কবির বয়স তখন সদ্য ৪০ ছুঁয়েছে– সেবার বিলেতে গিয়ে লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে ফরাসি শিল্পীর আঁকা নগ্নিকা দেখে তিনি আপ্লুত উচ্ছ্বসিত। ডায়ারিতে লিখেছেন– ‘সেদিন French Exhibition-এ একজন বিখ্যাত artist-রচিত একটি উলঙ্গ সুন্দরীর ছবি দেখলুম। কী আশ্চর্য সুন্দর! দেখে কিছুতেই তৃপ্তি হয় না। সুন্দর শরীরের চেয়ে সৌন্দর্য পৃথিবীতে কিছু নেই। …এ রকম উলঙ্গতা কী সুন্দর!’ এখানে রবি ঠাকুরের ‘উলঙ্গ সুন্দরী’র মতো অমার্জিত শব্দচয়ন কিছুটা আহত করতে পারে আমাদের। এই অকপট ভাষ্য তাঁর ডায়েরির খসড়াবিশেষ। পরে ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়ারি’র মুদ্রিত পাঠে কবির কলম কিছুটা সেন্সারড, আরেকটু পরিমার্জিত। সেখানে ‘উলঙ্গ সুন্দরী’ হয়ে উঠেছে ‘বসনহীনা মানবী’।
৯.
রবীন্দ্রনাথের চিত্রভাণ্ডারে নানা বিষয়ের ছবি সঞ্চিত আছে। তার মধ্যে অন্যতম আশ্চর্য রকমের জ্যামিতিক আকৃতি, বিচিত্র জীবজন্তুর চেহারা– গবেষকরা যার নাম দিয়েছেন ‘Zoomorphic form’, ফুলের ছবি, স্থাপত্যের আকার, মুখ আর মুখোশ, নিসর্গ ইত্যাদি। তবে আমাদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে তাঁর গোধূলির আলোমাখা মায়াবী ল্যান্ডস্কেপ আর আয়তচোখের মেয়েরা। এই দুটো বিষয় রবি ঠাকুরের তুলিতে কি এক অলৌকিক মুহূর্ত রচনা করে।
নিসর্গের মুগ্ধতা তো আছেই। সেই সঙ্গে নারীমুখের অভিব্যক্তির গভীরে শিল্পী যেন অব্যক্ত অভিমান মিশিয়ে দেন, আয়তচোখের দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে অপ্রাপনীয় জগতের ইশারা। সূর্যোদয়ের আগে পুব আকাশের শুকতারার মতো সে চাহনি, নিস্পলক চেয়ে থাকে সামনের দিকে। অথচ দৃষ্টির বিস্তার দর্শকের নাগাল পেরিয়ে দূরে চলে যায়। নারীমুখের গড়ন এক নির্দিষ্ট টিপছাপে চিহ্নিত। ঘন বাদামি রঙে ডিমের মতো লম্বাটে মুখমণ্ডলের কপালজুড়ে ছড়িয়ে থাকে হাইলাইট– সেই আলো ক্রমশ বাঁশির মতো দীর্ঘ নাক চুইয়ে নেমে আসে। কোথাও বা সে সোনালি আলোকবিভা কপাল থেকে কপোলে গড়িয়ে আরেক রকম দ্যোতনা আনে। ছবিঠাকুরের মেয়েরা তখন ভিন্ন ভুবনের বাসিন্দা। তবে কি শুধুই নারীমুখের ছবি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ? কেবল কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখের দীঘল মুখমণ্ডল? উন্মুক্ত নারীদেহের যে আনন্দিত বন্দনা ফুটেছে তাঁর কবিতায়– ‘চিত্রা’ কাব্যের ‘বিজয়িনী’-তে যা চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে, তার কোনও ছায়া কি একেবারেই পড়েনি ছবিতে? পৌরাণিক আখ্যানের আড়ালে, ধর্মীয় কাহিনির বিস্তারে শিল্পের ইতিহাসে যুগে যুগে সৌন্দর্যের প্রতিমায় যে অজস্র নগ্নিকা উদ্ভাসিত– সেই নিরাবরণ নারী অবয়ব কি কখনও ধরা দিয়েছে ছবিঠাকুরের পটে? না কি অভিজাত ব্রাহ্মসংস্কৃতির ছোঁয়ায় এ হেন বিষয় থেকে সন্তর্পণে সরে দাঁড়িয়েছেন তিনি, পবিত্র শুচিতা বাঁচিয়ে বহু যোজন দূরে রেখেছেন নিজেকে? বিদেশের আর্ট গ্যালারিতে এমন ছবির ছড়াছড়ি, সেখানে দাঁড়িয়ে কি মনে হয়েছিল তাঁর? ছিটকে সরে গিয়েছিলেন ছবির সামনে থেকে, না শিল্পরসিকের মতো, চিত্রকরের উন্মুক্ত মন নিয়ে উপভোগ করেছেন সে ছবি? আশ্রমের ‘গুরুদেব’, সুপ্রিম-পাওয়ারের অভিধাযুক্ত গেরুয়াজোব্বা জড়ানো সেই ঋষিতুল্য মানুষটির দিকে তাকিয়ে এ প্রশ্ন আমাদের মনে জাগে।
একটু অনুসন্ধান করে দেখা যেতে পারে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ডায়েরিতে লিখেছেন– ‘সেদিন French Exhibition-এ একজন বিখ্যাত artist-রচিত একটি উলঙ্গ সুন্দরীর ছবি দেখলুম। কী আশ্চর্য সুন্দর! দেখে কিছুতেই তৃপ্তি হয় না। সুন্দর শরীরের চেয়ে সৌন্দর্য পৃথিবীতে কিছু নেই– কিন্তু আমরা ফুল দেখি, পাখি দেখি, আর পৃথিবীর সর্বপ্রধান সৌন্দর্য থেকে একেবারে বঞ্চিত।… সেই উলঙ্গ ছবি দেখে যার তিলমাত্র লজ্জা বোধ হয় আমি তাকে ধিক্কার দিই। আমি ত সুতীব্র সৌন্দর্য-আনন্দে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলুম, আর ইচ্ছে করছিল আমার সকলকে নিয়ে দাঁড়িয়ে এই ছবি উপভোগ করি। বেলি যদি বড় হত তাকে পাশে নিয়ে আমি এ ছবি দেখতে পারতুম। এ রকম উলঙ্গতা কী সুন্দর!’ রবি ঠাকুরের উচ্ছ্বাস এখানেই থেমে থাকেনি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সময়টা ১৮৯০-’৯১, কবির বয়স তখন সদ্য ৪০ ছুঁয়েছে– সেবার বিলেতে গিয়ে লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে ফরাসি শিল্পীর আঁকা নগ্নিকা দেখে তিনি আপ্লুত উচ্ছ্বসিত। ডায়েরিতে লিখেছেন– ‘সেদিন French Exhibition-এ একজন বিখ্যাত artist-রচিত একটি উলঙ্গ সুন্দরীর ছবি দেখলুম। কী আশ্চর্য সুন্দর! দেখে কিছুতেই তৃপ্তি হয় না। সুন্দর শরীরের চেয়ে সৌন্দর্য পৃথিবীতে কিছু নেই– কিন্তু আমরা ফুল দেখি, পাখি দেখি, আর পৃথিবীর সর্বপ্রধান সৌন্দর্য থেকে একেবারে বঞ্চিত।… সেই উলঙ্গ ছবি দেখে যার তিলমাত্র লজ্জা বোধ হয় আমি তাকে ধিক্কার দিই। আমি ত সুতীব্র সৌন্দর্য-আনন্দে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলুম, আর ইচ্ছে করছিল আমার সকলকে নিয়ে দাঁড়িয়ে এই ছবি উপভোগ করি। বেলি যদি বড় হত তাকে পাশে নিয়ে আমি এ ছবি দেখতে পারতুম। এ রকম উলঙ্গতা কী সুন্দর!’ রবি ঠাকুরের উচ্ছ্বাস এখানেই থেমে থাকেনি। তিনি আরও বলেছেন– ‘এই ছবি দেখলে সহসা চৈতন্য হয়– ঈশ্বরের নিজহস্তরচিত এক অপূর্ব সৌন্দর্য পশু-মানুষ একেবারে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এবং এই চিত্রকর মনুষ্যকৃত সেই অপবিত্র আবরণ উদঘাটন করে সেই দিব্য সৌন্দর্যের একটা আভাস দিয়ে দিলে’। এখানে রবি ঠাকুরের ‘উলঙ্গ সুন্দরী’র মতো অমার্জিত শব্দচয়ন কিছুটা আহত করতে পারে আমাদের। এই অকপট ভাষ্য তাঁর ডায়েরির খসড়াবিশেষ। পরে ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়ারি’র মুদ্রিত পাঠে কবির কলম কিছুটা সেন্সারড, আরেকটু পরিমার্জিত। সেখানে ‘উলঙ্গ সুন্দরী’ হয়ে উঠেছে ‘বসনহীনা মানবী’। বাকি অংশের ভাব ও ভাষা প্রায় একই, বরং কিছু বেশি, যেমন সেখানে লিখেছেন, ‘এ কেবলমাত্র দেহের সৌন্দর্য নয়, যদিও দেহের সৌন্দর্য যে বড় সামান্য এবং সাধুজনের উপেক্ষণীয় তা বলতে পারি নে– কিন্তু এতে আরও অনেকখানি গভীরতা আছে’। অর্থাৎ শিল্পের নগ্নতা নিয়ে কোনওরকম ছুঁৎমার্গ রবীন্দ্রনাথের ছিল না। এও মনে রাখার, এখানে নগ্নতা আর যৌনতাকে এক সারিতে রাখা হয়নি। কাছাকাছি সময়ে কবির ভাইপো বলেন্দ্রনাথের লেখাতেও পাই নগ্নতার অকুণ্ঠিত বন্দনা। ‘ভারতী ও বালক’ পত্রিকার পৌষ ১২৯৬ সংখ্যায় ‘নগ্নতার সৌন্দর্য’ শিরোনামে বলেন্দ্রের সেই লেখা আজও রীতিমতো আগ্রহ আদায় করে। চমকে উঠি যখন তিনি ঘোষণা করেন– ‘নগ্নতায় সৌন্দর্য ফুটে অধিক। তাহার মর্মে কি যেন “লাজহীনা পবিত্রতা” জাগিয়া আছে’। তাহলে নগ্নতার সৌন্দর্যের মূল ভর তার লজ্জাহীন নিঃসংকোচ প্রকাশভঙ্গি। এবারে সাহিত্যের পাতা সরিয়ে রবি ঠাকুরের ছবির দিকে তাকাই।
‘রবীন্দ্রচিত্রমালা’য় একাধিক নগ্নিকার ছবি থেকে এখানে একটিকে বেছে নিই। এ ছবিতে সমগ্র চিত্রপট জুড়ে নগ্নিকার আবক্ষ প্রতিমা দর্শকের দিকে সরাসরি অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ছবিটির রচনাকাল ১৯৩৪, ডিসেম্বর। প্রায় মোনোক্রমের এই ছবিতে ঘন ও তুলনায় হালকা বাদামি রঙের প্রাধান্য। চোখের সাদা অংশে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে কাগজের সাদা, নাক আর চিবুকে সামান্য হাইলাইট, তা আরও বেশি আলোকিত করেছে সুঠাম নারীদেহের অনাবৃত কুচযুগল। এ যেন সেই ‘বিজয়িনী’ কবিতায় অক্ষরে আঁকা বর্ণনার চিত্ররূপ, যেখানে সূর্যের আলো পড়ে নগ্নিকার শরীর উদ্ভাসিত হয়– ‘…শিখরে শিখরে/ পড়িল মধ্যাহ্নরৌদ্র– ললাটে অধরে/ ঊরু-‘পরে কটিতটে স্তনাগ্রচুড়ায়/ বাহুযুগে সিক্ত দেহে রেখায় রেখায়/ ঝলকে ঝলকে’। তবে ছবিঠাকুরের নারী এখানে ‘বিজয়িনী’-র সেই যৌবনমদমত্তা রূপসী নয়, এ কোনও প্রান্তিক মানবীর দৃপ্ত অবয়ব। যার চোখের তারায় তথাকথিত অভিজাত ভদ্রজনের বিরূদ্ধে অধিকার আদায়ের নীরব ঘোষণা লেখা আছে।