Robbar

তিনটি মানুষ ও একটি কারাগার

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 27, 2024 5:41 pm
  • Updated:October 4, 2024 9:42 pm  

জোয়ান বায়েজের সঙ্গী ডেভিড হ্যারিসের কাছে শোনা বিভিন্ন কারাগার সংক্রান্ত গল্পের ভিত্তিতেই জোয়ান লিখেছিলেন ‘প্রিজন ট্রিলজি’। গানটি কোনওরকম কাব্যিক ভঙ্গিমা বা রসের ধার ধারে না। তিনটি আলাদা গল্প বলেন ব্যালাডের ধরন নিয়ে। এই তিনটি গল্পে শুধু কারাগারের শোষণ নয়, আমাদের সমাজের শ্রেণি বিভাজন, শ্রেণির লড়াইয়ের একটা ছবিও স্পষ্ট করে তুলে ধরেন তিনি। জেলে সাধারণত কাদের তোলা হয়, কাদের জেলে অত্যাচার করা হয়, কাদের দিনের পর দিন বিচার হয় না– এর মধ্য দিয়ে যে সমাজের কঙ্কালসার চরিত্রটি ফুটে ওঠে, সেটা জোয়ান বায়াজ জেনেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন আসল শোষিত কে, আর শোষক কে।

প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়

৬.

প্রিজন ট্রিলজি, জোয়ান বায়েজ, ১৯৭২, আমেরিকা

আমার বাবা আর কাকা আন্দামানে দ্বীপান্তরিত হয়েছিলেন। একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর সন্তান হওয়ার সুবাদে ছোটবেলা থেকে বাবার কাছে জেলখানার নানা গল্প শুনেছি। পরে, ১৯৭১ সালে ভারত সরকারের আয়োজনে আন্দামান সেলুলার জেল দেখার সৌভাগ্য হল। সে বছর সেলুলার জেলকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ‘ন্যাশনাল মনুমেন্ট’ ঘোষণা করেন। ওখানে পর্যটকদের ভিড় তখনও শুরু হয়নি। ওই বিশাল কারাগার, ফাঁসির মঞ্চ, চাবুক মারার ব্র্যাকেট (ওটাকে ‘টিকটিকি’ বলত কয়েদিরা) দেখে বাবার কাছে শোনা গল্পগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল বাবার জেলজীবনটা কি আমি কখনও বুঝতে পারব? এখনও মাঝে মাঝে ভাবি ওই জেলজীবন নিয়ে, ওই নির্মমতা নিয়ে।

Terror Behind The Walls' – The Penal Colonies (Part III) | Hritambhara
আন্দামান সেলুলার জেল

কারাগার। মানব সভ্যতায় কারাগার এল অপরাধী, দুষ্কৃতীদের শাস্তি দিতে, সংশোধন করতে আর বিপজ্জনক মানুষকে আটকে রাখতে। কিন্তু যুগ যুগ ধরে, মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে কারাগার হয়ে উঠেছে অত্যাচার আর দমনের প্রতীক। আর তার বিরুদ্ধে জনসাধারণও যেমন আন্দোলন করেছে, সাহিত্যিক, কবি, সংগীতশিল্পীরাও তাঁদের শিল্পকে হাতিয়ার করেছেন এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে।

বাস্তিলের দুর্গ

বাস্তিল দুর্গ এবং ফরাসি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে চার্লস ডিকেন্স লিখেছিলেন ‘A Tale Of Two Cities’.

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে যখন কারারুদ্ধ করা হল, কাজী নজরুল ইসলাম লিখলেন–
‘কারার ঐ লৌহকপাট
ভেঙে ফেল কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।’

সেটা ছিল ১৯২১ সাল।

তার ৮ বছর পর ১৯২৯ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীন দাস অনশনরত অবস্থায় লাহোর জেলে শহিদ হলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চুপ করে থাকতে না পেরে লিখলেন:

‘সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ
হে ভৈরব, শক্তি দাও, ভক্ত-পানে চাহো।’

কাজী নজরুল ইসলামের প্রায় ৫০ বছর পর জোয়ান বায়েজও সেই কারাগার ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার আওয়াজ তুললেন,
‘And we’re gonna raze, raze the prisons
To the ground’

গানের নাম ‘প্রিজন ট্রিলজি’।

45cat - Joan Baez - Song Of Bangladesh / Prison Trilogy (Billy Rose) - A&M - USA - 1334-S

Billy Rose was a low rider, Billy Rose was a night fighter
Billy Rose knew trouble like the sound of his own name
Busted on a drunken charge
Driving someone else’s car
The local midnight sheriff’s claim to fame

In an Arizona jail there are some who tell the tale how
Billy fought the sergeant for some milk that he demanded
Knowing they’d remain the boss
Knowing he would pay the cost
They saw he was severely reprimanded

In the blackest cell on “A” Block
He hanged himself at dawn
With a note stuck to the bunk head
Don’t mess with me, just take me home

Come and lay, help us lay
Young Billy down

Luna was a Mexican the law called an alien
For coming across the border with a baby and a wife
Though the clothes upon his back were wet
Still he thought that he could get
Some money and things to start a life

It hadn’t been too very long when it seemed like everything went wrong
They didn’t even have the time to find themselves a home
This foreigner, a brown-skin male
Thrown into a Texas jail
It left the wife and baby quite alone

He eased the pain inside him
With a needle in his arm
But the dope just crucified him
He died to no one’s great alarm

Come and lay, help us lay
Young Luna down
And we’re gonna raze, raze the prisons
To the ground

Kilowatt was an aging con of 65 who stood a chance to stay alive
And leave the joint and walk the streets again
As the time he was to leave drew near
He suffered all the joy and fear
Of leaving 35 years in the pen

And on the day of his release he was approached by the police
Who took him to the warden walking slowly by his side
The warden said “You won’t remain here
But it seems a state retainer
Claims another 10 years of your life.”

He stepped out in the Texas sunlight
The cops all stood around
Old Kilowatt ran 50 yards
Then threw himself down on the ground

They might as well just have laid
The old man down
And we’re gonna raze, raze the prisons
To the ground
Help us raze, raze the prisons
To the ground

Joan Baez Documentary Confronts the Emotional Toll of Music and ...
জোয়ান বায়েজ

জোয়ান বায়েজের সঙ্গী ডেভিড হ্যারিসের কাছে শোনা বিভিন্ন কারাগার সংক্রান্ত গল্পের ভিত্তিতেই জোয়ান লিখেছিলেন ‘প্রিজন ট্রিলজি’।

গানটি কোনওরকম কাব্যিক ভঙ্গিমা বা রসের ধার ধারে না। তিনটি আলাদা গল্প বলেন ব্যালাডের ধরন নিয়ে।

এই তিনটি গল্পে শুধু কারাগারের শোষণ নয়, আমাদের সমাজের শ্রেণিবিভাজন, শ্রেণির লড়াইয়ের একটা ছবিও স্পষ্ট করে তুলে ধরেন তিনি। জেলে সাধারণত কাদের তোলা হয়, কাদের জেলে অত্যাচার করা হয়, কাদের দিনের পর দিন বিচার হয় না– এর মধ্য দিয়ে যে সমাজের কঙ্কালসার চরিত্রটি ফুটে ওঠে, সেটা জোয়ান বায়াজ জেনেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন আসল শোষিত কে, আর শোষক কে। এই যে তিনটি গল্প, এই তিনটে গল্পতে তিনটে আলাদা আলাদা শোষণের গল্প বলেন। দেখা যায়, শোষণযন্ত্রে পিষে মরা এই তিনটি মানুষ তিনভাবে সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘু, তাই সোজা জেলবন্দি করো।

Joan Baez: “Bob Dylan me rompió el corazón, fue devastador”
জোয়ান বায়েজ

এই গানের সুরের কাঠামো কিন্তু ঠিক আমেরিকান লোকসংগীতের মতো নয়। এতে কান্ট্রি মিউজিকের স্পষ্ট ছাপ, একটা নির্দিষ্ট চলন আছে। আছে একটা ঘোর।

