গোলমেলে নায়ক দেব আনন্দ সাতের দশকে এসে ‘গাইড’-এর সেই জ্যোতির্বলয়ে আর ততটা ছিলেন না ঠিকই, কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্ত ভীরু দর্শকমননে আবার ঝড় তুলেছিল ‘হরেকৃষ্ণ হরেরাম’, তবে দৃশ্যত প্রৌঢ় দেব আনন্দ সেখানে কিছুটা পিছিয়ে পড়লেন, ঝলমলে হয়ে উঠলেন জিনাত আমন। সেসব গল্পে যাওয়ার আগে একবার ভেবে নেওয়া দরকার, প্রতারক, গ্যাংস্টার, জুয়াড়িদের সঙ্গে লড়ে নায়ক হয়ে ওঠা দেব আনন্দ কেন কলকাতার দর্শককে আর টানছেন না সাতের দশকের গোড়ায় দাঁড়িয়ে?
৬.
ঝড় উঠবে উঠবে পরিস্থিতি হয়েও বৃষ্টি হয়তো নামেনি সেদিন, এমন দিনে বায়োস্কোপ দেখতে বেরনোই যায়। তাই অফিসফেরত নাইট শো। অথবা পরিকল্পনা করেই যাওয়া, অফিস কেটে কেরানির ময়দান সফর, চিনেবাদাম-সঙ্গর পরের হল-সফরে যে সেলুলয়েডের আলো জেগে ছিল, সে এক আশ্চর্য না-বলা ইতিহাস। কাটলেট-চায়ের স্পর্শে সেই মৌতাত সম্পূর্ণ হয়েছে কখনও। সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্পের চরিত্রদের দিকে তাকালেই সেইসব একা বায়োস্কোপ-যাত্রীদের চরিত্র স্পষ্ট হয়। আবার বিজনবাবুরা সপরিবার হিন্দি ছবি দেখতে যায়, এমন সূত্রও আছে ‘লোডশেডিং’-এর মতো গল্পে। এই একা এবং কয়েকজনদের কাছে বায়োস্কোপ দেখা যতটা ‘ইভেন্ট’ হয়ে উঠেছিল এককালে, ঠিক যতটা ঘটনা হয়ে উঠেছিল, ততটাই কি জোরালো ছিল সেসব ছবির অভিঘাত? যেসব ছবি নিয়ে আমরা প্রায় পাঁচ দশক পরেও কথা বলে চলেছি, সেই ছবি কীভাবে স্মৃতিতে রয়েছে সেই প্রজন্মের? চলচ্চিত্র হিসেবে কতটা, আর কতটা সেই বিচিত্র জাদুঘর সফরের সৌজন্যে?
এর দু’রকম মাত্রাই থেকে যায়। একদিকে, যেমন এই সিনেমা দেখতে যাওয়ার ভ্রমণবিলাসে মিশে যায় সেইসব ছবির স্মৃতি, তেমনই এক-একজন নায়ক-নায়িকার সঙ্গে ফেলে আসা দশকগুলোর মিলে যাওয়া, তাও তো ছিল। একবার এক ব্যক্তিগত আড্ডায় দুই ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি তরুণদের কাছে কবুল করেছিলেন, তাঁরা কলেজ কেটে একবার সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন, সাতের দশকের মাঝামাঝি। তরুণদের মধ্যে স্বভাবতই কৌতূহল, কী সেই ছবি, যা সেই সময়ের দুই আদ্যন্ত বামপন্থী ও সংস্কৃতির পায়রা ওড়ানো যুবক দেখতে যেতে পারে কলেজ কেটে? যে সালের কথা, তার ভিত্তিতে মৃণাল সেনের ‘কোরাস’ থেকে ‘গডফাদার টু’, এসব আন্দাজ যখন উঠে আসছে, তখন সেই দুই প্রৌঢ় তরুণ জানালেন, ছবিটির নাম ‘মনোরঞ্জন’। সঞ্জীব কুমার বা শাম্মি কাপুর নন, বা বিলি ওয়াইল্ডারের রম-কমের হিন্দি সংস্করণ বলেও নয়, সেই ছবি স্মৃতিধার্য দু’টি মাত্র কারণে, এক ওই কলেজ কেটে এমন চটুল ছবি দেখতে যাওয়ার রোমাঞ্চ, যা কেবল প্রতিষ্ঠান হিসেবে কলেজ বা বাড়ির অনুশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে না, বরং বাম সাংস্কৃতিক ঘেরাটোপকেও খানিক কলা দেখাচ্ছে, আরেক হল জিনাত আমন।
জিনাত কেন পুং-স্মৃতিতে উজ্জ্বল এতটা, তাই নিয়ে গল্পগাছার বহু অবকাশ রয়েছে। কিন্তু একইভাবে রোমান্টিক নায়কের সংজ্ঞা হয়ে যে দেব আনন্দ-ও বহুকাল থেকে গেলেন, এই সমীকরণও খুব সহজ নয়। তবে অন্যতর একটি ভাবনা উসকানি পায় দেব আনন্দের সূত্রে। প্রথম ছবি ‘হাম এক হ্যায়’ স্বাধীনতা ছুঁই ছুঁই সময়ে মুক্তি পেয়েছিল। দাঙ্গাধ্বস্ত দেশে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির বার্তাবাহক সেই ছবিই হোক বা ১৯৪৭ সালের দেশাত্মবোধক ‘আগে বাঢ়হো’ অথবা ইসমত চুঘতাইয়ের গল্প নিয়ে ‘জিদ্দি’ (১৯৪৮) দেব আনন্দকে কখনওই সেই উত্থান দেয়নি, যা দিয়েছিল ১৯৫১ সালের ‘বাজি’। এই ছবি এমন এক ধারার জন্ম দিল ক্রমে ক্রমে, যাকে খোদ ‘বম্বে নয়্যার’ বলে ডাকা শুরু হল। গুরু দত্তর এই ছবি ছিল মিউজিক্যাল, যেখানে প্রভূত সাংগীতিক চলাচলের মধ্যেই নায়কের নানাবিধ নৈতিক সংকট, জুয়া খেলার কুয়াশা এবং প্রায় ফেমে ফাতালের (গীতা বালি) মতো বেশ কিছু আঁধারে ঘেরা নয়্যারের উপাদান মজুত ছিল পুরোদমে। মিথ্যে খুনের মামলায় নায়কের ফেঁসে যাওয়া ও তা থেকে মুক্তি পাওয়ার এই চেনা গল্প সেই সময় বাংলা সাহিত্যে পাঁচকড়ি দে থেকে হেমেন্দ্রকুমার রায় পর্যন্ত সকলের লেখাতেই কমবেশি পাওয়া গিয়েছে, যা আবার পাশ্চাত্যের পাল্প ফিকশন ও ডিটেকটিভ কাহিনির থেকে বেশ কিছুটা অনুপ্রাণিত ছিল। আবার হলিউডে ততদিনে আলফ্রেড হিচকক হয়ে উঠেছেন রীতিমতো সাসপেন্স থ্রিলারের ধ্রুবতারা, বানিয়ে ফেলেছেন ‘স্পেলবাউন্ড’, ‘নটোরিয়াস’, ‘রোপ’ বা ‘স্ট্রেঞ্জারস অন আ ট্রেন’-এর মতো ছবি, অন্যদিকে ‘দ্য মালটিজ ফ্যালকন’, বা বিলি ওয়াইল্ডারের ‘ডাবল ইনডেমনিটি’-র মতো ফিল্ম নয়্যার ততদিনে সিনেদুনিয়ায় আলোড়ন ফেলছে। আবার ফের পরের বছর গুরু দত্তরই পরিচালনায় আরেক ক্রাইম নয়্যার ‘জাল’-এ হাজির হলেন দেব আনন্দ। তারপর থেকে ‘হাউজ নম্বর ফর্টিফোর’, ‘পকেটমার’, ‘নউ দো গ্যায়ারা’, ‘সিআইডি’ (আবারও গুরু দত্ত), ‘দুশমন’, ‘জালি নোট’ থেকে ‘গ্যাম্বলার’, ‘জুয়েল থিফ’ পেরিয়ে ‘লুটমার’ জাতীয় ছবি পর্যন্ত, বারবার অপরাধকেন্দ্রিক ছবির কাছে ফিরে গেছেন দেব আনন্দ। কখনও মাথায় বেঁকিয়ে পড়া গ্যাটসবি ক্যাপ টুপি ও মুখে চুরুট নিয়ে ধোঁয়াটে জুয়াড়ি হয়েছেন, তো কখনও মাথায় হ্যাট টুপি পরে গোয়েন্দাও হয়েছেন, কখনও অনন্যসুন্দর তনুজার ‘রাত আকেলি হ্যায়’-এর ইন্ধন এসেছে রহস্যময়ীর মতো, হলে বসে থাকা অনেক বয়ঃসন্ধিই সেই ইঙ্গিত এড়াতে না পারলেও, গুপ্তচর ও ছদ্মবেশী দেব আনন্দ সেসব এড়িয়েছেন স্বমহিমায়।
প্রসঙ্গত, এর ‘সোনার হরিণ’, ‘কখনও মেঘ’, ‘চিড়িয়াখানা’ (এখানে সরাসরি ব্যোমকেশ), ‘জীবনমৃত্যু’, ‘আমি সে ও সখা’, ‘যদি জানতেম’, ‘শেষ অঙ্ক’ বা ‘বাঘবন্দী খেলা’– অপরাধ ও রহস্যের সঙ্গে ওঠাবসা মার্কামারা রোমান্টিক নায়ক উত্তমকুমারও অবশ্য কম করেননি। সেভাবেই আবার, এত অন্ধকার ও অপরাধীর গা-ঘষাঘষি করা নায়ক কিন্তু প্রেমিক হয়েছেন সহজেই, ‘গাইড’ বা ‘হাম দোনো’ বা ‘দুনিয়া’ বা ‘তেরে মেরে সপনে’ বা ‘তেরে ঘর কে সামনে’-ই শেষত তৈরি করেছে দেব আনন্দ নামক স্বপ্নিল নায়ককল্পটি। কিন্তু পাঁচ-ছয়ের দশক ধরে তৈরি হওয়া এই প্রভূত পরিমাণ ক্রাইম ড্রামা এবং তার প্রতিনিধিত্ব নিয়ে নেওয়া নায়কের উৎস কি কেবলই পশ্চিম? বাংলা সাহিত্যেও গোয়েন্দা গল্প এসেছিল কোথাও না কোথাও ঔপনিবেশিক আধুনিকতার দ্যোতক হয়ে, আবার উর্দু সাহিত্যে বিশ শতকের গোড়ায় ‘জালিম ডাকু’ বা ‘বাহরি তুফান’-এর মতো প্রায়-পাল্প কীভাবে জাসুসি সাহিত্যধারার জন্ম দিচ্ছে ঔপনিবেশিক প্রভাবে, তা একটি নিবন্ধে দেখিয়েছেন মার্কাস ড্যাশেল। এই জাসুসি সাহিত্য এসেছে হিন্দি সাহিত্যেও। ‘জগৎ জাসুস’, ‘নীলম জাসুস’, ‘মওত কি দারায়ে’– ইত্যাদি নামের বই ও তার রংচঙে প্রচ্ছদে পশ্চিমি পাল্পের ছোঁয়া ছিল যেভাবে, সেভাবেই ‘গ্যাম্বলার’ বা ‘জুয়েল থিফ’-এর পোস্টার হয়ে উঠেছে রঙিন ও, অবশ্যই পশ্চিমঘেঁষা।
এহেন গোলমেলে নায়ক দেব আনন্দ সাতের দশকে এসে ‘গাইড’-এর সেই জ্যোতির্বলয়ে আর ততটা ছিলেন না ঠিকই, কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্ত ভীরু দর্শকমননে আবার ঝড় তুলেছিল ‘হরেকৃষ্ণ হরেরাম’, তবে দৃশ্যত প্রৌঢ় দেব আনন্দ সেখানে কিছুটা পিছিয়ে পড়লেন, ঝলমলে হয়ে উঠলেন জিনাত আমন। সেসব গল্পে যাওয়ার আগে একবার ভেবে নেওয়া দরকার, প্রতারক, গ্যাংস্টার, জুয়াড়িদের সঙ্গে লড়ে নায়ক হয়ে ওঠা দেব আনন্দ কেন কলকাতার দর্শককে আর টানছেন না সাতের দশকের গোড়ায় দাঁড়িয়ে? এমনিতেই ‘গোয়েন্দা গল্প’ নেহাতই সস্তার বিনোদন বলে অনেকের কাছে, না কি অন্ধকারের সংজ্ঞা তখন বদলে গেছে বলে? একটা ছোট্ট কিসসা দিয়েই অতএব ইতি টানা যাক এই অধ্যায়ে। এক ভদ্রলোক থমথমে সিঁথির মোড় ঘেঁষা কোনও এক গলি দিয়ে হাঁটছেন এক সংঘর্ষমুখর দিনে। হঠাৎ পিছু নিল সাদা পোশাকের দু’জন। সাদা পোশাকের পুলিশকে ঠিক যেমন পোশাকে চেনা যায়, দু’জনের পরনেও তাই, হাবভাবেও তারা সেরকমই। সামনের ভদ্রলোকের হাঁটার গতি বাড়ল, নানাবিধ বাম সংস্পর্শে তিনি থাকেন, কোনওভাবে খোচড়ের নেকনজরে পড়লেন না তো? একটা মোড় ঘুরতেই সেই দু’জন মুখোমুখি। ভদ্রলোক তটস্থ। ‘সার্চ করা হবে’ বলে তল্লাশি শুরু হল। আর মিনিটখানেকের মধ্যেই গলির একপাশে জমা স্টোনচিপসের ওপর তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে সেই দুই ‘পুলিশ’ ভদ্রলোকের মানিব্যাগ নিয়ে হাওয়া।
অতএব, সেই কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে। সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প
পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল