Robbar

জন্মগত দুর্দশা যাদের নিত্যসঙ্গী, ভাঙা আয়নায় ভাগ্যবদল তাদের কাছে বিলাসিতা

Published by: Robbar Digital
  • Posted:May 1, 2025 7:57 pm
  • Updated:May 3, 2025 4:22 pm  
Soukarya Ghosal: Apayar Chhanda episode 4 about broken mirror

শিল্পবিপ্লবের পর আয়নার বিশ্বায়ন হল যখন, বড়লোকদের চৌকাঠ পেরিয়ে সাধারণ মানুষের দেওয়ালে দেওয়ালে তখন জায়গা করে নিল আয়না। আর তার সঙ্গেই ভাঙা আয়নার অপয়া গল্পও ঢুকে পড়ল আমজনতার দরবারে। কিন্তু ভাঙা আয়না যে সত‍্যিই অপয়া, এ ধারণা খানিকটা শ্রেণিগতও বটে। ভাঙা আয়না পাল্টে ফেলার সামর্থ যাদের নেই তারা অবলীলায় ঝেড়ে ফেলেছে এ কুসংস্কার। তাদের জন্মগত দুর্দশা যে একটা ভাঙা আয়না সাত বছরে ঘুঁচিয়ে দেবে, এ বিশ্বাস করা তাদের কাছে বিলাসিতা। দুদর্শা যার নিত‍্যসঙ্গী তাকে ভোলানোর তাকত নেই পশ্চিমি এই এলিট কুসংস্কারের।

সৌকর্য ঘোষাল

৪.

‘ভাঙা আয়না বাড়িতে রাখতে নেই’। ছোট থেকেই সতর্ক করে দেওয়া ছিল। কেন যে রাখতে নেই, আর কেনই বা যে আমাদের শোনানো হয়েছিল এ নিয়ম-কথা, পুরোটা ধোঁয়াশা।

আয়নার মতো প্রাপ্তবয়স্ক জিনিসে ছোটদের কি আদৌ অধিকার ছিল কোনও কালে? বরং ‘ছোটরা আয়না দেখে না’ এটাই দস্তুর। আয়না সাজার জন্য লাগে, ছোটরা তো ঠিক করে মাথার সিঁথিটুকুও কাটতে পারে না, তার আবার আয়না দিয়ে হবে কী? বরং কোথাও বেরোনোর থাকলে বা স্নানের পরে থুতনি ধরে, রগড়ে রগড়ে মাথার নুনছাল তুলে একটা চিরুনি দিয়ে গুরুজনেরা চুল আঁচড়ে দেবে, এটাই ভারতবর্ষ! ‘পথের পাঁচালী’ সে দৃশ্যকে অমর করে দিয়েছে তাই।

এখন এমন একটা জিনিসের প্রতি ছোটদের টান তো থাকবেই। বড়দের জন্য যা কিছু বরাদ্দ, ছোটদের সে সব আরও বেশি করে চাই। বিশেষ করে যে জিনিসটার দিকে তাকিয়ে মায়েরা টিপ পরে কপালে, সে জিনিসে শিশুদের অধিকার না থাকাটা একরকম বঞ্চনা। কিন্তু আয়না তো খুব দামি, আর ভঙ্গুরও। অনেকটা মোহের মতো। তাই ছোটদের থেকে দূরে রাখাই স্বাভাবিক। কিন্তু একবার ভেঙে গেলে যে জিনিসের আর কোনও দাম থাকে না, সোজা চলে যায় ক্ষমাহীন বাতিলের খাতায়, হিসেব মতো সেটা তো ছোটদের বরাতেই পড়া উচিত। সমস‍্যা হল, কেবল পথের কাঁটা হয়ে ফুঁটে থাকে অরণ্যের একটা প্রাচীন প্রবাদ– ‘ওটা অপয়া’! এদিকে কার্ডবোর্ড দিয়ে পেরিস্কোপ বানানোর জন্যে ওটাই যে দরকার, একথা আর বড়দের মনে থাকে না।

শুধু কি পেরিস্কোপ ভাঙা আয়নার টুকরো দিয়ে বশে আনা যেত সূর্যকেও। আমরা ইস্কুলে বলতাম ‘SUN SHOOTER’, ক্লাসের জানলার দিকে যে বেঞ্চগুলো তার ধারে গিয়ে বসে অ্যাঙ্গেল-মাফিক ভাঙা আয়নার টুকরোটা ধরে লক করতে হত সূর্যের রিফ্লেকশন, তারপর হাতের কায়দার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওই ঝলসানো ঝিকমিক টিপ করে ফেলতে হত কারও চোখে। খেলাটা হাইস্কুলে উঠে যাওয়ার পর প্রেম নিবেদনের কাজ করত বেশি। পাকা ছিল যারা, তারা রিফ্লেকশন চোখে না ছুঁড়ে গালে, গলায় বা বুকে তাক করত মেয়েদের, সেক্ষেত্রে জুটত ক্লাস টিচারকে করা পালটা কমপ্লেন। তবে ওই অপয়া আয়নার টুকরোয় ধরা সূর্যের ঝিকমিক প্রেম এনে দিত যাদের, তারা ভাগ্যবান হিসেবে নাম কুড়োত কুসংস্কারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে।

কাচের আয়না রোমান সাম্রাজ‍্যে আবিষ্কৃত হয় খ্রিস্টাব্দের প্রথম শতকেই। তার আগে মানুষ মূলত জল বা চকচকে ধাতুর ওপর নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে অভ্যস্ত ছিল। তাই তা ভেঙে যাওয়ার ভয়ও ছিল না। আর রোমান আয়না ছিল গোলকের মতো। লেবাননের কোনও এক মানুষ প্রথম কাচের গোলকের ভেতরে গলানো লিড বা টিনের আস্তরণ লেপে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এত স্বচ্ছ প্রতিবিম্ব মানুষ তার আগে দেখেনি। কিন্তু আয়নাটি বলের মতো গোল হওয়ার দরুন প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট হলেও ছিল ডিসটর্টেড। প্রায় দেড় হাজার বছর পর ষোড়শ শতাব্দীতে ইতালির মুরানো দ্বীপে ভেনেসিয়ান কারিগররা বিশ্বের প্রথম চ‍্যাপ্টা আয়নাটি বানায়, যেমন আমরা আজও ব্যবহার করি। সে সময় একেকটি আয়না বানাতে যে পরিমাণ শ্রম, সময় আর অর্থ ব্যয় হত, তা সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিল না। তাই পৃথিবীর বেশিরভাগ ভালো জিনিসের মতো আয়নাও তখন কুক্ষিগত ছিল রাজা-রাজরা, রইসদের হাতে। তাই গোড়া থেকেই সম্ভবত সাবধানে ব্যবহার করার সতর্কতা জাগানোর জন‍্যই প্রথম রটে যায়– আয়না ভাঙলে সাত বছরের দুর্ভাগ্য জুড়ে যাবে ছায়ার মতো, নিজের জীবনে।

আসলে কাচ আসার আগে পালিশ করা ধাতু দিয়ে যখন প্রতিচ্ছবি দেখার চল ছিল, তখন ভারতবর্ষ, মিশর, গ্রিস সব জায়গায় বিশ্বাসটা একই ছিল। আমাদের প্রতিবিম্ব হল আত্মার প্রতিরূপ। এরপর কাচ এসে যাওয়ায় যখন ভাঙার একটা প্রবণতা দেখা দেয়, তখন ভাঙা আয়নার সঙ্গে ভাঙা আত্মার ধারণাও ছড়িয়ে পড়ল ধীরে ধীরে। রোমানরা বলল, আয়না ভাঙার ফলে আত্মার যে আঘাত লাগে, তা সেরে উঠতে সাত বছর সময় দরকার। তবে এই সাত বছরের মধ্যে যে ঠিক কী হতে পারে, তা স্পষ্ট করে উল্লেখ ছিল না। চরম বিপদ হিসেবে মানুষ বরাবরই মৃত্যুকে মেনে এসেছে। তার ওপর যখন আত্মার চোট লাগার ব্যাপার, তখন মৃত্যু পা বাড়াবে, এটাই স্বাভাবিক! তাই একটি পরিবারে একটি আয়না একবার ভাঙলে গোটা ফ্যামিলি পরের সাত বছর মরণভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত। মজার কথা হল, ওই সাত বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার বা তৃতীয়বার আয়না ভাঙলে বিপদসীমা সাত থেকে বেড়ে ১৪ বা ২১ হয়ে যাবে কি-না বা মৃত্যু একবারের জায়গায় দু’-তিনবার হবে কি না, তার খবর ইতিহাসের কাছেও নেই।

উইচক্রাফ্টের সময় একইভাবে আয়নাকে ব্যবহার করা হত বিদেহী আত্মাকে কবজা করার কাজে। সুতরাং, সে আয়না ভেঙে গেলে ধরে নেওয়া হত ফাটলের মধ্যে থেকে সেই বিদেহী আত্মা গলে বেড়িয়ে আসতে পারে। এই ধারণা লৌকিক গল্পে, সাহিত্যে বা আরও পরবর্তীকালে হরর সিনেমায় ভাঙা আয়নাকে আরও কুখ্যাত করে তোলে।

শিল্পী: সৌকর্য ঘোষাল

শিল্পবিপ্লবের পর আয়নার বিশ্বায়ন হল যখন, বড়লোকদের চৌকাঠ পেরিয়ে সাধারণ মানুষের দেওয়ালে দেওয়ালে তখন জায়গা করে নিল আয়না। আর তার সঙ্গেই ভাঙা আয়নার অপয়া গল্পও ঢুকে পড়ল আমজনতার দরবারে। কিন্তু ভাঙা আয়না যে সত‍্যিই অপয়া, এ ধারণা খানিকটা শ্রেণিগতও বটে। ভাঙা আয়না পালটে ফেলার সামর্থ যাদের নেই তারা অবলীলায় ঝেড়ে ফেলেছে এ কুসংস্কার। তাদের জন্মগত দুর্দশা যে একটা ভাঙা আয়না সাত বছরে ঘুঁচিয়ে দেবে, এ বিশ্বাস করা তাদের কাছে বিলাসিতা। দুদর্শা যার নিত‍্যসঙ্গী তাকে ভোলানোর তাকত নেই পশ্চিমি এই এলিট কুসংস্কারের। তাদের ঘরে আয়না ভেঙে গেলে ওমনিই ঝুলে থাকে। তারা তাতে মুখ দেখে, চুল বাঁধে, দাঁড়ি কামায়, ক্রিম মাখে আর কাঁচের ভাঙা ফাটলগুলো মিলে জুলে ঘর করে ভাঙা দেওয়াল আর ফুটো চালের সঙ্গে। সে ফাটল তাদের কাছে হয়ত অনেক বেশি চেনা, অনেক বেশি আপন। আক্ষরিক অর্থে তাদের যাপনের প্রতিবিম্ব।

……………………………

ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল

……………………………

সিরিয়ার যুদ্ধের সময় বহু বিখ্যাত ফটোগ্রাফার রিফিউজি ছেলে-মেয়েদের বিভিন্ন হৃদয় নিঙরানো ছবি তুলে আরও বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। আমার মনে আছে একটা ছবির কথা। সম্ভবত বোমার স্প্লিন্টারে একটি আয়না ভেঙে ফুটো হয়ে গেছে। আর ফুলের মতো একটা মেয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে ফ‍্যালফ‍্যাল করে দেখছে নিজের অন্তরাত্মার প্রতিচ্ছবি। তার গাল বেয়ে নেমে গেছে কাচের ফাটল, চোখের জলের মতো। যা হয়তো খান খান করে থাকবে তার অস্তিত্ব।

ভাঙা আয়না আসলে বড়লোকের জন্যই অপয়া। সবহারাদের কাছে সে চোখের তারায় আয়না ধরে।। কান্না হয়ে ঝড়ে পড়ে আর আদর করে।

……………..অপয়ার ছন্দ অন্যান্য পর্ব……………..

পর্ব ৩। পশ্চিম যা বলে বলুক, আমাদের দেশে ১৩ কিন্তু মৃত‍্যু নয়, বরং জীবনের কথা বলে

পর্ব ২। শনি ঠাকুর কি মেহনতি জনতার দেবতা?

পর্ব ১। পান্নার মতো চোখ, কান্নার মতো নরম, একা