ওই সময়কার একটি কালজয়ী গান ক্রিস ক্রিস্টোফারসনের ‘Me and Bobby Mcgee’-র সুরের কাঠামোর সঙ্গে প্রিজন ট্রিলজির সূক্ষ্ম মিল পাওয়া যায়।

Joan Baez and Kris Kristofferson performed hourlong sets at Symphony Hall in Boston. They ended the night with two encore duets.
জোয়ান বায়েজ ও ক্রিস ক্রিস্টোফারসন

প্রথম গল্পটিতে দেখি খেটে খাওয়া বিলি রোজের গল্প। যে শুধু দুধ চেয়েছিল বলে তাকে অন্ধকারতম কুঠুরিতে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়। সেখানে চলে অত্যাচার। বিলির বিচার করেনি কেউ। কেউ জানতে চায়নি ওই অন্ধকারে বিলি কীভাবে কাটিয়েছে। বিলিকে যখন পাওয়া যায় তখন সে ওই কুঠুরির সিলিং থেকে ঝুলছিল। সে শেষমেশ মরে যেতে চাইল। তার অপরাধ ছিল সে বাঁচার তাগিদে দুধ চেয়েছিল।

মেক্সিকো সীমান্ত পেরিয়ে এসেছিল বলে লুনাকেও জেলে পচে মরতে হল। বাদামি চামড়ার মানুষ লুনা, সঙ্গে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে কোনওরকমে মার্কিন দেশে এসেছিল। কিন্তু বাদামি চামড়ার মানুষদের কি সাদা চামড়ার মানুষেরা এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার যোগ্য মনে করে? লুনাকে ওরা ‘এলিয়েন’ বলেছিল। স্ত্রী-সন্তানের কোনও খবর আর পায়নি লুনা জেলে আসার পর। কী আর করার ছিল লুনার? মাদক দ্রব্য সেবন করতে করতে মারা গেল সে। শরণার্থী মানুষদের জন্য এ পৃথিবী কোনও জায়গা অবশিষ্ট রাখেনি। মানচিত্রে তাদের ঠাঁই হয় না। তারা বিতাড়িত।

তৃতীয় গল্প জেলখানার দুর্নীতি আর আইনের অপব্যবহার তুলে ধরে। একজন বয়স্ক কয়েদিকে, ৩৫ বছর জেল খাটার পর, মুক্তির দিনে আইনের প্যাঁচে ফেলে আরও ১০ বছর সাজা দেওয়া হয়। আইনের এই অপব্যবহার আমাদের মনে করিয়ে দেয় স্টিফেন কিং-এর লেখা নিয়ে ‘দ্য সশাঙ্ক রিডেম্পশন’ সিনেমার কথা। একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর ছেলে হওয়ার সুবাদে বাবার কাছে আন্দামান সেলুলার জেলের গল্প শোনা, ১৯৭১ সালে আন্দামান সেলুলার জেল দেখার সৌভাগ্য হয়। আজ এত বছর পর যখন আন্দামান সেলুলার জেলের কথা ভাবি, তখন আঁরি শারিয়ে (Henri Chariére)-এর বিখ্যাত উপন্যাস ‘প্যাপিলন’-এর এক দ্বীপ থেকে আর এক দ্বীপে কারারুদ্ধ হওয়ার বর্ণনা মনে পড়ে। আর কানে বাজে জোয়ান বায়েজের গান, ‘We gonna raze, raze the prisons to the ground.’

 

…পড়ুন গানস অ্যান্ড রোজেস-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৫। কাব্যিক অভিপ্রায় ছাপিয়ে যে গান রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষায় মিশে যায়
পর্ব ৪। যে সৈনিক কবর খোঁড়ে বেঁচে থাকার তাগিদে
পর্ব ৩। যে প্রশ্ন শহরের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ায়, উত্তর পাওয়া যায় না
পর্ব ২। আহা ফুল, কবরের ফুল, মাটিকে অমন ভালোবেসে পাশাপাশি ঘুমিয়ে থেকো না
পর্ব ১। বব ডিলানের এই গান ভবিষ্যৎবাণীর মতো নিদান দেয়– যুদ্ধ আসন্ন