কাজ করতে ইচ্ছে না করলে, বা দেরিতে পৌঁছলে, গেঁটেবাতের এমন সদ্ব্যবহার ভূভারতে কেউ করেননি। সেটে আসতে লেট হলে, ক্রাচে ভর দিয়ে ঢুকতেন; বলতেন, ‘রাত থেকে ডান পায়ে সাংঘাতিক যন্ত্রণা…’ মুশকিল হল, লাঞ্চের পর ব্যথার বয়ান করতেন বাঁ পায়ে। ভুলে যেতেন সকালে কোন পা-টা দেখিয়েছিলেন।
মেনস্ট্রিম, ইন্ডি, মশালা, আর্টহাউজ– এসব কচকচানির অনেক আগে হৃষীকেশ খুঁজে পেয়েছিলেন মাঝামাঝি পথ। সিনেমা বানাতেন স্টারদের নিয়েই, কিন্তু স্টার-সুলভ দূরত্বে রাখতেন না তাঁদের; তাঁরা হতেন পড়শি। চোখ-ধাঁধানো আউটডোর নয়, তাঁর সিনেমায় জ্যান্ত হয়ে উঠত মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুম।
শুরুতে ছিলেন ক্যামেরাম্যান, কলকাতায়, নিউ থিয়েটার্সে। কিছুদিনের মধ্যেই বুঝেছিলেন, ছবিতে গল্প বলার আসল খেলা এডিটিংয়ে। নাড়া বেঁধেছিলেন বিখ্যাত এডিটর সুবোধ মিত্রের কাছে, স্টুডিওপাড়ায় যাঁর নাম ছিল ‘কাঁচিদা’। কাজেকম্মে হাত পাকিয়ে হৃষীকেশ পৌঁছলেন বম্বেতে, বিমল রায়ের কাছে। কয়েক বছরের মধ্যেই, টেকনিশিয়ান থেকে, হয়ে উঠলেন এ দেশের অন্যতম সেরা ফিল্মমেকার।
কম বাজেট, ভাল সিনেমা– এটাই ছিল হৃষীকেশের মন্ত্র। এ ব্যাপারে স্টারদের সঙ্গেও সমঝোতা করতেন না তিনি। নিজের মুখটা ডানদিক থেকে বাজে লাগে– এরকমই ভাবতেন ধর্মেন্দ্র। জোরাজুরি করতেন হৃষীকেশকে, যাতে শটটা বাঁদিক থেকে নেওয়া হয়। পরিচালক বলতেন, ‘আরে, ঠিক লাগ রহা হ্যায়…’ নায়কের গোমড়াপনা দেখে, ডিওপি জয়ন্ত পাঠারেকে বলতেন, ‘এক অর লে লে…’ টেক সেভেন পর্যন্ত নেওয়ার পর, অ্যাসিস্ট্যান্টকে বলতেন, ‘প্রিন্ট দ্য ফার্স্ট ওয়ান!’ বিরক্ত ধর্মেন্দ্র একদিন, হৃষীকেশকে অন্যদিকে ব্যস্ত দেখে, অ্যাসিস্ট্যান্টকে পাকড়ে, টেক থ্রি প্রিন্ট করতে বলে, বললেন, ‘না করলে আমি তোর…’। পরিচালক ঘুরে, মুচকি হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তিন নম্বরটাই ফাইনাল…’
মেহবুব স্টুডিওতে শুটিং চলছিল ‘সত্যকাম’-এর। হৃষীকেশ বহুদিন ধরে গেঁটেবাতে ভুগছিলেন। ইউনিটের সকলেই বিষয়টা জানতেন। ধর্মেন্দ্রকে ডেকে, তিনি বললেন, ‘‘আজ আর পারছি না! মাত্র একটা-দুটো শট নেওয়ার আছে… জয়ন্তকে বুঝিয়ে দিয়েছি, দু’জনে মিলে একটু সামলে নেবে, প্লিজ?” ধর্মেন্দ্রর তো হাতে চাঁদ! হৃষীকেশ চোখের আড়াল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, ডিওপি-কে হাঁকলেন, ‘ক্যামেরা ইধার রাখ!’ নিমেষে পুরো ডিরেকশন বদলে ফেললেন– লাইট, রিফ্লেক্টার, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল– সব! সবেমাত্র ‘অ্যাকশন’ বলতে যাবেন, এমন সময় কাঁধে কার যেন হাত! ঘাড় ঘুরিয়ে ধর্মেন্দ্র দেখলেন, হৃষীকেশ! মৃদু হেসে বলছেন, ‘দেখতে চাইছিলাম, আমি না থাকলে তুই কী কী করিস!’ হি-ম্যানের তখন একগাল মাছি।
