লোকে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে-পতাকা একদিন বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা কিনা আজ ভূলুণ্ঠিত! কী বলবে মাথায় ঢুকছিল না। কবি য়েভগিয়েনি য়েভ্তুশিয়েনকো নিজেই হতভম্ব হয়ে ওখানে ঘণ্টা দুয়েক দাঁড়িয়ে রইলেন। অনেকের কাছেই এ এক ট্র্যাজেডি। কিন্তু অনেকে, অনেকের মধ্যে কবি নিজেও তো এক সময় মনে মনে সোভিয়েত শাসনের অবসানই কামনা করেছিলেন।
৬.
মধ্যরাতে বিপ্লবের অপমৃত্যু
তবে ১৯৯১ সালের ২৫-২৬ ডিসেম্বর মধ্যরাতে যখন ক্রেমলিনের মাথা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় পতাকা নামিয়ে দেওয়া হয়, সেদিন সাধারণ মানুষের অনুভূতি অবিমিশ্র ছিল না। সে দৃশ্য দেখার জন্য সেদিন মাঝরাতে মস্কোর রেড স্কোয়ারে লোকজনের ভিড়ে উপচে পড়েছিল। সেই ভিড়ের মধ্যে নতুন রাশিয়ার সরকারের উৎসাহী সমর্থক কবি য়েভগিয়েনি য়েভ্তুশিয়েনকো-ও উপস্থিত ছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতার কথাই শোনা যাক:
“সকলেই নীরব দর্শক। কারও মুখে টু শব্দটি নেই, কোনও ঠাট্টাতামাশা শোনা যাচ্ছে না, ধারে কাছে পাগল-টাগল কেউ নেই। সকলে এমনভাবে তাকিয়ে আছে, যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না, যেন ভাবতেই পারছে না আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এই পতাকা নামিয়ে ফেলা হবে। কিন্তু পতাকা যখন নেমে এল তখন সকলের চোখ বেয়ে হু হু করে জল নেমে এল। না, কোনও ফোঁপানি অবশ্য শোনা যাচ্ছিল না। লোকে যেন যন্ত্রণায় বোবা হয়ে গেছে। কেউ কেউ চোখ বুজে ফেলল। …লোকে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে-পতাকা একদিন বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা কিনা আজ ভূলুণ্ঠিত! কী বলবে মাথায় ঢুকছিল না।”
কবি নিজেই হতভম্ব হয়ে ওখানে ঘণ্টা দুয়েক দাঁড়িয়ে রইলেন। অনেকের কাছেই এ এক ট্র্যাজেডি। কিন্তু অনেকে, অনেকের মধ্যে কবি নিজেও তো এক সময় মনে মনে সোভিয়েত শাসনের অবসানই কামনা করেছিলেন।
এখানে আরও দশজন সাধারণ মানুষের মতো কবিরও পরস্পরবিরোধী মনোভাব প্রকট। এমনকী, অনেক সময় সোভিয়েত পতাকার দুর্গতি দেখে রুশ জাতির আহত শ্লাঘার কথা ভেবে আঁতকে ওঠেন তিনি:
“বিদায়, আমাদের লাল পতাকা,
আমাদের নিষ্পাপ শৈশবে আমরা
‘সাদা’ আর ‘লালে’
খেলেছি অনেক খেলা,
সাদাদের পিটিয়েছি জোর।
আজন্ম ছিলাম এমনই একটা দেশে
যার আর কোনও অস্তিত্বই নেই আজ।
কিন্তু সেই আটলান্টিসে
আমরা ছিলাম বেঁচে
ভালবাসা নিয়ে বুকে।
ইজমাইলোভোর বাজারে
বিছানো রয়েছে আজ
আমাদের লাল পতাকা:
আশা আছে, যদি ভাগ্য ভালো থাকে
বেচে লাভ হতে পারে
দু-একটি ডলার।
জারের শীতপ্রাসাদ দখলকারীদের দলে
আমি ছিলাম না,
রাইখ্স্টাগে ঝটিকা আঘাত
হানতে যাইনি আমি,
‘কমি’দের দলে আমি নই,
তবু এই ভূলুণ্ঠিত পতাকার গায়ে
হাত বুলিয়ে আমি আদর করি,
আমি কাঁদি।”
কবিতাটি কবি লেখা শুরু করেছিলেন ১৯৯১-তে, শেষ করলেন ১৯৯২-তে। এরই মাঝখানে দেশত্যাগ করে বাস উঠিয়ে সপরিবারে চলে গেলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কী তাঁর প্রত্যাশা ছিল এই ভাঙা হাটে? কী পাননি তিনি? জবাব মেলেনি। তবে তাঁর এই কবিতাটি সেই সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের স্তোত্রগাথা হয়ে উঠেছিল।
সেদিন ক্রেমলিনের চূড়া থেকে চুনি পাথরের বিশাল লাল তারাটাও নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু সম্ভব হয়নি– আজও তা সেখানে সমান জ্বলজ্বল করছে।
কতই না ওলটপালটের সাক্ষী হয়ে রইল বিংশ শতাব্দী। শতাব্দীর সূচনায় একটি দেশে কয়েক শতাব্দী ব্যাপী রাজকীয় শাসনের অবসান ঘটল, সেখানে পরপর দু’টি বিপ্লব (নাকি অভ্যুত্থান?) সংঘটিত হল, প্রতিষ্ঠিত হল সোভিয়েত সমাজব্যবস্থা, শতাব্দীর মাঝামাঝি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা দুনিয়ায় তার প্রভাব প্রতিপত্তিও বৃদ্ধি পেল; আবার শতাব্দীর শেষপ্রান্তে এসে সেই আধিপত্যের অবসানও ঘটল। সারা দেশ এবং সেই সঙ্গে গোটা দুনিয়াকেও রেখে গেল এক অনিশ্চিত টালমাটাল অবস্থার মধ্যে।
…পড়ুন রুশকথার অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি