তা হল প্রশাসক রবীন্দ্রনাথ। আশ্রম বিদ্যালয়ের আচার্য রবীন্দ্রনাথ একদিকে যেমন পড়ুয়াদের মুক্তি ও স্বাধীনতার অর্থ বুঝিয়ে দিতেন, চাঁদভাঙা আলোয় গান গাইতেন, বৃষ্টিতে ভিজতেন তেমনই একথাও শেখাতেন স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচার নয়।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর আশ্রম বিদ্যালয়ে কি কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেন কখনও? সাধারণ বাঙালি ভাবেন রবি-ঠাকুরের আশ্রম বিদ্যালয় বুঝি কেবলই ফুলে-ফলে ভরা, নাচ-গানে পরিপূর্ণ নিয়মহারা আনন্দের স্থল। শান্তিনিকেতনের রাবীন্দ্রিক বিদ্যালয়ের এই যে ছবি বাঙালিরা মনের মধ্যে লালন করেন তা কিন্তু একদিক থেকে বঙ্গবাসীর ফাঁকিবাজি-সামূহিকতার বাসনাপ্রসূত। রবীন্দ্রনাথকে ফাঁকিবাজ বাঙালি তাঁদের ‘আইকন’ হিসেবে তুলে ধরে নিজেদের স্বেচ্ছাচারকে অনেক সময় প্রতিষ্ঠা দিতে চান। বাঙালির ‘বাসনায় রবীন্দ্রনাথ যেমন’ আর ‘প্রকৃত রবীন্দ্রনাথ যেমন ছিলেন’– দুয়ের মধ্যে কিন্তু বিস্তর বেমিল। আশ্রম বিদ্যালয়ের আচার্য রবীন্দ্রনাথ একদিকে যেমন পড়ুয়াদের মুক্তি ও স্বাধীনতার অর্থ বুঝিয়ে দিতেন, চাঁদভাঙা আলোয় গান গাইতেন, বৃষ্টিতে ভিজতেন তেমনই একথাও শেখাতেন স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচার নয়। আশ্রম বিদ্যালয় প্রসঙ্গে তিনি ব্রহ্মচর্যাশ্রমের সহযোগীদের নানা সময় নানা সমস্যার সমাধানে নানারকম চিঠি লিখেছিলেন। সেই সমস্ত চিঠিপত্রর সাক্ষ্য থেকে বোঝা যায় প্রশাসক হিসেবে তিনি কেবল সুবিবেচক ও দূরদর্শীই ছিলেন না, প্রয়োজনে কঠোর হতেন। কেমন সে কঠোরতার নমুনা?
আশ্রম বিদ্যালয় থেকে কি পড়ুয়াদের কখনও বহিষ্কার করা হত? প্রয়োজনে করা হত। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুলাই আশ্রম বিদ্যালয়ের শিক্ষক অজিত চক্রবর্তীকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখছেন, “…কে অনতিবিলম্বে বিদায় করে দেবে। বিকৃতিই যখন এই ছেলেটির পক্ষে প্রকৃতিগত তখন আমরা এর কোনো উপকার করতে পারব না মাঝের থেকে অন্য ছেলেদের বিপদে ফেলা হবে। কি আর বলব।” পড়ুয়ার নাম প্রকাশ্যে আসার দরকার নেই। বিকৃতির স্বরূপ নিয়ে বিশদ আলোচনা করছেন না। শুধু প্রশাসক হিসেবে বুঝতে পারছেন অন্য ছাত্রদের ক্ষতি হবে বলেই বিকৃতমন ছাত্রটিকে বহিষ্কার করতে হবে। তার প্রকৃতি (nature) সংশোধনের উপায় যখন নেই তখন কী আর করা যাবে!
মনে রাখতে হবে, সুভাষচন্দ্র বসুকে যখন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তখন রবীন্দ্রনাথ সুভাষের পক্ষ নিয়েছিলেন। লিখেছিলেন ‘ছাত্রশাসনতন্ত্র’ নামের গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ। সেখানে বলেই দেওয়া হয়েছিল সামরিক মনোভাবাপন্ন মানুষদের আর যাই হোক শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা নেই। লিখেছিলেন, “অতএব যাদের উচিত ছিল জেলের দারোগা ড্রিল বা সার্জেণ্ট্ বা ভূতের ওঝা হওয়া তাদের কোনোমতেই উচিত হয় না ছাত্রদিগকে মানুষ করিবার ভার লওয়া। ছাত্রদের ভার তাঁরাই লইবার অধিকারী যাঁরা নিজের চেয়ে বয়সে অল্প, জ্ঞানে অপ্রবীণ ও ক্ষমতায় দুর্বলকেও সহজেই শ্রদ্ধা করিতে পারেন; যাঁরা জানেন, শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা; যাঁরা ছাত্রকেও মিত্র বলিয়া গ্রহণ করিতে কুণ্ঠিত হন না।” রবীন্দ্রনাথের আগের চিঠি ও এই প্রবন্ধের সূত্রে একটি কথা বলতে ইচ্ছে করে। হাল আমলে পড়ুয়াদের ‘বিকৃতি’-কে শাসন করার কথা উঠলে অনেকেই বিষয়টিকে ‘সামরিক’ মনোভাবের সঙ্গে তুলনা করেন– তুলনাটি সুপ্রযুক্ত নয়। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু দুয়ের পার্থক্য নির্দেশ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। আশ্রমবিদ্যালয়ের বিকৃতমনা পড়ুয়ার সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের তুলনা চলে না। তাই দু’জনের ক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রয়োগ অনুচিত। আবার দুই পড়ুয়া যা করেছে, সেই কাজও তুলনীয় নয়। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাপদ্ধতির মূল কথাই হল বিচারশীলতা ও অধিকারীভেদ– এক সাধারণ নিয়ম সর্বত্র, সবার উপর সব দেশ-কালে চাপিয়ে দেওয়ার তিনি পক্ষপাতী নন।
রবীন্দ্রনাথের এই মনটি ছিল বলেই কিন্তু লিখতে পেরেছিলেন ‘অচলায়তন’-এর মতো নাটক। ‘অচলায়তন’ কেবল পাঁচিল ভাঙার আখ্যান নয়। যে শিক্ষালয়টি ক্রমশই নিয়মের গারদখানায় পরিণত হয়েছিল, যে শিক্ষালয়টি ধর্মীয় কুসংস্কারের বদ্ধগুহায় পরিণত হয়েছিল, যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাইরের সাধারণ মানুষের যোগ একেবারেই ছিন্ন হয়েছিল সেই শিক্ষাগারটির পাঁচিল গুরু এসে ভেঙে দিলেন। এমন শিক্ষালয়ের পাঁচিল তো ভাঙাই উচিত। পাঁচিল ভাঙার কাজে গুরুর সঙ্গে যোগ দিলেন বাইরের সাধারণ মানুষ। পাঁচিল তো ভাঙা হল কিন্তু তারপর? যদিও বিচার না করেই ‘স্বেচ্ছাচারী’ বাঙালি পাঠক এই নাটকটিকে পাঁচিল ভাঙার নাটক হিসেবেই দাগিয়ে দেন নাটকটির শেষে কিন্তু আরেকটি পাঁচিল তৈরির কথাও ছিল।
“প্রথম শোণপাংশু। দাদাঠাকুর।
দ্বিতীয় শোণপাংশু। আর তো পারি নে। দেয়াল তো একটাও বাকি রাখি নি। এখন কী করব? বসে বসে পা ধরে গেল যে।
দাদাঠাকুর। ভয় নেই রে। শুধু শুধু বসিয়ে রাখব না। তোদের কাজ দেব।
সকলে। কী কাজ দেবে?
দাদাঠাকুর। আমাদের পঞ্চকদাদার সঙ্গে মিলে ভাঙা ভিতের উপর আবার গাঁথতে লেগে যেতে হবে।
সকলে। বেশ, বেশ, রাজি আছি।
দাদাঠাকুর। ওই ভিতের উপর কাল যুদ্ধের রাত্রে স্থবিরকের রক্তের সঙ্গে শোণপাংশুর রক্ত মিলে গিয়েছে।”
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে ব্রাত্য সাধারণ মানুষদের রবীন্দ্রনাথ শোণপাংশু নামে চিহ্নিত করেছিলেন এ নাটকে। তাঁদের কাছে যিনি দাদাঠাকুর বলে পরিচিত প্রকৃত পরিচয়ে তিনি আয়তনের গুরু। আয়তনের গুরু এই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষদের নিয়ে বিপ্লব করলেন। সে বিপ্লব কিন্তু রক্তক্ষয়ী ছিল। দুই মতের সংঘর্ষে যখন স্থবিরকের রক্তের সঙ্গে শোণপাংশুর রক্ত ভাঙা পাঁচিলের ওপর মিশে গেল তখন সময় হল আরেক পাঁচিল গড়ার। এই পাঁচিল আরেক রকম পদ্ধতি। সে পদ্ধতিও কিন্তু চিরস্থায়ী নয়, আবার যখন সেই পদ্ধতির ওপর কুসংস্কারের শ্যাওলা জমবে তখন ভাঙতে হবে তা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘মানুষের ধর্ম’ নিবন্ধে জানিয়ে দিয়েছিলেন মানুষ অনাগারিক, পশুর মতো গুহাবর্তী নয়– একই অবস্থা আর ব্যবস্থায় আটকে থাকে না সে। এককালে যে ব্যবস্থা মানুষ মাথায় করে রেখেছিল অন্যকালের মানুষ সেই ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে পথে নামে।
স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচার নয়, স্বাধীনতা আয়াসসাধ্য অনুশীলন– ব্যক্তি মানুষের পক্ষে আবার প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও। প্রতিনিয়ত সচেতন থাকা জরুরি। ফাঁকিবাজ হুজুগে বাঙালি অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে এত কিছু ভাবতে চায় না।