আমি যদি কোনও ভুল করে থাকি জীবনে, কোনও অপরাধ করে থাকি, কাউকে দুঃখ দিয়ে থাকি, তাহলে এই কাজটা করা, জেলের ছেলেমেয়েদের নাচ শেখানোই আমার শাপমোচন। ওদের শাপমোচন আমি করিনি। ওদের জন্য আমার শাপমোচন হয়েছে। জেল নাকি সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গা, সেখানে খারাপ মানুষেরা থাকে, কিন্তু আমার মন খারাপ হলে, আমি ওদের কাছে যাই, জেলে যাই।
৮.
জেলের যে গাছের নীচে শ্রীঅরবিন্দর বাসুদেব দর্শন হয়, সে জায়গাটায় আমি একটা কৃষ্ণমূর্তি রেখে দিয়েছি ওদের জন্য। জেল থেকেই কিন্তু শ্রীঅরবিন্দের আধাত্মিক-জীবনের শুরু। উনি জেলকে ‘আশ্রম’ বলতেন। শ্রীঅরবিন্দের কথা ওদের বারবার বলতে থাকি আমি। যতই ওঁকে ‘ঋষি’ বলি না কেন আমরা, আসলে তো উনি রক্ত-মাংসের। একইসঙ্গে তিনি রাডিক্যাল বিপ্লবী। সেই মূর্তিটাকে ঘিরে ওরা একটা মন্দির মতো বানিয়ে ফেলেছে, আর কী মগ্ন হয়ে ওরা কৃষ্ণের আরাধনা করে, তা দেখার মতো। আর সবসময় বলতে থাকে মা, তুমি না আসলেও তোমার দেওয়া কৃষ্ণ আমাদের কাছে থেকে যাবে। আমার তাই এখন একটাই চিন্তা, আমার পরে যেন কেউ আসেন, এটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যে-ই আসুন, তিনি নিজের মতো করে গড়ে নেবেন, নিজের পদ্ধতিতে শেখাবেন। কিন্তু এইটা যেন বন্ধ না হয়ে যায়। হয়তো এত ম্যাগনাম আকারে নৃত্যানুষ্ঠান করার প্রয়োজন নেই। ছোট করেই হোক, কিন্তু হোক।
আমার সব জমানো টাকা দিয়ে এক-একবার অনুষ্ঠান করেছি। ছোট ছোট স্পনসর থাকলেও টাকার অভাব যায় না। শেষ পর্যন্ত নিজের গয়না বিক্রি করেছি অনুষ্ঠানটা করব বলে। কাউকে বলিনি এই কাজটা করেছি যে। শুধু আমার ছেলে জানত। পরে কেউ কেউ জানতে পেরে আমাকে বকাবকি করে, কিন্তু আমার বক্তব্য খুব স্পষ্ট ছিল। আমি আমার গয়নাগুলোকেও মুক্তি দিয়েছি। আমি শুধু চেয়েছি এই প্রকল্পটা যেন বন্ধ না হয়ে যায়। আমি হয়তো ভালোবাসার কাঙাল। সেই চাহিদাটা থেকেই আমি কাজটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। হয়তো অন্য মানুষ, অন্যভাবে এই কাজটাকে দেখবেন। তবুও কাজটা তো হবে। আমার ছেলেমেয়েগুলো তো একা থাকবে না। আর আমিও চাই আমার ছেলেমেয়েরা, আমার ছাত্ররা যেন ভালোবেসে আমার কাছে আসে। কোনও দায়িত্ব থেকে যেন নাচ না করে, আমার মুখ চেয়ে যেন এটার সঙ্গে যুক্ত না হয়। যে চাইবে না, সে অনায়াসে চলে যেতে পারে। কারণ আমিও যে দায়িত্ব থেকে করি না। দায়িত্ব করাটা আমার কাছে অপমানজনক।
আমি যদি কোনও ভুল করে থাকি জীবনে, কোনও অপরাধ করে থাকি, কাউকে দুঃখ দিয়ে থাকি, তাহলে এই কাজটা করা, জেলের ছেলেমেয়েদের নাচ শেখানোই আমার শাপমোচন। ওদের শাপমোচন আমি করিনি। ওদের জন্য আমার শাপমোচন হয়েছে। জেল নাকি সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গা, সেখানে খারাপ মানুষেরা থাকে, কিন্তু আমার মন খারাপ হলে, আমি ওদের কাছে যাই, জেলে যাই।
আমি সারাজীবন চাকরি করিনি, আমার তেমন কোনও নির্দিষ্ট রোজগার নেই। যতটুকু প্রয়োজন হয়, ততটাই আমার কীভাবে যেন জুটে যায়। ততটুকুরই কাজ করি। কখনও বেশিও পাইনি, কখনও কমও পাইনি। কোনও ভার আমি রাখিনি এই দুনিয়ায়। যতটা পেরেছি নির্ভার হয়ে থেকেছি। ভালোবাসায় থেকেছি। আমি চাহিদা খুব কম। আমার শখ-আহ্লাদ তেমন কিছু নেই। আমি অল্পতেই খুশি। শুধু কিছু মানুষের স্পর্শই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। যা করেছি জীবনে, তা কখনও ফেরত চাইনি। ফেরত চাওয়াতে আমি বিশ্বাস করি না। যদি ফেরত চাই, তাহলে সেটা আর আমার কর্ম নয়। ফেরত চায় বলেই বোধহয় মানুষ এত কষ্ট পায়। ভালোবাসাও ফেরত চাই না। যদি ভালোবাসতে ইচ্ছে করে ভালোবাসো। আর কিছু চাই না আমি। এই কাজটা থেকেও আমি কিছু চাইনি। যা পেয়েছি, তা আমার পরিকল্পনার বাইরে। তাই হয়তো এত বেশি বেশি পেয়েছি। ১০০ তম বাল্মিকী প্রতিভার আয়োজন চলছে। এটা অনেকটা ব্রডওয়ে শো-এর মতো। মানুষগুলো পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে, কিন্তু শো চলছে। এই শো যেন চলতে থাকে।