কুসংস্কার সাধারণত তিনপ্রকার। ক্ষতিকর, নিউট্রাল, জরুরি। কালো বিড়াল নিয়ে কুসংস্কারটা যেমন কালো বিড়ালদের ক্ষতি করেছে অকথ্য। ভাঙা আয়নার কুসংস্কারটা মনে মনে খুঁত খুত করলেও খুব একটা প্রভাব ফেলেনি জীবনে। ওর কোনও এগিয়ে যাওয়ার বা পিছিয়ে পড়ার ব্যাপার নেই। নিউট্রালেই রয়েছে। কিন্তু ভূত? ভূতের হাত থেকে বাঁচানোটা যদি প্রয়োজনীয়তা না হয় তবে কোনটা প্রয়োজনীয়? নিশি ভূতের ভয় যাদের ছিল তার পিছু না ডাকার প্রথাটা তৈরি করে নিশি ভূতকে শায়েস্তাই করতে চেয়েছে শুধু। ‘তুমি মা, বোন, স্ত্রী– যাদের খুশি গলা নকল করে নাও না কেন, আমার যারা ভালো চায় তারা যে আমার পিছু ডাকবে না– এ আমি খুউব জানি।’
৬.
বেরনোর সময় পিছু ডাকতে নেই– কথাটা কোটিবার শুনেছি। অন্তত কয়েক হাজারবার নিজেই সাক্ষী থেকেছি পিছু ডাকার, কিন্তু কাউকে বলে উঠতে পারিনি ‘পিছু ডাকতে নেই।’ কেন ডাকতে নেই, সেটা জানি মোটামুটি সবাই। অমঙ্গল হয়, যাত্রা অপয়া হয়ে যায়, হেনতেন। কেউ ভুল করেও পিছু ডেকে নিলে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষদের দেখেছি আরও তিনবার ‘দুগগা দুগগা’ করে নিতে, অনুজ্ঞাচক্রে দু’হাত জোড় করে। যে বেচারা ভীষণ প্রয়োজনীয় কথা চিন্তা করে, যেটা ভুলে গেলে বিপদ হবে এমন কিছু, শেষ মূহূর্তে এসে ইনস্টিক্টিভলি পেড়ে ফেলল, হঠাৎ সবার চোখে ‘ভিলেন’ হয়ে গেল। যাত্রী ঘাড় ঘুরিয়ে দাঁড়ানোর পর বাকি লোকেরাও তখন চারদিক থেকে এমন বিরক্তিতে তাকাবে যে, প্রয়োজনীয় কথাটাও সে হয় ভুলেই যাবে নয়তো মিনমিন করে বলবে ভীষণ কোনও অপরাধবোধে।
একটা মজার ব্যাপার আমি লক্ষ করেছি। কুসংস্কার সাধারণত ঘুচিয়ে দেয় বিজ্ঞান। তার ওপর যদি ব্যবহারিক বস্তুর মধ্যে প্রয়োগ থাকে, সে বিজ্ঞানের তাহলে তো কথাই নেই! এবং সেসব ভেবেচিন্তে ক্যাপিটালিজম যখন বাড়ির কলিং বেল অবধি পৌঁছে দিয়ে যায় যে জিনিস তখন কুসংস্কার ভ্যানিশ করে যায়। বিজ্ঞান, বস্তু আর বাণিজ্যের তৃফলায় কুসংস্কারের টিকে থাকার যো নেই। কিন্তু পিছু ডাকার ব্যাপারটা আলাদা। আগে যে পিছু ডাকত সে অপরাধবোধে মিনমিন করে বলত সেই প্রয়োজনীয় কথাটা, আর যাত্রীও ‘হ্যাঁ, তাই তো! ভুলেই গেছিলাম!’ ‘বেশ মনে রাখব’ বা ‘ঠিকাছে’ বলে চলে যেত। আর বাকি যে চোখগুলো এতক্ষণ পাকানো ছিল বক্তার দিকে, সেগুলোও বদলে যেত। প্রত্যুৎপন্নমতির প্রতি কৃতজ্ঞতায়। এখন হলে উল্টে বলবে ‘এই কথাটা হোয়াটসঅ্যাপ করে বলা যেত না?’
পিছু ডাকার প্রতি এই অ্যাপ্রোচের বুৎপত্তি বলা হয় লোকগল্পে। এখন লোকগল্প তো মানুষের যাপনের মধ্য থেকেই উঠে আসত। সেক্ষেত্রে পিছু ডাকার ব্যাপারটাও ডিম না মুরগির মতো পিংপং তর্কেই আটকে গেল। পিছু না ডাকার কারণ হিসেবে এমনিতে সবচেয়ে চালু যুক্তি যেটা দেওয়া হয়, তা হল কাজ করতে যে-যাত্রী বেরচ্ছে, তার মনোযোগটা যাতে নষ্ট না হয়। কিন্তু তলিয়ে দেখা যাবে এর একটা ভৌতিক যোগও আছে! আগের কালে যাত্রার সময় নিশির ডাকের ভয়টা খুব প্রচলিত ছিল। বাড়ির কারও গলা নকল করে নিশিভূত ডাকলে কোনও ভাবেই যাতে যাত্রী ঘুরে না তাকায়, সে বন্দোবস্তটা পাকা করার জন্যই পিছু না ডাকার প্রথাটা হয়তো ডিভাইস করা হয়ে থাকতে পারে। অর্থাৎ ঘুরিয়ে যাত্রীকে এটা বুঝিয়ে দেওয়া ‘একটা কথা মনে রেখে দিও, হাজার প্রয়োজনেও পিছু ডাকা অপয়া, তাই বাড়ির কেউ এমন অপয়া কাজ করবে না, যদি কেউ পিছু ডাকে, তবে তা চোখবুজে ভূতের ডাকই হবে নির্ঘাৎ!’
………………………………
কিন্তু ভূত? ভূতের হাত থেকে বাঁচানোটা যদি প্রয়োজনীয়তা না হয় তবে কোনটা প্রয়োজনীয়? নিশি ভূতের ভয় যাদের ছিল তার পিছু না ডাকার প্রথাটা তৈরি করে নিশি ভূতকে শায়েস্তাই করতে চেয়েছে শুধু। ‘তুমি মা, বোন, স্ত্রী– যাদের খুশি গলা নকল করে নাও না কেন, আমার যারা ভালো চায় তারা যে আমার পিছু ডাকবে না– এ আমি খুউব জানি।’ সেকালে যাত্রীর কনফিডেন্স ছিল এটাই। নিশিভূত যদি বুনো ওল হয় পিছু না ডাকার সংস্কার ছিল বাঘা তেঁতুল।
……………………………….
কুসংস্কার সাধারণত তিনপ্রকার। ক্ষতিকর, নিউট্রাল, জরুরি। কালো বিড়াল নিয়ে কুসংস্কারটা যেমন কালো বিড়ালদের ক্ষতি করেছে অকথ্য। ভাঙা আয়নার কুসংস্কারটা মনে মনে খুঁত খুত করলেও খুব একটা প্রভাব ফেলেনি জীবনে। ওর কোনও এগিয়ে যাওয়ার বা পিছিয়ে পড়ার ব্যাপার নেই। নিউট্রালেই রয়েছে। কিন্তু ভূত? ভূতের হাত থেকে বাঁচানোটা যদি প্রয়োজনীয়তা না হয় তবে কোনটা প্রয়োজনীয়? নিশি ভূতের ভয় যাদের ছিল তার পিছু না ডাকার প্রথাটা তৈরি করে নিশি ভূতকে শায়েস্তাই করতে চেয়েছে শুধু। ‘তুমি মা, বোন, স্ত্রী– যাদের খুশি গলা নকল করে নাও না কেন, আমার যারা ভালো চায় তারা যে আমার পিছু ডাকবে না– এ আমি খুউব জানি।’ সেকালে যাত্রীর কনফিডেন্স ছিল এটাই। নিশিভূত যদি বুনো ওল হয় পিছু না ডাকার সংস্কার ছিল বাঘা তেঁতুল। একটা এআই-এর ভুল ধরতে আমরা যেমন লড়িয়ে দিই আরেক এআইকে আমাদের অগ্রজরাও তেমনই একটা কুসংস্কারকে আরেকটা কুসংস্কার দিয়ে পরাস্ত করতে চেয়েছিল মাত্র। তাই আজও টিকে গিয়েছে পিছু না ডাকার চল। যুক্তির হাতিয়ার হয়ে উঠে এসেছে ‘হোয়াটসঅ্যাপ করে দেওয়া যেত না?’
প্রায় চারশত খ্রিস্টপূর্ব সময় চিনে এই কুসংস্কারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘সাং-হাই-জিন’-এর একাধিক জায়গায় বারবার উল্লেখ করা হয়েছে একই কথা। ইনিয়ে-বিনিয়ে যেটা বলা রয়েছে, তা হল যাত্রাকালে বিশেষত জঙ্গলের কাছে কোনও রকম কণ্ঠস্বর বা ডাক শুনলে ঘুরে তাকানোর সাহস যেন না করে কেউ। ‘তাও’ জামানায় ‘বাওপুজি’ লেখার সময় এই পিছু ডাকার স্বভাবটাকে অশুভ আত্মার প্রভাব বলে ধরে নেওয়া হত। সেক্ষেত্রে কোনও মানুষ যদি ভুল করেও ডেকে ফেলে কারও পিছু তাহলে ধরে নিতে হবে অলক্ষ্যের কোনও আত্মার কারসাজি সেটা। তাই কারও মনে পিছু ডাকার চিন্তা এলেও সে সঙ্গে সঙ্গেই সতর্ক হয়ে যাবে, নিজেকে বোঝাবে, ‘এ আমি নই, ভূতে আমাকে দিয়ে এ কাজ করাতে চাইছে ইত্যাদি ইত্যাদি।’ উলফার্ম এবেরহার্ড সাহেব প্রায় ১৭-১৮ বছর চিন দেশে ঘুরে ‘চাইনিজ ফেস্টিভাল’ নামক যে বইটি প্রকাশ করেন, সেখানে পিছু না ডাকার প্রথা দিয়ে বিদেহি আত্মাকে দূরে রাখার যে কত পুরনো চেষ্টা তার একটা চমৎকার রূপরেখা দিয়ে গিয়েছেন।
জাপানে বাংলার নিশিভূতের যে সংস্করণ পাওয়া যায়, তার নাম ‘কিৎসুনে’। বলা হয়, কিৎসুনে হল শেয়াল ভূত যে মানুষের গলা নকল করে মানুষে নাম ধরে ডাকে। ‘কোজিকি’ বা ‘ফুরুকোতোবুমি’তে কিৎসুনের কথা অনেক পাওয়া যায়। তবে শুধু যে প্রাচ্য এমন নয়, পারস্যে ‘রুস্তম’-এর কাহিনিতে যে শ্বেত দানব বা ‘দিইব এ শপিদ’-এর উল্লেখ আছে সে-ও পিছু ডাকার ছলনায় ভোলাতে কম চায়নি রুস্তমকে। পশ্চিমের আরও অভ্যন্তরে আইরিশ লোকগাথা বা ‘মেলিয়াস’-এর কাহিনিতে পিছু ডাকা যে অপয়া, তাও বলা হয়েছে সুস্পষ্টভাবে।
কিন্তু যে কোনও কুসংস্কারের মতোই পিছু ডাকার ভয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারে প্রেম। সে আহ্লাদে পিছু ডাকতে গর্বিত আর স্বচ্ছন্দই শুধু নয়, পিছু ডাক শোনার জন্যে ব্যাকুলও। এবং অনেক ক্ষেত্রেই প্রেম যেহেতু মৃত্যুকেও পরোয়া করেনি তাই জেঠিমা, কাকিমারা প্রেমকে ‘নিশির ডাক’ বলে টিটকিরিও কম দেয়নি। তাও প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা, বিশেষত যে সময়টা সবে সবে সমর্পণ করতে রাজি হয়েছে একে-অপরকে, সে সময় একটা গোটা দিন গা ঘেঁষাঘেষি করে থাকলেও রাতে ফিরে যাওয়ার সময়, মনে মনে চায় পিছন থেকে অন্তত একবার ভেসে আসুক ‘শুনছ?’
……………..অপয়ার ছন্দ অন্যান্য পর্ব……………..
পর্ব ৫। ডানা ভাঙা একটি শালিখ হৃদয়ের দাবি রাখো
পর্ব ৪। জন্মগত দুর্দশা যাদের নিত্যসঙ্গী, ভাঙা আয়নায় ভাগ্যবদল তাদের কাছে বিলাসিতা
পর্ব ৩। পশ্চিম যা বলে বলুক, আমাদের দেশে ১৩ কিন্তু মৃত্যু নয়, বরং জীবনের কথা বলে
পর্ব ২। শনি ঠাকুর কি মেহনতি জনতার দেবতা?
পর্ব ১। পান্নার মতো চোখ, কান্নার মতো নরম, একা