ভারতে এসে শান্তির খোঁজ করেছিলেন হিপি-রা, ফরাসি বোহেমিয়ান সংস্কৃতির উত্তরাধিকারীরা। আর তার সঙ্গেই এসেছিল মাদকতা, ছেঁড়া জিনসের বাধ্যতামূলক ফ্যাশন (কারণ গোটা জিনস কেনার সামর্থ্য তখন অনেকেরই নেই, ফলে ধার করা তাপ্পিমারা জিনসই হয়ে উঠল নয়া পোশাকবিধি), ও ভবঘুরে এক জীবন। ‘প্রেম পূজারী’ নিয়ে প্রতিবাদে খানিক ভেঙেই পড়েছিলেন দেব আনন্দ, কারণ তখনও কথায় কথায় সেলিব্রিটিদের প্রতিবাদ, ট্রোল আর ক্ষোভ সামাল দিতে হত না, বিশেষত ওই স্তরের তারকাদের তো নয়ই। সেই সময় নেপালে গিয়ে হঠাৎই হিপি সংস্কৃতির সর্বনাশ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন তিনি, সেখান থেকেই জন্ম নেয় ‘হরেরাম হরেকৃষ্ণ’-র বীজ।
৯.
এক ব্রিটিশ নাগরিক হয়ে উঠেছিলেন একেবারে দাস পদবিধারী বৈষ্ণব, ইস্কন আন্দোলনের জোয়ারে। তারপর ড্রাগ পাচারকারীদের সঙ্গে ভিড়ে গুলাগ হয়ে তাঁর ভারতে আসার রোমাঞ্চকর কাহিনি শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়। বিখ্যাত লোক তিনি নন, তবু এই কলকাতা শহরেই তাঁর সঙ্গে আলাপ জমে উঠেছিল যাঁদের, তাঁদের কাছে তিনি এবং তাঁর জীবনযাত্রা প্রায় মিথ। তাঁর সূত্র ধরে কলকাতার লোকজন খোঁজ পাচ্ছে মাদকের, তাঁর সূত্র ধরে নাকি কলকাতায় আসছেন খোদ ল্যান্সডাউনের নাতি, আবার এমন লোক, যার সম্পর্কে তাঁর নিজেরই মূল্যায়ন– ‘ক্রিমিনাল’। ভালো স্কচ ছাড়া তাঁর চলে না, আবার তিনি আদ্যন্ত নিরামিষাশী। এমনকী, গুলাগ-এও তিনি তাঁর বিফ স্ট্যু-এর গো-মাংসর টুকরো তুলে দিতেন অন্যদের পাতে, আর তাদের থেকে নিতেন গাজর, পেঁপে ইত্যাদি সবজি। কিন্তু যাঁর কাছ থেকে এই কাহিনি শোনা, লিখলে তিনিই কোনও দিন লিখবেন সেই কালক্রমে বাঙালি হয়ে ওঠা পাগলা সাহেবের গল্প। এই লেখার উদ্দেশ্য সেই নেশাড়ু বৈষ্ণবের কিসসা শোনানো নয়, বরং একথা বলতে চাওয়া, এমন হিপি-ইস্কন ককটেল কলকাতায় বহুকাল অবধি চাইলেই মিলত। অ্যালেন গিনসবার্গরা কলকাতা দাপিয়ে বেরিয়েছেন, জ্যাক কেরুয়াকের ‘অন দ্য রোড’ একসময় ধর্মগ্রন্থ হয়ে উঠেছে কলকাতার যুবকদের একাংশের কাছে। কিন্তু ১৯৭১-এর গোড়ায় মুক্তি পাওয়া ‘হরেকৃষ্ণ হরেরাম’ হিপি বা ইস্কন– এই সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যে স্মৃতি জমা করেছিল, তার মূলে একটা জরুরি নাম ছিল– জিনাত আমন।
‘নিশির ডাক’ বইয়ের শুরুতেই সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ভোলা আর না-ভোলা অতীতের সমন্বয়ে তৈরি হয় এক তৃতীয় সত্য। সেই সত্য হয়তো আমরা প্রত্যক্ষে জানি না, কিন্তু সেই সত্যর অস্তিত্ব শ্রডিঙ্গারের বেড়ালের মতো। যা নেই ভারতে (মহাভারত), তা নেই ভারতে-র মতোই, ফেলে আসা দশকের সিনেমা দেখার স্মৃতির দলিলই আসলে সিনেমা, ওই তৃতীয় সত্যই আসলে জনপ্রিয় সিনেমা দেখার ইতিহাস নির্মাণ করে। যেমন সেই বিতর্কিত খান্না সিনেমার গল্প, যে সিনেমা হলের পর্দায় আগুন জ্বলেছিল ‘প্রেম পূজারী’ রিলিজের পর। সেই সিনেমা হলেই ‘হরেরাম হরেকৃষ্ণ’ দেখার অন্যতর এক অভিজ্ঞতা প্রায় তৃতীয় সত্য হয়ে এসে পৌঁছেছে প্রজন্মান্তরে।
ভারতে এসে শান্তির খোঁজ করেছিলেন হিপি-রা, ফরাসি বোহেমিয়ান সংস্কৃতির উত্তরাধিকারীরা। আর তার সঙ্গেই এসেছিল মাদকতা, ছেঁড়া জিনসের বাধ্যতামূলক ফ্যাশন (কারণ গোটা জিনস কেনার সামর্থ্য তখন অনেকেরই নেই, ফলে ধার করা তাপ্পিমারা জিনসই হয়ে উঠল নয়া পোশাকবিধি), ও ভবঘুরে এক জীবন। ‘প্রেম পূজারী’ নিয়ে প্রতিবাদে খানিক ভেঙেই পড়েছিলেন দেব আনন্দ, কারণ তখনও কথায় কথায় সেলিব্রিটিদের প্রতিবাদ, ট্রোল আর ক্ষোভ সামাল দিতে হত না, বিশেষত ওই স্তরের তারকাদের তো নয়ই। সেই সময় নেপালে গিয়ে হঠাৎই হিপি সংস্কৃতির সর্বনাশ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন তিনি, সেখান থেকেই জন্ম নেয় ‘হরেরাম হরেকৃষ্ণ’-র বীজ। কিন্তু কলকাতার হিপিযাপনের চিহ্ন ততদিনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে চাঁদনি চকের আমজাদিয়া হোটেলে বা কলকাতার ফুটপাতে, গিনসবার্গ-পিটার ওরলভস্কিদের হাত ধরে। সেই উত্তাল কলকাতাতে ততদিনে হয়তো আগুনখেকোদের পাশাপাশি নেশাখোরদের রাজত্বও শুরু হয়ে গিয়েছে, কিন্তু ‘হরেরাম হরেকৃষ্ণ’ বিপথগামী তারুণ্যকে ধরতে চাইল বটে, তবে একদল তরুণ-তরুণী খান্না সিনেমায় এই ছবি দেখতে গিয়ে যে বিপাকে পড়ল, তাতে তাদের কাছে ভবঘুরে হওয়াই একমাত্র রাস্তা ছিল।
উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর এলাকায় এক লেডিস মেসের তিন তরুণী ‘হরেরাম হরেকৃষ্ণ’ দেখতে যাবে বলে স্থির করেই সেদিন মেস থেকে বেরিয়েছিল, তাদের সঙ্গে ভিড়বে কলেজের অন্য দুই সহপাঠী তরুণ। মেসের কর্ত্রীকে বলে বেরিয়েছে মেয়েরা, তারা যাচ্ছে টিউশনিতে। সিনেমা দেখতে যাওয়া ব্যাপারটা তাদের পক্ষে কবুল করা মুশকিল, আবার সঙ্গে ছেলেরা যাচ্ছে বলে কথা, জানাজানি হলেই কেলেঙ্কারি! অন্যদিকে সহপাঠী দুই তরুণের মধ্যে একজন ভুজুংভাজুং কিছু একটা দিয়েছে বটে, কিন্তু সে যথেষ্ট সতর্ক ও সাবধানী। ঠিক হল, তারা দেখা করবে খান্না সিনেমায়। দেখা হল, কথামতো। কিন্তু আরেক সহপাঠীর দেখা নেই। হঠাৎ দেখা গেল, গদগদ চিত্তে সেই তরুণ আসছে, পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। বেলবটস পরে দেখতে আসার ছবি এমন সাত্ত্বিক পোশাক পরে দেখতে আসছে, তাও বত্রিশ পাটি বের করে? সহপাঠী তরুণটি টিটকিরি মারল, ‘কী রে? বাড়িতে কী বলে বেরলি? কীর্তন শুনতে যাচ্ছিস?’
‘আজ্ঞে না! পরিষ্কার বললুম, সিনেমা দেখতে যাচ্ছি!’
‘সে কী রে! কাকু ছাড়ল?’ এক তরুণীর বিস্ময়।
‘হ্যাঁ! খুশি মনে!’
‘কী সিনেমা দেখতে আসবি বললি?’
‘নাম শুনেই তো ছাড়ল রে! ভক্তিমূলক সিনেমা দেখতে আসছি শুনে বলল, যাও দেখে এসো।’
সবাই চুপ। ভক্তির কী দশা হবে একটু পরেই, তার আন্দাজ মনে মনে টের পাচ্ছিল সকলেই। সেই ধুতি-পাঞ্জাবির বাবাও ছিলেন আধা বৈষ্ণব। তাই ছবির নাম শুনে তিনি কী ভেবেছেন, বোঝাই যাচ্ছে।
ছবি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সেই শ্বেতশুভ্র ধুতি-পাঞ্জাবি বিড়বিড় করে উঠল, ‘সর্বনাশ!’
দেব আনন্দ চেয়েছিলেন মুমতাজকে। কিন্তু একটা পার্টিতে ধূমপান-রত ডোন্ট কেয়ার ভাবের জিনাতকে দেখে তিনি ঠিক করলেন, এই-ই হবে তাঁর রিলের উপযুক্ত হিপি বোন। আশা ভোঁসলের ‘দম মারো দম’-এ সেই জিনাত আমনকে দেখে তরুণীরা কিঞ্চিৎ লাজুক, কেউ একটু ক্রুদ্ধও, ‘এ কীরকম বেহায়াপনা’ বলে ঠোঁট বেঁকাচ্ছে। এক তরুণ ততক্ষণে ঠিক করে নিয়েছে, এই নায়িকার যাবতীয় ছবি ও পোস্টার তাকে জোগাড় করতেই হবে লুকিয়ে, অন্যজন, অর্থাৎ ধুতি-পাঞ্জাবি বলছে, ‘দেব আনন্দটা অপদার্থ! আমি হলে কখনও আমার বোনকে এমন ডাকাতদের সঙ্গে মিশতে দিতুম না!’ আবার ‘ফুলো কা তারকা’ শুনে কেঁদেও ভাসাল খানিকটা।
সবশেষে হল থেকে বেরনোর পথে ঘটল বিস্ফোরণটা!
তরুণ-তরুণীদের দলের সামনে দণ্ডায়মান খোদ ধুতি-পাঞ্জাবির বাবা। পাড়ার এক কাকুকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন তিনি, বলেছেন, ‘‘ছেলের থেকে শুনলাম, ‘খান্না’ সিনেমায় নাকি পৌরাণিক সিনেমা চলছে। চলুন দেখে আসি।’’ কিন্তু সেই পৌরাণিক সিনেমায় যে এমন একজন নায়িকা আছেন, যিনি কিনা হিন্দি ছবির নায়িকাদের যাবতীয় পেলবতা, বা মুমতাজের যৌন আবেদনের নমনীয়তার বারোটা বাজিয়ে কিছুটা হলেও বদলে দেবেন বলিউডের নারী নির্মাণের মানচিত্র, তা কে জানত!
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৮। পাড়াতুতো ট্র্যাজেডিতে মিলে গেলেন উত্তমকুমার আর রাজেশ খান্না
পর্ব ৭। পাড়ার রবিদা কেঁদেছিল ‘কাটি পতঙ্গ’ আর ‘দিওয়ার’ দেখে, সাক্ষী ছিল পাড়ার মেয়েরা
পর্ব ৬। যে কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে, সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?
পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প
পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল