখতে যান এ পার বাংলার শুভা।
তিনজনের ব্যক্তিত্ব তিন ধরনের– অজয়া শান্ত-ধীর, শুভা আড্ডাবাজ-ছটফটে আর পূর্ণিমা মজাদার-রসিক। তবু তাঁরা অবিচ্ছেদ্য ও পরস্পরের পরিপূরক। কেমন সে সম্পর্কের রসায়ন? শুভার কোমর ছাপানো চুল ছিল। মধ্য বয়সে একদিন হঠাৎ সেলুনে গিয়ে সেই চুলে বব ছাঁট দিয়ে আসেন শুভা। তাঁর দেখাদেখি কিছুদিন পর অজয়াও ছেঁটে ফেলেন চুল। পূর্ণিমা বাকি থাকলেন কেন জিজ্ঞেস করায়, উত্তর ছিল, ‘আমার তো এই তিন গাছি চুল। কী আর ছাঁটব?’
১৯৪৬ সালে শুরু হওয়া বহরমপুর গার্লস কলেজে প্রথমে যোগ দেন পূর্ণিমা, ১৯৫৭ সালে। তার এক-দেড় বছরের মধ্যেই সেখানে পড়াতে যান অজয়া ও শুভা। তিনজনেই এম.এ. পাশ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন তখন। বিয়ে করার কথা কেউই ভাবেননি, পরেও নয়। বাঁচতে চেয়েছিলেন অন্যরকমভাবে, বিবাহ-বন্ধনে জড়িয়ে নয়, যদিও রক্তের সম্পর্কিত পরিবারের অনেক দায়-দায়িত্ব সারা জীবন নিয়েছেন এই ত্রয়ী।
বাবা-মা’কে পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতায় নিয়ে এসে বাড়ি ভাড়া করে দেখাশোনা করছেন তখন সদ্য চাকরি-পাওয়া অজয়া ও তাঁর দিদি অভয়া। পূর্ণিমা বাকি দু’জনের থেকে বয়সে একটু বড় হওয়ায়, বহরমপুরে যাওয়ার আগে বছর দুই জোরহাটের একটি নতুন মেয়েদের কলেজে গিয়ে পড়িয়েও এসেছেন। স্বাধীনতার স্বাদ, ভারতের নানা প্রদেশ থেকে আসা অধ্যাপক-সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করার আনন্দ সেখানেই প্রথম পান তিনি। পূর্ণিমার দিদি তখন চাকরি করছেন কলকাতার টেলিফোন ভবনে, বিয়ে করেননি। অজয়ার দিদি অভয়াও একটা নামকরা গ্রন্থাগারের দায়িত্বে ছিলেন। পরিবারের মধ্যে দিদিরা অবিবাহিত ও স্বাবলম্বী হওয়ায়, বিয়ে করা নিয়ে কোনও পারিবারিক চাপ ছিল না পূর্ণিমা ও অজয়ার ওপর। এটা আরও বেশ কিছু পরিবারে দেখেছি, যেখানে দিদিদের স্বনির্ভরতা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, বোনেদের পথ দেখিয়েছে। শুভার বাড়ি থেকে অবশ্য জোরদার চেষ্টা হয়েছিল বেশ কিছু বছর, তাঁর দিদিরা সকলেই সংসারে থিতু হয়েছিলেন। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন শুভা।
বহরমপুর গার্লস কলেজে অজয়া পড়াতেন সংস্কৃত ও বাংলা, শুভা দর্শন ও পূর্ণিমা ইতিহাস। থাকতেন কলেজ প্রাঙ্গণের মধ্যেকার কোয়ার্টারে। বহু বছর হোস্টেল ওয়ার্ডেন থাকার সুবাদে পূর্ণিমা অবশ্য ওয়ার্ডেনের ঘরেই থাকতেন। এই কলেজে প্রায় শুরু থেকেই মেয়েদের হোস্টেল ছিল। দেশভাগের পর অনেক উদ্বাস্তু পরিবারের মেয়েরা হোস্টেলের কারণে এখানে ভর্তি হয়েছিলেন, কারণ তাঁদের তখন আর কোনও থাকার জায়গা ছিল না।
কলেজটা যখন মাত্র বছর দশ-এগারো বছরের, সে সময়ে এঁরা যোগ দেওয়ায় অধ্যক্ষ প্রীতি গুপ্ত-র সুদক্ষ পরিকল্পনায়, একটা অন্তরঙ্গ পরিবেশে ও অক্লান্ত পরিশ্রমে শিক্ষাঙ্গনটি তিল তিল করে গড়ে তোলেন প্রথমদিকের এই তিনজন শিক্ষিকা ও তাঁদের আরও কিছু ছাত্রী-অন্তপ্রাণ সহকর্মী। এখানে বহরমপুর গার্লস কলেজ কীভাবে শুরু হল, পূর্ণিমা-পিসির মুখে শোনা সেই গল্পটা বলতেই হয়।
বহরমপুরে সে সময় মেয়েদের জন্য কোনও কলেজ ছিল না। গার্লস কলেজের পত্তন করেন বহরমপুরের সেই সময়কার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বি.জি. রাও ও তাঁর স্ত্রী শিক্ষাবিদ অমিয়া রাও। কলেজের প্রথম অধ্যক্ষও ছিলেন অমিয়া রাও। যাই হোক, যে গল্পটা বলছিলাম। রাও দম্পতি রোজ ভোরবেলা তাঁদের কোয়ার্টারের বারান্দা থেকে দেখতেন ভালো করে আলো ফোটার আগেই রাস্তা দিয়ে একজন বৃদ্ধ মানুষ লণ্ঠন হাতে চলেছেন, তাঁর পিছনে পিছনে কয়েকটি মেয়ে আর মেয়েদের পিছনে আর একজন পুরুষমানুষ আগলে নিয়ে চলেছেন দলটিকে। প্রতিদিন এঁরা কোথায় যায় খোঁজ নিতে জানা গেল যে স্থানীয় গার্লস কলেজ না থাকায় যেসব মেয়েরা ম্যাট্রিক পাস করে আরও পড়তে ইচ্ছুক, তাদের শেষ রাতে বহুদূর হেঁটে যেতে হচ্ছে কৃষ্ণনাথ কলেজের সদ্য-শুরু হওয়া মেয়েদের জন্য মর্নিং সেকশনে। এরপরেই বি.জি. রাও ও অমিয়া রাওয়ের উদ্যোগে স্বাধীনতা-দেশভাগের কয়েক মাস আগে স্থাপিত হয় বহরমপুর গার্লস কলেজ। অল্পদিনের মধ্যে শুরু হয় হোস্টেল।
এখানে পড়াতে পড়াতেই অজয়া, পূর্ণিমা ও শুভার কাছাকাছি আসা। তাঁরা একসঙ্গে কোনও কোনও জ্যোৎস্না রাতে ভাগীরথী তীরে বেড়াতে গেছেন, বীরভূমের টেরাকোটা মন্দিরগুলো ঘুরে দেখেছেন আবার কখনও হিমালয়ের পাদদেশে পাড়ি দিয়েছেন। ছাত্র-দরদী এই শিক্ষিকারা কলেজের সাংগঠনিক কাজেও যৌথতার আনন্দ খুঁজে পেতেন, যে কাজগুলোর মধ্য দিয়ে মেয়েরা মানসিক ও শারীরিক বিকাশের যথাযথ সুযোগ পেতে পারে।
বিশেষ করে বলতে হয় মেয়েদের জন্য একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলার কথা। ছাত্রীরা অনেকেই না খেয়ে কলেজে আসে, বাড়িতে অভাব অথবা সামর্থ্য থাকলেও নজর দেওয়া হয় না মেয়েদের খাওয়াদাওয়ার প্রতি, মাঝে মাঝে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে– এসব লক্ষ করে অধ্যক্ষার পরামর্শে অজয়া, পূর্ণিমা ও তাঁদের সহকর্মীরা প্রত্যেক ছাত্রীর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলে একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। সেটা ১৯৬৬ সাল। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে বহরমপুর শহরের কিছু ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে কলেজ চত্বরে স্বাস্থ্যকেন্দ্র গঠন ও পরিচালনার দায়িত্ব নেন শুভা। আজ সেই সুস্থতা কেন্দ্রের নাম হয়েছে ‘শুভা স্বাস্থ্যকেন্দ্র’।
বছর ৩৪-৩৫ চাকরি করার পর যখন অবসর নেওয়ার সময় কাছিয়ে আসে, তিনজনের মধ্যে আলোচনা চলে অবসর-জীবন নিয়ে। ২৩-২৪ বছর বয়স থেকে যে স্বাধীনতা-পিয়াসী তরুণীরা বাবা-মা-ভাই-বোন ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেও নিজেদের মতো করে বেঁচেছেন সেই পাঁচের দশক থেকে, তাঁরা নয়ের দশকে একত্রে এক বিকল্প নীড় রচনা করেন। আটের দশকেই একসঙ্গে জমি কিনে শান্তিনিকেতনের নির্জনতায় ও সবুজের মধ্যে নিজেদের বাড়ি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁরা। পূর্ণিমার কলেজবেলার সহপাঠী প্রসূন মজুমদারের সাহায্যে সে বাড়ি তৈরি হয়। অজয়া-পূর্ণিমা-শুভার নাম-লেখা ফলক বসে তাঁদের ‘দিগন্ত’ নামের বাড়িতে।
১৯৯২-তে অবসর নেন পূর্ণিমা আর তার এক-দেড় বছরের মধ্যে অন্য দু’জনেরও চাকরি জীবন শেষ হয়। সেখানেই থাকতেন তাঁরা তিনজন শুভার মৃত্যু পর্যন্ত। তারপর তিনজন থেকে দু’জন হয়ে কোভিড অতিমারীর আগ পর্যন্ত ‘দিগন্ত’ আলো করে ছিলেন পূর্ণিমা-অজয়া। ২০২১-এ অজয়া চলে যাওয়ার পর নবতিপর পূর্ণিমা কলকাতায় একা, তবে এখনও তাঁদের ‘দিগন্ত’ বাড়িতে ঘুরে আসেন বছরে দু’-একবার। সেই বাড়ির সামনের বাগানে আজও যত্নের ছাপ, যে বাগানের প্রতি বিশেষ খেয়াল ছিল অজয়ার।
আত্মীয়-স্বজন, পুরনো ছাত্রী ও সহকর্মীদের ভিড় লেগেই থাকত ওই দোতলা বাড়িতে সারা বছর। তিনজনের সম্পর্ক নিয়ে, কীভাবে সংসার চালান এই তিন ‘অনাত্মীয়’ মহিলা– এসব নিয়ে পাড়ার লোকের কৌতূহল ছিল যথেষ্ট! তিনজন তিনটে আলাদা রান্না করেন নাকি একসঙ্গেই রান্না হয়– এরকম প্রশ্ন ভেসে আসত প্রথম দিকে। তারপর পাড়ার লোক দেখল যে এই ত্রয়ী রাঁধাবাড়া, পুজোআচ্চার বাইরেও একসঙ্গে আরও কিছু কাজ করেন।
বাড়ির একতলায় বহু বছর তাঁরা চালিয়েছিলেন এক সান্ধ্য পাঠশালা ও তৈরি করেছিলেন একটি লাইব্রেরি। সেই লাইব্রেরির আবার ‘রিডিং’ ও ‘লেন্ডিং’– দুটো বিভাগ ছিল। যে পাড়ায় তাঁদের বাড়ি, তার কাছাকাছি পাড়াগুলোতে ঘুরে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী জোগাড় করেছিলেন যাদের বাড়িতে পড়া দেখিয়ে দেওয়ার কেউ নেই অথবা বই কিনে দেওয়ার আর্থিক সামর্থ্য নেই যাদের পরিবারের। আট থেকে ১৮ বছরের অনেক পড়ুয়া আসত নিয়মিত। পূর্ণিমা, অজয়া, শুভা– তিনজন তিনটে ঘরে ক্লাস নিতেন সন্ধেবেলা। অজয়া ছেলেমেয়েদের গান শেখাতেন, শুভা করাতেন নাটক, পূর্ণিমা ছোটদের নিয়ে একটা পত্রিকা বের করতেন।
পাঠশালার কলতান আজ আর ‘দিগন্ত’ বাড়িতে শোনা যায় না। তার মানে এই নয় যে বাড়িটা এঁদের কারও পারিবারিক দখল অথবা অন্য কারও ব্যক্তিগত মালিকানায় চলে যাওয়ার পথে। তিন বন্ধুর ইচ্ছা অনুযায়ী এঁদের অবর্তমানে ‘দিগন্ত’ বাড়ি গোষ্ঠীগত কাজে যাতে ব্যবহৃত হয়, সেই উদ্দেশ্যে একটি সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানকে দান করা হয়েছে।
আজীবন যে অন্যরকম যৌথতা-যাপনে তাঁরা বিশ্বাস রেখেছেন, তার স্বাক্ষর রয়ে গেছে এই ত্রয়ীর ইচ্ছাপত্রেও। আর শুভা ও অজয়ার সঙ্গে নানা ছবি অ্যালবামে অ্যালবামে সাজিয়ে আজও কামারেডারির ওম বুকের মধ্যে ধরে রেখেছেন পূর্ণিমা।
ছবি ঋণ: স্বাতী রায় গাঙ্গুলী, অদিতি দাসগুপ্ত, সুপ্রিয়া চৌধুরি
…পড়ুন দোসর-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৫। উমাদি-চিনুদা-নিরঞ্জনবাবুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল গভীর মনের মিল ও মতাদর্শ ঘিরে
পর্ব ৪। যাঁদের ‘ইমেজ’ ধরে রাখার ব্যাপার নেই, পার্টনার-ইন-ক্রাইম হয়ে ওঠার মজা আছে
পর্ব ৩। বাণী-শ্যামলীর প্লাস্টার অফ প্যারিসে ঢালাই হওয়া বন্ধুত্ব
পর্ব ২। অমলেন্দুকে বিয়ে করেও সিঁদুর পরেননি কেন— ইন্টারভিউতে শুনতে হয়েছিল নাসিমাকে
পর্ব ১। ‘গীতাঞ্জলি’ আসলে বাংলা অনুবাদে বাইবেল, এই বলে জাপানিদের ধোঁকা দেন সুহাসিনী