৮.
একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
১৯১৭ সালে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যে কোনও রাঁধুনিকে এমনভাবে শিক্ষিত করে তুলতে হবে, যাতে সে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে।
১৯২০ সালে সমগ্র দেশের বৈদ্যুতীকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, সমাজতন্ত্র হল সোভিয়েত শাসন ক্ষমতা ও সেই সঙ্গে বৈদ্যুতীকরণ। কাজেই বিশ শতকের বিশ ও তিরিশের দশকে সাধারণের মধ্য থেকে প্রশাসনের দায়িত্বে অনেককেই উঠে আসতে দেখা গিয়েছিল। সমাজে নারীর অবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। (যদিও অবশ্য শাসনক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরে নারীর স্থান কখনওই উল্লেখ করার মতো হয়ে উঠতে পারেনি।)
কিন্তু সাতের দশক নাগাদ সেসব চুলোয় যায়।
GOELRO বা রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বৈদ্যুতীকরণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে সমগ্র দেশে সোভিয়েত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলির উৎপাদন শক্তি ১৯২০ সালে যেখানে ঘণ্টায় ০.৫ বিলিয়ন কিলোওয়াট ছিল, সেখানে ১৯৩৫ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২৮.৩-এ এসে দাঁড়ায়।
১৯২৬-এর ২৩ জানুয়ারি য়ুসেফ স্তালিন একটি রাষ্ট্রে এককভাবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন। সেটা করার জন্য তিনি দেশে যে ব্যবস্থার প্রচলন করলেন, তা ‘স্বাধীনভাবে সমবেত জনগণের সম্মিলিত স্বাধীন শ্রম’-এর যে সংজ্ঞা সমাজতন্ত্রের ক্লাসিকাল ব্যাখ্যার অন্তর্ভুক্ত, তার সম্পূর্ণ প্রতিকূলে চলে গেল। ১৯৩৫ সাল নাগাদ শ্রম সামাজিক দায়িত্ববোধের জায়গায় বাধ্যতামূলক শ্রমে পরিণত হওয়ার ফলে দেখা গেল, দেশের প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষ যেন বন্দি শ্রমশিবিরে বসে কাজ করছে।
নিকিতা খ্রুশ্শোভ ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে মস্কোর পোলিশ দূতাবাসে এক সাক্ষাৎকারের সময় পশ্চিমকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘আপনাদের পছন্দ হবে, কি হবে না, জানি না, তবে ইতিহাস আমাদের পক্ষে। আমরা আপনাদের পরেও টিকে থাকব, আপনাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত থাকব।’
১৯৬১ সালে বলেছিলেন, বর্তমান প্রজন্মের সোভিয়েত মানুষরা কমিউনিজমে জীবনযাপন করবে। কার্যত ১৯৯১ সালে সমাজতান্ত্রিক পথে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিকাশে ছেদ পড়ল।
শেষবার ‘কমিউনিজমের বৈষয়িক ও প্রযুক্তিগত ভিত্তি’ গড়ে তোলার অবশ্য প্রয়োজনীয়তার কথা শোনা গিয়েছিল ১৯৮১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ২৬তম কংগ্রেসের সময়।
মিখাইল গর্বাচ্যোভ ১৯৮৫ সালে বলেছিলেন, ২০০০ সালের মধ্যে প্রতিটি পরিবারের জন্য পৃথক ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ওই বছর বলেছিলেন, রুশিদের মদ্যপানের অভ্যাস ছাড়া শেখানো দরকার।
ছয় বছরের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থারই পতন ঘটল। কিন্তু তারও পরে অন্তত ২০০৯ সাল পর্যন্ত যে সংবাদ, তাতে দেখা যাচ্ছে ,আজও ৪.৫ মিলিয়ন পরিবার পৃথক ফ্ল্যাটের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে আছে। অবশ্য এখন আর ফ্ল্যাট দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের কোনও দায়দায়িত্ব নেই।
১৯৮৫ সালে গর্বাচ্যোভের মদ্যপান বিরোধী প্রচারের সূচনায় যেখানে জনসংখ্যার মাথাপিছু খাঁটি স্পিরিট জাতীয় মদ্যপানের মাত্রা বছরে ৩.৫ লিটার পর্যন্ত নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল সেখানে ২০০৯ সালে তা ২০ লিটারের কাছাকাছি চলে গিয়েছে। মনে রাখতে হবে, শিশু ও মদ্যপান বর্জনকারীরাও এই গড় হিসাবেরই অন্তর্ভুক্ত। সোভিয়েত ইউনিয়নের ৭০ বছরের ইতিহাসে সোভিয়েত রাষ্ট্রের মাত্র দু’জন কর্ণধার ছিলেন উচ্চশিক্ষিত– দু’জনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন শাস্ত্রের ডিগ্রিধারী: একজন সোভিয়েত রাষ্ট্রের স্রষ্টা লেনিন, অন্যজন সেই রাষ্ট্রেরই বিলোপসাধনকারী গর্বাচ্যোভ।
বরিস ইয়েলৎসিন অবশ্য কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে সেরকম কোনও প্রতিশ্রুতি দেননি, অথবা তা দেওয়ার মতো যথেষ্ট উচ্চক্ষমতায় তিনি কমিউনিস্ট আমলে অধিষ্ঠিত ছিলেনও না। কিন্তু ১৯৯১ সালের গ্রীষ্মকালে মস্কোর পুশকিন স্কোয়ারের এক জনসমাবেশে (ততদিনে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত বৃহত্তম ফেডারেশন রুশ ফেডারেটিভ প্রজাতন্ত্রের কর্ণধার) ডেমোক্রাট হিসেবে তিনি কথা দিয়েছিলেন: ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে রেলের চাকার তলায় মাথা পেতে দেব।’ ১৯৯৮ সালের আগস্ট মাসের প্রায় ৭ বছর আগেই সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, ততদিনে তিনি দেশের হর্তাকর্তাবিধাতা– রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। তখন তিনি কথা দিয়েছিলেন: ‘রুবলের মূল্যমান হ্রাসের কোনও সম্ভাবনা নেই।’
কিন্তু ১৯৯২ সালের ২ জানুয়ারি থেকে রাতারাতি বাজার খুলে দিয়ে মুক্ত অর্থনীতি প্রবর্তনের ফলে বাজারদর সঙ্গে সঙ্গে ২০-৪০ ভাগ বৃদ্ধি পেল। অথচ রেলের চাকার তলায় মাথা পেতে দেওয়ার কোনও গরজ ইয়েলৎসিন দেখালেন না। ও কথা মনে করিয়ে দিতে তাঁর শিষ্যসামন্তরা বললেন ‘ও একটা কথার কথা।’ মনে আছে দূরদর্শনের পর্দায় দেখা গেল ‘ইয়েলৎসিন’ বরং বুক ফুলিয়ে বলছেন, ‘‘কে বলছে বাজারে কিছু নেই? এই কুমড়ো থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার ‘কিউই’ ফল সর্বত্র আছে।’’ একজন জিজ্ঞেস করল ‘কিউই’টা আবার কী বস্তু? তাতে নেতা করুণার হাসি হেসে বললেন, ‘তাও জানেন না? তাহলে আর কী বলব?’
আর ১৯৯৮ সালের প্রতিশ্রুতি? যেদিন তিনি এই প্রতিশ্রুতি দিলেন, তার তিনদিন পরেই রুবলের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে ডলার পিছু ৬ থেকে ২১-এ নেমে গেল।
(চলবে)