এই উপলব্ধিটা শুধু আমার একার নয়, অনেকের। আমি শম্ভু মিত্রের লেখাতেও পড়েছি। এই যে নাটক শব্দটিকে মিথ্যের প্রতিশব্দ বলে প্রতিপন্ন করা, এর দৃষ্টান্ত আজকের দুনিয়ায় প্রচুর। অনেক সময় দেখি, রাজনীতিবিদরা নিয়মিত বলে থাকেন, ‘উনি নাটক করছেন?’ আর সেটা শুনে আমার মতো নাটক করিয়ে লোকের ভিতরটা দড়াম দড়াম করে ভেঙে পড়ে। আমি যে কাজটা করি, সেটা কি মিথ্যের কারবার!
৮.
আমাদের নাট্যকলাকে বলা হয় সংযুত শিল্প, কখনও আবার বলা হয় তিলোত্তমা শিল্প। তিলোত্তমা যা কি না সমগ্র পৃথিবীতে আছে, তাকে ব্যবহার করা যায় নাটকের কাজে, যাত্রাপালার কাজে। অর্থাৎ সবকিছুর ঠাঁই আছে নাটকে, কোনও কিছুই অচ্ছুৎ নয়। এই সমস্ত উপাদানের শ্রেষ্ঠ উপকরণটি বা প্রাণ হল– অভিনয়। প্রাণ বলতে তো শুধু একটি বস্তুবিশেষকে বোঝায় না, অনেক কিছুকেই বোঝায়। জলকে আমরা যেমন জীবন বলি, তেমনই নিশ্বাস-প্রশ্বাসকে জীবনের দ্যোতক হিসেবে দেখি। এসমস্ত কিছুর সমাহারেই তো জীবন বহমান, সচল থাকে। নাটকের ক্ষেত্রে বা তিলোত্তমা শিল্পের ক্ষেত্রেও অভিনয় ঠিক তেমনই, সঞ্জীবনী শক্তি। তাকেই আমার শ্রেষ্ঠ বা অন্যতম উপাদান বলে মনে হয়।
নাটক এবং অভিনয় পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে আছে। জুড়ে আছে বলেই নাটকের টানে মানুষ ছুটে আসেন। অপরিচিত কেউ সৌজন্যবশত আলাপচারিতায় জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি নাটকে অভিনয় করো?’ ছোটবেলায় যাত্রাপালা দেখতে দেখতে, বাবার অভিনয় দেখতে দেখতে, অন্যান্য নাটক দেখতে দেখতে ক্রমশ নাটকের তাঁবু খাটল মনের ভিতরে। আমার মধ্যে আসলে বসত করছিল কে? কার জন্য বসত করছিল? এই তাঁবুর আধারটি কে? এই আধার ছিল মূলত অভিনয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ব্যাপক বৃষ্টি ঝরে যখন বুকের ভিতরে, সেই সময়ে একটা লেখা পড়েছিলাম পূর্ণেন্দু পত্রীর, গল্পের নাম মনে নেই আজ আর। গল্পের শেষে কেউ একজন কল্পনা করছেন, তার প্রেমের কল্পনা। এক পুরুষ কল্পনা করছেন এক নারীকে নিয়ে। সেই নারী যথার্থ কোনও উপহার হয়তো রেখে গেছেন পুরুষটির মাথার কাছে, সেটা হয়তো একগোছা ফুল বা এমনকিছু। কিন্তু এটা ঘটেনি। অথচ পুরুষটি এটাই কল্পনা করছেন, এবং বিশ্বাস করছেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আমি অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছি, অভিনয় দেখে প্রাণিত হয়েছি, আমি অভিনয় দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছি, আমি অভিনয় দেখে ব্যথিত হয়েছি। এই রকম করতে করতে অভিনয়কেই মনে হয়েছে যেন নাটকের আরেক নাম। এর মধ্যে একটু স্বার্থপরতা আছে। যেহেতু আমি অভিনয় করি, তাই অভিনয় সত্যি– এমন একটা শব্দ কিংবা ক্রিয়া যা ছাড়া নাট্যক্রিয়া সম্পূর্ণ হতে পারে না। এবং তার একটা অদ্ভুত চেহারা আছে। সেই চেহারাকে আমরা অভিনেতার মধ্য দিয়ে দেখতে পাই, নাট্যের মধ্য দিয়ে দেখতে পাই।
বহু বহু আগে আমার কৈশোরে, যখন বড় হচ্ছি, আমার বয়ঃসন্ধির সময় যখন জীবনের রহস্যগুলো উন্মোচিত হচ্ছে, একইসঙ্গে বুকের ভিতরের নানারকম অনুভূতি, ঠিক অনেকটা সেই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মতো–
‘বুকের মধ্যে বৃষ্টি নামে নৌকা টলমল
কুল ছিঁড়ে আজ অকূলে যাই এমন সম্বল
নেই নিকটে; হয়ত ছিল বৃষ্টি আসার আগে–’
ব্যাপক বৃষ্টি ঝরে যখন বুকের ভিতরে, সেই সময়ে একটা লেখা পড়েছিলাম পূর্ণেন্দু পত্রীর, গল্পের নাম মনে নেই আজ আর। গল্পের শেষে কেউ একজন কল্পনা করছেন, তার প্রেমের কল্পনা। এক পুরুষ কল্পনা করছেন এক নারীকে নিয়ে। সেই নারী যথার্থ কোনও উপহার হয়তো রেখে গেছেন পুরুষটির মাথার কাছে, সেটা হয়তো একগোছা ফুল বা এমনকিছু। কিন্তু এটা ঘটেনি। অথচ পুরুষটি এটাই কল্পনা করছেন, এবং বিশ্বাস করছেন। গল্পটার শেষে পূর্ণেন্দু পত্রী প্রেমের সংজ্ঞা দেওয়ার মতো করে বলছেন খানিকটা এইভাবে– এই যে মিথ্যে, এই মিথ্যেকে সাজিয়ে গুছিয়ে মানুষ ব্যথিত হওয়ার, বুকে কষ্ট ঝরানোর যে সুখ পায়, সেটিই প্রেম। কৈশোরকালে প্রেম সম্পর্কে এই ধারণাটি বেশ মনে ধরেছিল, এখন কেমন লাগে বলতে পারব না। তবে যখনই কথাটা ভাবি, কৈশোরের মনটাকে বাঁচিয়ে রেখে ভাবি বলে কথাগুলো বিশ্বাস্য বলে মনে হয়।
কিন্তু একেই কি প্রেম বলে? এই যে ব্যথিত হওয়ার, কষ্ট ঝরানোর অনুভূতি? আমি কষ্ট পেয়ে আনন্দ পাচ্ছি, আমি ব্যথিত হয়ে উদ্বেলিত হচ্ছি। এই কথাগুলো অনেক পরে আমার মনে পড়েছে অভিনয়ের ক্ষেত্রেও। ছোটবেলায় যখন যাত্রাপালা দেখছি, তখন নায়কের কিংবা পার্শ্বচরিত্রের বা নায়িকার কষ্টে আমার ভিতর থেকেও কষ্ট মুচড়ে উঠছে, গলার কাছে যেন দলা পাকিয়ে উঠছে কিছু। কান্না ঠেলে আসছে। আমি জানি, এটি মিথ্যে। জানি যে, নাটক দেখছি, যাত্রাপালা, সিনেমা কিংবা অভিনয় দেখছি, এটা সত্য নয় সেই অর্থে। তবু আমার মধ্যে একটা সত্য অনুভব মেঘের মতো গর্জন করছে। এই বুঝি বৃষ্টি নামাল বলে। এই যে অনুভব তৈরি করে দিচ্ছেন, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা, নাট্যদলটি বা যাত্রাপালার কলাকুশলীরা, এই বোধটা আমাকে তাড়া করে বেড়াত। যখনই ভাবতে বসেছি, এটা কী করে সম্ভব, এটা তো সত্য নয়। তবু কেন আমি কষ্ট পাই, কিংবা আমার আনন্দ হয় মনে, মনটা খুশিতে ভরে যায়। কখনও ডানা মেলে উড়তে ইচ্ছে করে। হয়তো নাটকের কোনও একটা গান শুনলাম, কোনও মিউজিক শুনলাম, শুনে যেন মনে হয় মনটা ভাসমান, আমি উড়ছি। তখন আমি আর দর্শকাসনে বা ফরাসের ওপর বসে নেই। আমি উড়তে শুরু করেছি মাধ্যাকর্ষণকে অস্বীকার করে, শুধু একটা সঙ্গীতে, সংলাপে। তাহলে এই যে মিথ্যে, যা ধ্রুব সত্য, তা নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভীষণ ভাবে।
তাহলে নাটক কি মিথ্যের প্রতিশব্দ, সমার্থক? এই উপলব্ধিটা শুধু আমার একার নয়, অনেকের। আমি শম্ভু মিত্রের লেখাতেও পড়েছি। এই যে নাটক শব্দটিকে মিথ্যের প্রতিশব্দ বলে প্রতিপন্ন করা, এর দৃষ্টান্ত আজকের দুনিয়ায় প্রচুর। অনেক সময় দেখি, রাজনীতিবিদরা নিয়মিত বলে থাকেন, ‘উনি নাটক করছেন?’ আর সেটা শুনে আমার মতো নাটক করিয়ে লোকের ভিতরটা দড়াম দড়াম করে ভেঙে পড়ে। আমি যে কাজটা করি, সেটা কি মিথ্যের কারবার! এই প্রশ্নসাপেক্ষে যে উত্তর খুঁজে পাই, অভিনয়ের সময় আমরা একটা ঘটনাকে তুলে ধরি, যে ঘটনা আমার জীবনে এই মুহূর্তে ঘটছে না, কিন্তু আমি এমনভাবে সেই ঘটনার সঙ্গী হচ্ছি, ঘটনাটির হাত ধরছি, ঘটনাটির স্রোতে গা ভাসাচ্ছি, এবং ঘটনার ঘনঘটায় নিজেকে রাঙিয়ে নিচ্ছি যে, যেন এটি এই মুহূর্তে ঘটছে, এমন একটা ধারণা বা ভাবনা আমার সঙ্গে যারা অভিনয় করছেন বা অভিনয় দেখছেন তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে। একটা মিথ্যেকে সত্যি করে তুলছি– কেন বলছি একথা? কারণ, এই ঘটনার বাইরে যারা, সেই ‘নিরপেক্ষ’ দর্শকের সামনে ঘটনাকে উপস্থাপিত করে আমি বা আমরা প্রভাবিত করার চেষ্টা করছি যা সত্য বলে উপলব্ধ, তারা কি সেটাকেই ঠিক বলে মনে করে? নাকি বিরোধিতা করে? অর্থাৎ আমার উপস্থাপিত অভিনয়, নাটকের গল্পের মধ্য দিয়ে সেই সত্যকে বিচারের জন্য ছেড়ে দিচ্ছি দর্শকের সামনে। বাস্তব জীবনে এমনটা কখনও ঘটে না। সেখানে আমার সামনে যিনি, তার সঙ্গে নানা কথাবার্তায়, যুক্তি-তর্কের পারম্পর্যে এগিয়ে চলি। কিন্তু নাটকের ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থিত দর্শকের সামনে আমি নিজেকে যাচাই করতে চাইছি প্রতি পদক্ষেপে। আর সেই দৃষ্টিকোণে বিচার করলে নাটক মোটেই মিথ্যের প্রতিশব্দ নয়। আসলে নাটক শব্দটি জীবনের চেয়েও কোনও সত্যের অন্বেষণের দিকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে চলেছে। একজন অভিনেতার কাছে এটাই বিশ্বাসের জায়গা। অভিনয় আসলে একটা যাপন, সেই যাপনধর্মের কোনও শেষ নেই। আসলে নাটকের মধ্যে একটা পরীক্ষালব্ধ সত্য আছে, যা জীবনের চেয়েও বড়। কিন্তু একথাও সত্য, অভিনয় হল সেই রূপসীর মতো, যাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যতই শব্দ খুঁজি, তা যেন ব্যাখ্যাতীত হয়ে থাকে। সেই উপলব্ধি শব্দ দিয়ে মালা গেথে তুলে ধরার ক্ষমতা একজন অভিনেতারও নেই।
…পড়ুন নাটুয়া-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৭। আমার পুরনো মুখটা আমাকে দেখিয়ে তবেই সাজঘর আমাকে ছাড়বে
পর্ব ৬। মঞ্চে আলো এসে পড়লে সব আয়োজন ভেস্তে যায় আমার
পর্ব ৫। আমার ব্যক্তিগত রং আমাকে সাহস জোগায় নতুন রঙের চরিত্রে অভিনয় করতে
পর্ব ৪। একটা ফাঁকা জায়গা ও বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ৩। আমার অভিনয়ের গাড়িতে আমি অন্য সওয়ারি চড়িয়ে নিয়েছি আমার জন্যই
পর্ব ২। অন্যের চোখে দেখে নিজেকে রাঙিয়ে তোলা– এটাই তো পটুয়ার কাজ, তাকে নাটুয়াও বলা যেতে পারে
পর্ব ১। বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন?