বাহনদের সঙ্গে দেবদেবীর বেশ মাখামাখি সম্পর্ক। বাহনরা তাদের কাঁধে পিঠে বহন করে। রেলস্টেশনের লালকোট পিতলের চাকতি পরা কুলিদের মতো। চাকা লাগানো গাড়ি টানা বলদ, ঘোড়া, হাতির নিদর্শন হরপ্পায় দেখা গেলেও দেবতাদের বাহন হিসাবে খুব একটা দেখা মেলে না। গাড়ি টানলে ফেইথফুলনেস চলে যায়। বাহনরা একটু উন্নাসিক গোছেরই হয় সাধারণত। সওয়ারির প্রতিরক্ষার কাজে উদাসীন। তারা স্ব-ভাবে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। বলদ বা নন্দী শিবের অনুচরই শুধু আশপাশে ঘুরঘুর করে।
১.
শিবের বলদ
ঠাকুর দেবতারা আসা-যাওয়া করেন শুধু আকাশপথেই নয়, স্থলে, জলে,পাহাড় পর্বতের চড়াই-উতরাই বেয়েও। ভ্রমণ শেষে উপবিষ্ট হন প্রধানত পদ্মফুলের ওপর। তবে কেউ কেউ আবার ঠায় বসে থাকেন বাহনের পিঠে। ঠাকুর দেবতাদের দৈবগুণাগুণের সঙ্গে তাল মিলিয়েই বাহন নির্বাচন করা হয়েছে। এসব মানুষেরই কাজ। খুঁজে পেতে একটা ইকোলজিকাল সিস্টেম বানানো। দেবভূমিতে গোটা একটা চিড়িয়াখানা জুড়ে দেওয়া।
গুটিকয় বাহন আছে নামধারী। প্রপার নাউন। যেমন দেবরাজের হাতিবাহন ঐরাবত। বাকি অধিকাংশই কমন নাউন। হাঁস, প্যাঁচা, ময়ূর, গাধা, ইঁদুর ইত্যাদি। মানুষ আর পাখি মিলিয়ে আছে গড়ুর। বিষ্ণুর বাহন। Zoomorphic। মিশরে যেমন আনুবিস, বাসতেত্ তেমন।
আমাদের বাজারে বিশালদেহী এক ষাঁড় আছে। ধূসর সাদায় মিশিয়ে বেশ চকচকে। একটু বেলার দিকে বাজারে নিয়মিত আসে হেলতে-দুলতে। কপি, কুমড়ো আদায় করে বাজারিদের থেকে। সবাই ওকে ‘ভোলাদা’ বলে। মালিকের নামে নামকরণ। শিবের বাহন কি না।
শিবের বাহনের নাম আসলে নন্দী। সে শিবের অনুচর। শিব মন্দিরের লাগোয়া তার আসন। তার কানে কানে মনের বাসনা জানালে তা সরাসরি বাবার কানে পৌঁছয়। দেবতাদের মধ্যে জনপ্রিয়তম শিব। বাহন-সহ তার নিদর্শন পাওয়া যায় মহেঞ্জোদারোর সিলমোহরেও। তিনি পশুপতিনাথ।
‘এই নামের থেকে অনুধাবন করা যায় যে পশুপালনাদির সঙ্গেও তার সম্পর্ক আছে– বিশেষত গো সম্পদের মালিক ছিলেন। তাঁর ষাঁড়ের পিঠে চেপে ঘুরে বেড়ানো থেকেও সেটা অনুমান করা সম্ভব। মঙ্গলকাব্যে তাকে কৃষিকাজ করতেও দেখেছি আমরা। অর্থাৎ পশুপালন ও কৃষিকাজ এই দুই জীবিকার প্রধান দেবতা হলেন শিব।’ (শীতল গঙ্গোপাধ্যায়: শিবের ইতিবৃত্তান্ত)।
বাহনদের সঙ্গে দেবদেবীর বেশ মাখামাখি সম্পর্ক। বাহনরা তাদের কাঁধে পিঠে বহন করে। রেলস্টেশনের লালকোট পিতলের চাকতি পরা কুলিদের মতো। চাকা লাগানো গাড়ি টানা বলদ, ঘোড়া, হাতির নিদর্শন হরপ্পায় দেখা গেলেও দেবতাদের বাহন হিসাবে খুব একটা দেখা মেলে না। গাড়ি টানলে ফেইথফুলনেস চলে যায়।
বাহনরা একটু উন্নাসিক গোছেরই হয় সাধারণত। সওয়ারির প্রতিরক্ষার কাজে উদাসীন। তারা স্ব-ভাবে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। বলদ বা নন্দী শিবের অনুচরই শুধু আশপাশে ঘুরঘুর করে।
সিংহের মতো নয়। পশুরাজ বেশ তর্জন গর্জন করে, অসুরের সঙ্গে কুস্তি করে। নন্ ভেজ কি না। তাকে শিবের বাহন বেশ ভয় পায়। প্রমাণ আছে। বর্তমানে দিল্লি আর্ট গ্যালারির সংগ্রহের আর্লি বেঙ্গল স্কুলের একটা তেলরঙের ছবিতে।
সেখানে পার্বতীর কৌতুকই শুধু নয়, বাহনদের চরিত্রচিত্রণও বর্ণিত আছে। নেশাগ্রস্ত পতির শাস্তি হেতু বাহন সিংহকে ষাঁড়ের দিকে লেলিয়ে দেওয়া আর ময়ূর, ইঁদুরের সভয়ে পালানো সব মিলিয়ে অনবদ্য। ছবিতে বর্ণিত পঙক্তিগুলো স্মরণীয়–
‘‘কোচ গৃহে কেলি করি প্রত্যাগত হর। সম্বিদায় টলমল বৃষের উপর।।
ভবের সে ভাব দেখি ভবানী রুষিত। ভ্রুকুটি ভঙ্গীতে সিংহে করেন ঈঙ্গিত।।
ঘোর নাদ করে সিংহ ভয়ে বৃষ ধায়। সে লম্ফ ঝম্ফে হর ধরনী লুটায়।।
করতালি দেন গৌরী সহাস্য বদন। শ্লেষাভাষে সম্ভাষেণ ‘কেমন এখন!’
অপূর্ব অদ্ভুত হরগৌরীর কৌতুক। থাকুক ভক্তের মনে সদা জাগরুক।।’’
শিবের বাহনটি ভীতুও বটে।
……………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved