যখন আমি শিক্ষানবিশী হিসেবে শুরু করেছিলাম, যখন অভিনয়ের বিজ্ঞানের মধ্যে প্রবেশ করলাম ‘নান্দীকার’-এ এসে, তখন প্রত্যাশা ছিল আমি হয়তো অনেক কিছু নিয়ে ফিরব। এই ট্রেনিং পর্বটার মধ্যে ঢোকাটাই সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে, আরেকটা মানুষ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে, আমার ভেতরে সযত্নে লালিত মানুষটাকে ঘাড় ধরে চুপ করিয়ে দেওয়ার সময়, নতুন একটা মানুষকে নিজের মধ্যে গড়ে তোলার সময়, যা আমি শিখলাম, তা কিছুতেই প্রয়োগ করতে পারলাম না। আমার ভেতরের নিজস্ব যে লোকটা, যে আমার মধ্যে বাস করে, সে কিছুতেই আমাকে ছাড়বে না, অথবা আমি যাকে ধরব বলে ঠিক করেছিলাম, সে ধরা দেবে না।
অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, অভিনয় করতে চাইলে কোন পথে এগনো উচিত। যেহেতু আমি অনেক দিন অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত, সেজন্যই হয়তো। একথা নিশ্চয়ই সত্যি যে, আমি বহুদিন ধরে অভিনয় করছি, এবং প্রায় প্রতিদিনই অভিনয় করছি। এ-প্রসঙ্গে আমার মাস্টারমশাইয়ের একটা কথা খুব মনে পড়ে। প্রচলিত গল্পই, তবুও আর একবার বলি। দেশভাগের সময় কোনও এক অঞ্চলের মধ্য দিয়ে কাঁটাতার যাবে, যেখানে একটি সত্যপীরের থান রয়েছে। তার মাঝখান দিয়েই কাঁটাতার যাবে। অর্থাৎ, সেই থানটিকে ভেঙে ফেলতে হবে। এমন টালমাটাল সময়ে একজন মহিলা সেই থানে এসেছেন মানত করতে। পীরকে ডেকে বলছেন, তরাও বাবা, তরাও বাবা, তরাও সত্যপীর। তখন সত্যপীর নিজে এসে বলছেন, তোমাকে কি তরাব বাবা, আমি নিজেই অস্থির।
এই ‘আমি নিজেই অস্থির’ কথাটা আমার বলতে ইচ্ছে করে তাঁদের, যাঁরা আমাকে অভিনয়ের দিশা দেখাতে বলেন। অভিনয়ের কোন পদ্ধতিতে এগনো যাবে, তা সত্যিই আমার জানা নেই। কিছু কিছু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি রয়েছে বটে, সেই পথে হাঁটার নিদানও দিয়েছেন অনেকে। সেই পথে হাঁটার জন্য বিজ্ঞানকে আত্মস্থ করার দিশা কি রয়েছে? অভিনয়কে হৃদয় থেকে, মন থেকে, শরীর থেকেই আবিষ্কার করতে হয় বলেই আমার ধারণা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
তখন আমার মোটে কুড়ি-একুশ বয়স। এখন যেভাবে ব্যাখ্যা করছি, সেটা তো তখন পারতাম না। শেখা বিদ্যা প্রয়োগ করতে গিয়েই দেখি এ তো আমার মনের মানুষ নয়। এ তো এক কাঠামো মাত্র, খটখটে, নিদারুণ রস-কষহীন। আমি পাড়া কাঁপিয়ে চিৎকার করলেও সে যেন শুনতেই পাচ্ছে না। ফলে, অভিনয়ের ক্ষেত্রে কোনটা ধরে আমি ওর কাছাকাছি যাব, ও আমার কাছে আসবে, সেইটির তালাশ করতে আমার বহুদিন সময় লেগেছে। এখনও জানি না, তবে কখনও কখনও তার হদিশ পেয়েছি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
যখন আমি শিক্ষানবিশী হিসেবে শুরু করেছিলাম, যখন অভিনয়ের বিজ্ঞানের মধ্যে প্রবেশ করলাম ‘নান্দীকার’-এ এসে, তখন প্রত্যাশা ছিল আমি হয়তো অনেক কিছু নিয়ে ফিরব। এই ট্রেনিং পর্বটার মধ্যে ঢোকাটাই সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা! কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে, আরেকটা মানুষ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে, আমার ভেতরে সযত্ন লালিত মানুষটাকে ঘাড় ধরে চুপ করিয়ে দেওয়ার সময়, নতুন একটা মানুষকে নিজের মধ্যে গড়ে তোলার সময়, যা আমি শিখলাম, তা কিছুতেই প্রয়োগ করতে পারলাম না। আমার ভেতরের নিজস্ব যে লোকটা, যে আমার মধ্যে বাস করে, সে কিছুতেই আমাকে ছাড়বে না, অথবা আমি যাকে ধরব বলে ঠিক করেছিলাম, সে ধরা দেবে না। সে যাচাই করতে চায় আমাকে। সে বলে, তোর কাছে ধরা দেব কেন? কী যোগ্যতা আছে তোর? এমন কোন সুখ তুই দিতে পারবি, যা আমার কাছে নেই? কেন একঘর দর্শকের সামনে হাটে হাঁড়ি ভাঙবি?
তখন আমার মোটে ২০-২১ বয়স। এখন যেভাবে ব্যাখ্যা করছি, সেটা তো তখন পারতাম না। শেখা বিদ্যা প্রয়োগ করতে গিয়েই দেখি এ তো আমার মনের মানুষ নয়। এ তো এক কাঠামো মাত্র, খটখটে, নিদারুণ রস-কষহীন। আমি পাড়া কাঁপিয়ে চিৎকার করলেও সে যেন শুনতেই পাচ্ছে না। ফলে, অভিনয়ের ক্ষেত্রে কোনটা ধরে আমি ওর কাছাকাছি যাব, ও আমার কাছে আসবে, সেইটির তালাশ করতে আমার বহুদিন সময় লেগেছে। এখনও জানি না, তবে কখনও কখনও তার হদিশ পেয়েছি।
এই যে প্রস্তাবনা লিখলাম এতক্ষণ, তার একটা কারণ আছে। আমি সম্প্রতি দু’টি নাটক করলাম, তার মধ্যে একটি গিরীশ ঘোষের ‘বিল্বমঙ্গল’। গল্পটা হয়তো অনেকেই জানেন, যাঁরা জানেন না, তাঁদের জন্য ছোট করে লিখছি। গল্পটায় একজন নারী, যে দেহব্যবসা করে, তার প্রেমে পড়ে পড়তি জমিদারের ছেলে। মেয়েটি বলে, আমার জগতে কোনও প্রেম নাই। ওই শব্দটা আমার কাছে উচ্চারণ করো না। এদিকে ছেলেটি দেহ চায় না, প্রেমই চায়। একদিন এক ঝড়জলের রাতে তাদের মধ্যে রাগারাগি হয়, পুরুষটি ফেরত চলে যায়। সেদিনই ছেলেটির বাবার শ্রাদ্ধ। বাবার শ্রাদ্ধ সম্পূর্ণ না করেই চলে আসার জন্য সে নিজেকে দোষারোপ করে। তবুও তার মন থেকে মেয়েটির স্বপ্ন ফুরয় না। সেদিন আরও রাতে সে ঠিক করল নদী পেরিয়ে মেয়েটির কাছে আবার যাবে। কিন্তু নৌকো ভেসে গিয়েছে। কীভাবে যাবে সে? সে ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলে ও ঈশ্বর তাকে প্রভাবিত করে বলে প্রেমের জন্য ঝাঁপ দিতে। শেষমেশ সে জলে ঝাঁপ দেয়। অবধারিতভাবে সে ডুবে যাবে জেনেও। কিন্তু ওই উত্তাল নদীতে সে দুটো জিনিস পায়। কাষ্ঠখণ্ড ও সাপ। সাপটি তার গলা পেঁচিয়ে বন্ধুর মতো কিছুটা পথ পেরিয়ে দেয়। আর কাষ্ঠখণ্ড ভেবে যেটাকে ধরেছিল সে, তা আসলে একটি মৃতদেহ। সেই মৃতদেহের ওপর চড়ে বসে সে ওপারে পৌঁছে যায়। কিন্তু সে মৃতদেহটা ছেড়ে মেয়েটির কাছে যেতে পারছে না। সে বলছে, ও তো আমাকে নদী পার করে দিল। ও তো আমার বন্ধু। মৃত্যু যার অবধারিত ছিল, তাকে বাঁচাচ্ছে একটি মৃতদেহ।
আমাদের সংলাপগুলি, ভাবগুলি আসলে এই বিল্বমঙ্গলের মতো। লেখক, পরিচালক যে নির্দেশ দেন, অভিনেতা সেগুলোকে আশ্রয় করে। কিন্তু আশ্রয় করে কাকে? আশ্রয় করে ওইরকম একটি মৃতদেহকে। যার ওপর সে চড়ে বসে। যখনই তার ওপর চড়ে বসি, তখনই তার মধ্যে আমি আমার প্রাণের সঞ্চার করি। আমার থেকে ধার করা প্রাণই আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আমি যখনই অভিনীত চরিত্রটিকে দেখতে চেয়েছি, শব্দ ও নৈঃশব্দ্য দিয়ে তার কাঠামোয় চড়ে বসে, তার মধ্যে প্রাণ ঢেলেছি। সে-ই আমাকে পৌঁছে দেয় পাড়ে, এবং আমি পায়ের তলায় মাটি পাই। আর আমি মাটি পেলেই, সে আবার মৃত। আমাকে তো এবার সৎকারও করতে হবে। এই সৎকার আমরা কীভাবে করি? বিল্বমঙ্গল তাকে দাহ-র ব্যবস্থা করেছিল, তাকে মাটিতে ফিরিয়ে দিয়েছিল। আমরাও যে মন থেকে তাকে তুলে আনি, সেই মনের কাছেই ফিরিয়ে দিই।
আরেকটি নাটক– ‘তোমার আমি’। এটি একটি বিদেশি নাটক থেকে নেওয়া। বই এই নাটকটি বিষয়। একটি বইপাগল লোক একটি বইয়ের দোকান চালায়। পরিবার, সংসার থেকেও লোকটির কাছে বই বিশেষ কিছু। কারণ বইয়ের কোনও দাবি নেই। আমি যখন ইচ্ছে তার কাছে যাব, পড়তে চাইলে পড়ব, নয়তো তাকে তুলে রাখব। কিন্তু বই কি কখনওই কিছু বলে না, দাবি জানায় না? যে কিছু বলছে না, যে বলে যেমনভাবে খুশি তুমি আমাকে রাঙাও। এই রাঙানোর উপায় বাইরে থেকে পাওয়া যায় না। দরকার পড়ে অন্তরের, অন্ধকারের, যে অন্ধকার পবিত্র, স্বচ্ছ। এই লোকটিকে যে মেয়েটি ভালোবাসে, সে মেয়েটি অনেক ছোট। সে তাকে বলে, তুমি কবিতা লেখো, আমাকে কখনও জানাওনি তো! লোকটি লিখত বটে কবিতা, কিন্তু কাউকে জানাত না। এই লোকটির চরিত্রে আমি বলি, আমি কী করে কবিতা লিখব বলো, আমি তো চোখে দেখতে পাই।
অভিনয়ও তেমনই। দেখতে পাওয়ার অতিরিক্ত দেখা যদি কিছু পাই, তাহলে সার্থক হই। ‘অন্ধ ছুঁয়ে দেখে না তার কণ্ঠ পারে ফুল ফোটাতে অন্ধকারে’। অন্ধকারে ফুল ফোটানোই তার দৃষ্টি। অভিনয়ের কাছে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে আলোর পথযাত্রী যেমন হতে হয়, তেমনই অন্ধকারকেও হাতড়ে হাতড়ে দেখতে হয়।
প্রত্যেক অভিনেতার একটা নিজস্ব বিজ্ঞান থাকে। যে বিজ্ঞান তাকে বাইরে থেকে শেখায়। অভিনয়ের বিজ্ঞানটি আলোর বিজ্ঞান। আলো ফেলে দেখানোর পথে হেঁটে আমি অভিনয় শুরু করেছিলাম। কিন্তু তখন তাকে পাইনি। তাই আলো জ্বেলে দেখার পথটা আমার নয়। এই ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম, আর কখনও আমি অভিনয় করব না, অভিনয় আমার দ্বারা হবে না। এটা ভেবে যেদিন সহজ হলাম, সাবলীল হলাম, প্রাপ্তির আশা ছাড়লাম, তার দিন দুয়েকের পর থেকেই আমার কিছু কিছু জায়গায় মনে হল, আমি পারছি। এই অনুভূতিটা আমি কোনও দিন ভুলব না। যেদিন চাওয়ার আশা ছেড়েছি, তখনই হাত ভরে পেলাম। মনে হল, এই তো রাস্তা। তার মানে, আলোর পথ দেখানো রাস্তাটা যেমন সত্য, তেমন আর একটি পথও সত্য, সেটা অন্ধকারের পথ। সেই পথে হেঁটে হেঁটে চরিত্রের কাছে পৌঁছব। প্রত্যেক দর্শকের মধ্যে যে অভিনেতা বাস করে, অভিনয় দেখার সময় তাঁরাও সেই পথ ধরেই হাঁটেন।
…পড়ুন নাটুয়া-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৮। নাটক কি মিথ্যের প্রতিশব্দ, সমার্থক?
পর্ব ৭। আমার পুরনো মুখটা আমাকে দেখিয়ে তবেই সাজঘর আমাকে ছাড়বে
পর্ব ৬। মঞ্চে আলো এসে পড়লে সব আয়োজন ভেস্তে যায় আমার
পর্ব ৫। আমার ব্যক্তিগত রং আমাকে সাহস জোগায় নতুন রঙের চরিত্রে অভিনয় করতে
পর্ব ৪। একটা ফাঁকা জায়গা ও বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা
পর্ব ৩। আমার অভিনয়ের গাড়িতে আমি অন্য সওয়ারি চড়িয়ে নিয়েছি আমার জন্যই
পর্ব ২। অন্যের চোখে দেখে নিজেকে রাঙিয়ে তোলা– এটাই তো পটুয়ার কাজ, তাকে নাটুয়াও বলা যেতে পারে
পর্ব ১। বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন?