৫০ বছরের বিজ্ঞাপনী জীবনে দেশ-বিদেশের বহু ব্র্যান্ড ঘেঁটেছি ও তা নিয়ে পড়াশোনাও করেছি। দেখেছি, শতবর্ষ পেরিয়েও অনেক ব্র্যান্ডের জনপ্রিয়তা ও আর্থিক সাফল্য, কিন্তু তারা কি কেউ বোরোলীনের মতো ৯৪ বছর ধরে বহু কঠিন প্রতিযোগিতা, অসংখ্য ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে বংশানুক্রমে ক্রেতাদের হৃদয়ে আসন পেতে রাখতে পেরেছে?
বাঙালির ব্র্যান্ড বাজানোর গল্পে অত্যাশ্চর্য দু’টি ঘটনা হল–
১) স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ারে নতুন নতুন ব্র্যান্ডের জন্ম। ইউরোপ, আমেরিকায় শিল্প আন্দোলনের জোয়ারে ব্র্যান্ড তৈরির ঘটনা আমরা জানি। কিন্তু স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ার যে শিল্পমুখী হয়ে নতুন নতুন ব্র্যান্ডের জন্ম দিতে পারে এবং কিছু ব্র্যান্ড প্রায় এক শতাব্দী ধরে নিজ গুণে বাজারে টিকে থাকতে পারে, তার উদাহরণ এই বঙ্গদেশ ছাড়া বোধহয় আর কোথাও পাওয়া যাবে না।
২) ধুয়ে-মুছে যাওয়া বাঙালির গর্বের শিল্প ও ব্র্যান্ডিং ইতিহাসের ক্ষত ঢাকতে এক
আশ্চর্য মলম এখনও টিকে আছে বংশানুক্রমে। মা, মাসিমা, ঠাকুমা, পিসিমা, কাকা, কাকিমা এবং অজস্র নারী-পুরুষের হাত ধরে। আসলে বাঙালির ব্র্যান্ডিংয়ের গল্প কোনও দিন এই আশ্চর্য মলমের প্রলেপ ছাড়া শেষ হওয়ার নয়।
‘‘সুরভিত এ্যান্টিসেপটিক ক্রীম
‘বোরোলীন’ ভারতের প্রথম এ্যান্টিসেপটিক ক্রীম।’’
১৯৪৭ সাল আমার জন্মের সাল আর সেই সালেই বোরোলীন ‘ব্র্যান্ডিংয়ের এক জাদু কা খেল’ দেখিয়ে দিল। স্বাধীনতা উদ্যাপনকে কেন্দ্র করে ১৫ অগাস্ট সকালে কলকাতার সব খবরের কাগজে এক ঐতিহাসিক বিজ্ঞাপনে বলা হল সেদিন বোরোলীনের ১ লক্ষ টিউব বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। ব্রিটিশ দ্রব্য বর্জন, স্বদেশি আন্দোলন আর স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে যে সমস্ত বাঙালি উদ্যোগপতি সীমিত আর্থিক ক্ষমতায় উচ্চমানের জনপ্রিয় আর্থিক সফল শিল্প গড়লেন, তাদের মধ্যে বোরোলীন এক উজ্জ্বলতম উদাহরণ। না হলে দেশপ্রেমের ভাবাবেগে এক লক্ষ টিউব বিনামূল্যে গণবিতরণ কোনও ব্যবসায়ীর পক্ষে ভাবা সম্ভব?
অত্যন্ত সাধারণ অবস্থায় ঘরে বসে সপরিবারে এই ক্রিম তৈরি করে তার যথাযোগ্য বিপণন ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা অর্জন ও সারা দেশে প্রথম অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিম ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বোধহয় একমাত্র বোরোলীনের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল, যা এ যুগের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত তথাকথিত ব্র্যান্ড বিশেষজ্ঞরা স্বপ্নেও ভাবতে পারবেন না।
এই সাফল্যের মূল কারণ, আমার মতে, দেশভক্তি, সততা আর সাহস।
জ্ঞান হওয়া ইস্তক এই আশ্চর্য মলম আমার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অনেক হারিয়ে যাওয়া দৃশ্য চোখে ভাসছে। ঠাকুরমা চলে যাওয়ার অনেক বছর পর একবার গ্রামে প্রায় ভেঙে পড়া আমাদের আদি বসতবাড়ি দেখতে গিয়ে এক আশ্চর্য দৃশ্য মনখারাপ করে দিয়েছিল। চারিদিকে হেরে যাওয়া বৈভবের ধ্বংসস্তূপে হঠাৎ চোখে পড়ল লক্ষ্মীর কুলুঙ্গি। যার মধ্যে ধুলো মাখা প্রদীপের পাশে ধূলিধুসরিত বোরোলীনের সেই সবুজ বাক্স। যেন বহু যুগ আগে ঠাকুরমার পছন্দের ব্র্যান্ডের সাক্ষী হয়ে তখনও টিকে আছে। মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় খেলাধুলো করার সময় কেটে-ছড়ে গেলেই ঠাকুরমার নিশ্চিত বিধান ‘ওরে ব্লোরীন লাগা।’ ঠাকুমার উচ্চারণ বিভ্রাটে বোরোলীন ‘ব্লোরীন’ হয়ে তাঁর হৃদয়ে বিরাজিত ছিল।
বিজ্ঞাপন জগতে কাজের সূত্রে বহু ধনী, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত গৃহে গিয়েছি। সব জায়গায় দেখেছি লক্ষ্মীর থান, যা প্রকৃতিই বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। আশ্চর্যভাবে নিজ গুণে, সঠিক অর্থে বোরোলীন ‘বঙ্গ জীবনের অঙ্গ’ হয়ে গেল।
৫০ বছরের বিজ্ঞাপনী জীবনে দেশ-বিদেশের বহু ব্র্যান্ড ঘেঁটেছি ও তা নিয়ে পড়াশোনাও করেছি, দেখেছি, শতবর্ষ পেরিয়েও অনেক ব্র্যান্ডের জনপ্রিয়তা ও আর্থিক সাফল্য, কিন্তু তারা কি কেউ বোরোলীনের মতো ৯৪ বছর ধরে বহু কঠিন প্রতিযোগিতা, অসংখ্য ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে বংশানুক্রমে ক্রেতাদের হৃদয়ে আসন পেতে রাখতে পেরেছে? যদি তাই হয় তবে তা কী করে সম্ভব হল?
কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপনের জোরে? না আধুনিক মার্কেটিংয়ের চালাকির জোরে?
কোনওটাই নয়। আমার মতে শুধু সততা আর ক্রেতাদের নির্ভেজাল বিশ্বাসের জোরে।
বোরোলীন দিয়ে বাংলার কিছু সফল ব্র্যান্ডিংয়ের স্মৃতিচারণা শেষ করলাম। পরের বারে আসছি বিদেশি ব্র্যান্ডের গল্প নিয়ে।
ওঃ হো। বোরোলীন নিয়ে আসল কথাটা বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম। জন্ম ইস্তক ওই আশ্চর্য মলম এখনও আমার নিত্যসঙ্গী। এখনও কেটে-ছড়ে গেলে ঠাকুমার কথা কানে ভাসে–
‘ওরে একটু ব্লোরীন লাগা…’