পৃথিবীর কোন ভাষায় কবিরা কবিতা না লিখেছেন এই শহিদ কবির জন্য! কলমের কোন সৈনিকেরা সেদিন পথে নামেননি এই হত্যার প্রতিবাদে! আর তাঁর স্বজন দক্ষিণ আফ্রিকার কালো চামড়ার মানুষেরা? শুধুই কবিতা নয়, অস্ত্রের কাছে ফিরে যাওয়ার আহ্বানে সকাল সাতটা থেকে কেঁপে উঠেছিল জোহানেসবার্গের রাস্তাঘাট! ‘মায়িহ্লোম! মায়িহ্লোম!’— সোয়াহিলি ভাষায় যুদ্ধের ডাক সেদিন কাঁপিয়ে দিয়েছিল বর্ণবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গ সরকারের অন্তরাত্মা।
৬.
কোথায় লুকোবে কালো কোকিলের লাশ?
নোংরা ফ্যাকাশে হাতের স্পর্শ যেন
না ছোঁয় তোমার কফিনের কালো কাঠে…
আল মাহ্মুদ লিখলেন। আমরা জানলাম বেঞ্জামিনের জন্যে মেঘের ভিতরে এখনও একটু চাঁদ রয়েছে। তবু এ শহরের সূর্যস্নাত রাজপথ সেদিন তোলপাড় হয়েছিল ন’-হাজার কিলোমিটার দূরের ফাঁসিতে ঝোলানো এক কবির জন্য। কোথায় না খবর পৌঁছেছিল ১৯৮৫-র সেই অক্টোবরে? কারাবন্দি নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবিতে পৃথিবীর কোনও না কোনও শহরে তখন প্রত্যেকটা দিন ক্রুদ্ধ মিছিল বেরয়। সে মিছিলের শেষে ব্রিটিশ শাসক বোথা-র কুশপুতুল পোড়ে। এক লাইনও আফ্রিকার কোনও ভাষা না জানা তরুণী বা তরুণটি কত সহজেই গাইতে পারত— ‘মেই বু ই, মেই বু ই আফ্রিকা… ফিরে এসো, ফিরে এসো আফ্রিকা!’ আর ভূপেন হাজরিকা উদাত্ত গলায় গাইলেন— ‘কবি মোলোয়েস আমার নজরুল ইসলাম… কৃষ্ণকায়া আফ্রিকা মোর, কৃষ্ণকলি মা…!’ বর্ণবিদ্বেষের প্রতিটি সাদা পৃষ্ঠায় তখন প্রতিবাদের কালো কালির দৃঢ় আঁচড়।
মালিসেলা বেঞ্জামিন মোলোইসি। আসবাব তৈরির ফ্যাক্টরির শ্রমিক। ১৯৫৫-য় দক্ষিণ আফ্রিকার আলেকজান্ড্রায় জন্ম, বড় হয়ে ওঠা। কবি হিসাবে আমরা বেঞ্জামিনকে চিনতাম না। শহীদ কবি হিসাবে বেঞ্জামিনকে পৃথিবী চিনল। জানল, মালিসেলা বেঞ্জামিন মোলোইসি নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ কবি দক্ষিণ আফ্রিকার বোথা সরকারের এক পুলিশকে গুলি করে মেরেছেন। সেই নিরাপত্তা পুলিশ কর্মচারীর নাম ফিলিপাস সেলেপ, নিজে কালো মানুষ হয়েও শ্বেতাঙ্গ সরকারকে যে নিয়মিত সাহায্য করে যেত আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) কর্মীদের ধরিয়ে দিতে। কোর্টে দাঁড়িয়ে হলফনামা দিয়ে এএনসি নেতারা বলেছিলেন, বেঞ্জামিন ওই হত্যা করেননি, ওই হিট স্কোয়াডের সদস্য তিনি ছিলেন না, যারা ফিলিপাসকে মেরেছে। কিন্তু বেঞ্জামিন নিজে বিচারের শুরুতে এই হত্যার দায় নিজের ওপর নিয়ে নিয়েছিলেন (যদিও তাঁর আইনজীবী প্রিসিলা জেনা বলেছিলেন, নির্জন সেলে বেঞ্জামিনকে জবানবন্দি লিখতে বাধ্য করা হয়েছিল)। আসলে বেঞ্জামিনকে ফাঁসিতে ঝোলানো বোথা সরকারের কাছে জরুরি হয়ে পড়েছিল তার দেশি কোলাবোরেটরদের মনে ভরসা ফিরিয়ে আনতে। ১৯৮৩-র সেপ্টেম্বরে ট্রান্সভ্যাল সুপ্রিম কোর্টে বেঞ্জামিনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়েছিল। বেঞ্জামিনের ফাঁসি রুখতে পৃথিবীর দেশে দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল, কিন্তু তা আটকাতে পারেনি বোথা সরকারের অন্যায় আদেশকে। দু’বছর টানাপড়েনের পর প্রিটোরিয়ার কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৯৮৫-র ১৮ অক্টোবরের ভোরটা অন্যরকম ছিল।
বিদায় পৃথিবী গর্ভধারিণী দেশ
তালের গুচ্ছে ঝুলে থাকা শাদা চাঁদে
তোমাকে খুঁজছে ভ্রমরের গুঞ্জন।
তোমাকে খুঁজছে কালো মানুষের গান
কালো যুবতীর কুঞ্চিত কালো কেশে
তোমার নামের নকশা বুনতে গিয়ে
হাতির দাঁতের কাঁটাগুলো চমকায়।
মৃত্যু যদিও শেষ, তবু শেষ নয়
প্রাণধারণের লাঞ্ছিত তোলপাড়
কালো মানুষের চামড়ার মতো তাজা
তোমার নামের বানান বেঞ্জামিন।
আল মাহ্মুদ একা নন। পৃথিবীর কোন ভাষায় কবিরা কবিতা না লিখেছেন এই শহিদ কবির জন্য! কলমের কোন সৈনিকেরা সেদিন পথে নামেননি এই হত্যার প্রতিবাদে! আর তাঁর স্বজন দক্ষিণ আফ্রিকার কালো চামড়ার মানুষেরা? শুধুই কবিতা নয়, অস্ত্রের কাছে ফিরে যাওয়ার আহ্বানে সকাল সাতটা থেকে কেঁপে উঠেছিল জোহানেসবার্গের রাস্তাঘাট! ‘মায়িহ্লোম! মায়িহ্লোম!’— সোয়াহিলি ভাষায় যুদ্ধের ডাক সেদিন কাঁপিয়ে দিয়েছিল বর্ণবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গ সরকারের অন্তরাত্মা।
বেঞ্জামিনের মা, পলিন মোলোইসি ফাঁসির একদিন আগে তাঁর সন্তানের সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করতে পেরেছিলেন, এবং বেঞ্জামিনের শেষ বার্তা বিক্ষুব্ধ জনতার জন্য বয়ে এনেছিলেন। বার্তাটি ছিল— ‘দক্ষিণ আফ্রিকা একদিন কালো মানুষেরাই শাসন করবেন, এবং আজ যাঁরা নিজের জীবন উৎসর্গ করছেন, তাঁরা তা দেশের সেই অনাগত স্বাধীনতার জন্যেই করছেন।’ পলিন আরও জানিয়েছিলেন, বেঞ্জামিন ফাঁসির মঞ্চে হেঁটে যাবেন এএনসি-র নির্বাসিত নেতা অলিভার ট্যাম্বোকে উৎসর্গিত একটি গান কণ্ঠে নিয়ে। বেঞ্জামিনের যখন ফাঁসি হচ্ছে, তাঁর বাবা ও মা তখন প্রিটোরিয়া কারাগারের বাইরে পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে গাইছিলেন– ‘ন্কোসি সিকেলেল আই-আফ্রিকা…’। গানটি অচিরেই প্যান-আফ্রিকান মুক্তিগীতে পরিণত হয়েছিল।
আমি আজ যা, তাতে গর্বিত আমি…
জানি, পীড়নের ঝড় ধুয়ে মুছে যাবে
আমার রক্তের বৃষ্টি-ফোঁটায়
গর্বিত আমি…
দেওয়ার মতো এ জীবনটুকুই তো!
আমরা একটা মোটে জীবন।
(মালিসেলা বেঞ্জামিন মোলোইসির কবিতার অনুবাদ)
…পড়ুন কবি ও বধ্যভূমি…
পর্ব ৫: আমার দুঃখের কথা কি পাথরকে বলব?
পর্ব ৪: আমি সেই মেয়ে, যে আর ফিরবে না
পর্ব ৩: আমাকে পোড়াতে পারো, আমার কবিতাকে নয়!
পর্ব ২: এস্তাদিও চিলে আর চল্লিশটা বুলেটের ক্ষত
পর্ব ১: বিপ্লব, প্রেম ও কবিতাকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন দ্রোণাচার্য ঘোষ
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে যে মন্ত্রিত্বই তাঁর হাতে থাক, বুদ্ধদেব ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে অতি নির্ভরযোগ্য এক সেনাপতির মতো। ‘আপনারা বুদ্ধর কাছে যান, বুদ্ধ ওসব কালচার-ফালচার বোঝে’– জ্যোতিবাবুর এই উক্তি যথার্থ কি না জানি না, কিন্তু কথাটা মিথ্যে ছিল না।