রাজেশ খান্নাকে নিয়ে ডকুমেন্টারি বানিয়েছিল বিবিসি– ‘বম্বে সুপারস্টার’। বিভিন্ন শুটিংয়ের লোকেশনে ঘুরে ঘুরে কভার করছিলেন বিবিসি-র কলাকুশলীরা। হৃষীকেশের সেটে এসে দেখলেন, রাজেশ পৌঁছননি। বম্বেতে তখন মারাত্মক গরম। গোটা ইউনিট শট রেডি করে, হাঁ করে বসে আছে। কস্টিউম পরে, মেক-আপ নিয়ে রেখাও তৈরি। এসি-র নামগন্ধ নেই। আখাম্বা কয়েকটা ফ্যান, সেগুলো স্টারের জন্য রিজার্ভড। সকলে দরদর করে ঘামছেন। ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলেও, প্রকাশ করছেন না হৃষীকেশ। তিনি জানেন, এ দেশে বাঁচতে হলে, স্টারদের একসঙ্গে দশ-বারোটা সিনেমা করতে হয়। পড়ে-পাওয়া সময়টায় তিনি, আধশোয়া হয়ে, স্ক্রিপ্টে কিছু ঘষামাজা করছেন।
আরও পড়ুন: আমার বাংলা পাঞ্জাবির থেকে বেটার, বললেন একাবলী
শেষমেশ, নায়ক পৌঁছলেন দু’ঘণ্টারও বেশি লেটে, ভক্ত-পরিবৃত হয়ে। অতি-উৎসাহী একজন, ঘণ্টাধ্বনি দিয়ে জানান দিলেন কাকার আগমন। মহিলারা কলকলিয়ে উঠলেন, মানস-প্রেমিককে রক্তমাংসে দেখে। এদিকে, হৃষীকেশ বেপাত্তা! খুঁজতে খুঁজতে দেখা গেল, এককোণে মনোযোগ দিয়ে দাবা খেলছেন তিনি। রাজেশ বুঝলেন, মিটমাটটা তাঁকেই করতে হবে। দেরি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করার মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে পরিচালক বললেন, ‘‘এখানে আমি দাবা খেলতে আসিনি, কেউ এখানে সময় নষ্ট করতে আসেনি… গিভ অ্যান এক্সিলেন্ট শট, দ্যাট’স অল উই ওয়ান্ট…”
হৃষীকেশকে শিক্ষক মানতেন গুলজার, জয়া, অমিতাভ। জয়া আড়ালে বলতেন, ‘টিকি-ছাড়া মাস্টারমশাই’। কখনও রাত পর্যন্ত শুট চলতে থাকলে, আর জয়ার অন্য কোনও কাজ থাকলে, মুখ-ভার করে অভিনেত্রী বলতেন, “আজ দু’শিফটে কাজ করছি, টায়ার্ড হয়ে গেছি…”। পরিচালক চেঁচিয়ে ডাকতেন জয়ার ম্যানেজার সুশীলাকে; দু’জনকেই বকাবকি করতেন, ‘শুটের সময়েই তোমরা সবাই ক্লান্ত হয়ে যাও!’ তারপর, চিৎকার করতেন, ‘প্যাক আপ!’ যেদিন হৃষীকেশ বকতেন না, সেদিন মনখারাপ হত জয়ার। মনে করতেন, আজ বোধহয় কোনও ভুল হয়ে গেছে। ওঁর সঙ্গে কাজ করলে, কখনও ‘কাজ’ মনে হত না তাঁর। মনে হত, ছোটবেলার উঠোনে পা ছড়িয়ে বাদামভাজা খাচ্ছেন সবাই মিলে।
‘গুড্ডি’-র কাজ শুরু হয়েছিল জয়া-অমিতাভকে নিয়েই। পরে, অমিতাভের জায়গায় এসেছিলেন শমিত ভঞ্জ; কারণ, ততদিনে অমিতাভ পরিচিত হয়ে উঠছিলেন, আর হৃষীকেশ চাইছিলেন অচেনা মুখ। শুটিংয়ের প্রথম দিনে, দু’জনকে ডেকে, পরিচালক বলেছিলেন ‘গুড্ডি’-র জন্য নিজেদের ডাকনাম রাখতে। তক্ষুনি, জয়া নায়কের নাম দিয়েছিলেন ‘লম্বু’; অমিতাভ নায়িকার নাম রেখেছিলেন ‘গিটকু’ (ছোট্ট চেহারা)।
‘রাগ রাগিণী’-র (পরে, ‘অভিমান’) সেটে অমিতাভের কয়েকজন গেস্ট এসেছিলেন। হৃষীকেশকে দাবা খেলতে দেখে, গেস্টদের সঙ্গে অল্প আড্ডা জুড়লেন তিনি। ঘুরে তাকিয়ে, চেঁচিয়ে উঠলেন পরিচালক, ‘নিজেকে স্টার ভেবে ফেলেছ, অ্যাঁ? প্রোডিউসারের পয়সায় গল্প করছ!’ পরে, কাঁচুমাচু অমিতাভ হৃষীকেশের কাছে গিয়ে বললেন, ‘সকলের সামনে এভাবে বেইজ্জতি করলেন?’ দীর্ঘদেহীর কানে হৃষীকেশ ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘দাবায় হেরে যাচ্ছিলাম তখন, তাই একটু রাগ দেখিয়েছি…’
হৃষীকেশের অস্ত্র ছিল গেঁটেবাত। কাজ করতে ইচ্ছে না করলে, বা দেরিতে পৌঁছলে, গেঁটেবাতের এমন সদ্ব্যবহার ভূভারতে কেউ করেননি। সেটে আসতে লেট হলে, ক্রাচে ভর দিয়ে ঢুকতেন; বলতেন, ‘রাত থেকে ডান পায়ে সাংঘাতিক যন্ত্রণা…’ মুশকিল হল, লাঞ্চের পর ব্যথার বয়ান করতেন বাঁ পায়ে। ভুলে যেতেন সকালে কোন পা-টা দেখিয়েছিলেন। হৃষীকেশ কখনও কাউকে বলতেন না, ঠিক বা ভুল। অভিনেতারা রি-টেক চাইলে, বলতেন, ‘আমার ওপর ছেড়ে দাও, আই উইল শো ইট অন দ্য স্ক্রিন…’
‘আনন্দ’-এর প্রথম পরিকল্পনা ছিল বাংলা ভাষায় হবে; রোগী, রাজ কাপুর; ডাক্তারবাবু, উত্তম। ‘উল্টোরথ’-এ, ১৯৬২-তে, টিজার-পোস্টারও ছিল সে নিয়ে। অবশেষে, হিন্দিতে ফাইনাল হল। আনন্দের চরিত্রের জন্য একে-একে ভাবা হল শশী কাপুর আর কিশোর কুমারকে। ডাক্তারবাবু, মেহমুদ। বেঙ্গালুরুর এক ফ্লাইটে হৃষীকেশ ধর্মেন্দ্রকে গল্পটা শুনিয়ে, বললেন, ‘দারুণ ক্যারেক্টার, একসঙ্গে করব…’। তারপর, ধর্মেন্দ্র গেলেন চেন্নাইতে; হৃষীকেশ ফিরলেন বম্বেতে। পরদিন, হোটেলে, কাগজ খুলে ধর্মেন্দ্র দেখলেন, ‘আনন্দ’ করছেন রাজেশ খান্না! সেদিন রাত্রে, ভরপুর মাতাল হয়ে, তিনি ফোন করলেন পরিচালককে; সারারাত ঘুরেফিরে বলতে থাকলেন একটাই কথা, ‘হৃষীদা, আপনি আমার সঙ্গে কেন এমন করলেন?’ ছোটভাইকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো, ভোর পর্যন্ত, হৃষীকেশ না ঘুমিয়ে বলতে রইলেন, ‘ঘুমিয়ে পড়, তোকে পরে বুঝিয়ে বলব…’