‘ভারতবর্ষ ভগবানের বড় আদরের স্থান– এই মহাদেশে লোকশিক্ষার নিমিত্ত ভগবান যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করিয়া… প্রত্যেক ভারতবাসীর হৃদয়ে ধর্ম্মের ও সত্যের বীজ রোপণ করিয়া গিয়াছেন,’ বছর পনেরোর কিশোর সুভাষচন্দ্র বসু লিখেছিলেন তাঁর মাকে। আজকের দলীয় রাজনৈতিক বিতর্কে সুভাষচন্দ্রকে একদিকে তুলে ধরা হয় হিন্দুত্ববিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ বামপন্থী হিসাবে, অন্যদিকে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে মুসলিম তোষণের। দলীয় মতবাদের চাপান উতোরে ঢাকা পড়ে যায় সুভাষচন্দ্রের নিজস্ব মত।
বর্তমান সময়ে যে প্রশ্ন বারবার উঠে আসছে তা হলো ধর্ম কি ‘ব্যক্তিগত’ না ‘সামাজিক’? অথবা কতটা ব্যক্তিগত আর কতটা সামাজিক? নিরপেক্ষ গবেষণা ও তথ্য-ভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে বিতর্কের অবসান হওয়া দূরের কথা, আজকের দলীয় রাজনৈতিক মেরুকরণের আবহাওয়ায় কোনও রকম ভাবনা চিন্তা ছাড়াই যে কোনও ব্যক্তিত্ব বা মতামতের উপর চটপট কোনও একটা তকমা– ধর্মনিরপেক্ষ, সাম্প্রদায়িক, হিন্দুত্ববাদী, মৌলবাদী, তোষণকারী ইত্যাদি বিশেষণ-প্রবণতা প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। এই প্রবণতার হাত থেকে আধুনিক ভারতীয় ইতিহাসের মহাপুরুষরাও রেহাই পাচ্ছেন না।
এমতবস্থায় যে ব্যক্তির ধর্মনিরপেক্ষতাকে তাঁর চরমতম বিরোধীরাও আধুনিক ভারতের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁর জীবন থেকে কিছু শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। ‘ভারতবর্ষ ভগবানের বড় আদরের স্থান– এই মহাদেশে লোকশিক্ষার নিমিত্ত ভগবান যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করিয়া… প্রত্যেক ভারতবাসীর হৃদয়ে ধর্ম্মের ও সত্যের বীজ রোপণ করিয়া গিয়াছেন,’ বছর পনেরোর কিশোর সুভাষচন্দ্র বসু লিখেছিলেন তাঁর মাকে। আজকের দলীয় রাজনৈতিক বিতর্কে সুভাষচন্দ্রকে একদিকে তুলে ধরা হয় হিন্দুত্ববিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ বামপন্থী হিসাবে, অন্যদিকে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে মুসলিম তোষণের। দলীয় মতবাদের চাপান উতোরে ঢাকা পড়ে যায় সুভাষচন্দ্রের নিজস্ব মত।
সোজা কথায় বলতে হলে সুভাষচন্দ্রের ধর্ম চেতনাকে যদি আজকের রাজনৈতিক মতাদর্শের সংঘাতে ও বিতর্কে হিন্দুত্বের নিরিখে বিচার করতে হয়, তাহলে তা সমান ভাবে করা প্রয়োজন সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার বর্তমান বিবর্তিত ধারণার ক্ষেত্রেও। এই দুই মতবাদের পরিপ্রেক্ষিতে কোথায় পাই সুভাষচন্দ্রকে? কোনও তকমা লাগানো যায় কি তাঁর উপর?
ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্কে অনেকেই বলে থাকেন যে তাঁরা ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ কিন্তু সামাজিক ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্মপরায়ণতার কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা না থাকলেও, ধরে নেওয়া যাক যাঁরা ও কথা বলেন তাঁরা নিয়মিত পূজা অর্চনা করেন ও ধর্মগ্রন্থ পাঠ করেন। যদিও বেশির ভাগই শুধু ঠাকুর প্রণামকেই ধর্মপরায়ণতার পরাকাষ্ঠা ধরে নেন। তাঁর সমকালীন নেতৃবৃন্দের অনেকে ধর্ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলেও সুভাষচন্দ্রের দুটো বিশেষত্ব তাঁকে সবার থেকে আলাদা করে। প্রথমত, তিনি ছিলেন আধুনিক দৃষ্টি ও যুক্তিবাদী মানসিকতা সম্পন্ন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি। সর্বোপরি ধর্মের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শুধু তাত্ত্বিক ছিল না। সাধনায় নিমজ্জিত হয়েছিলেন তিনি। তিনি নিজে এ বিষয়ে আলোচনা না করলেও, তাঁর অনেক সঙ্গীই সাক্ষ্য দিয়েছেন পরবর্তীকালে।
সুভাষচন্দ্রের হিন্দুত্ব বিরোধী রাজনীতি নিয়ে বর্তমানে অনেক আলোচনা হলেও তার অধিকাংশই ঢেকে যায় দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থের বিকৃতিতে। আসল ঘটনা হল সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক কর্মজীবনে বীর সাভারকরের হিন্দুত্ব রাজনৈতিক মূলস্রোতে জায়গা করে নিতে পারেনি। সুভাষের নিজেই পরিষ্কার করে গেছেন হিন্দু মহাসভার সঙ্গে তাঁর বিরোধিতার কারণ। ৩০ মার্চ ১৯৪০ ফরওয়ার্ড ব্লক মুখপত্রে স্বাক্ষরিত সম্পাদকীয়তে তিনি লেখেন, যে বাঙালি হিন্দুরা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মেরুদণ্ডস্বরূপ, তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসাটা হিন্দু মহাসভার ইতিহাসে একটা নতুন অধ্যায়। সেখানেই ছিল তাঁর আপত্তি: “প্রকৃত হিন্দু মহাসভার সঙ্গে আমাদের কোনও ঝগড়া বা সংঘাত নেই। কিন্তু রাজনৈতিক হিন্দু মহাসভা জনজীবনে কংগ্রেসকে প্রতিস্থাপন করার উদ্দেশ্যে আমাদের বিরুদ্ধে পা বাড়ানোয় তার সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য।’ ঝাড়গ্রামে দেওয়া এক বক্তৃতাতেও তিনি বলেন, ‘হিন্দু মহাসভা হিন্দু মহাসভার কাজ করুক, কংগ্রেস কংগ্রেসের কাজ করুক তাহা হইলে গোলমাল থাকে না।’
ফরওয়ার্ড ব্লকে সাভারকর সম্বন্ধে লেখা হয়, ‘দৃশ্যতই মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার ভয়ানক বৃদ্ধির ফলে শ্রী সাভারকরের মনে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে। নিঃসন্দেহে এই বৃদ্ধি দেশের বর্তমান রাজনীতির পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক,’ কিন্তু সেই জন্য দেশকে দু’টি যুযুধান শিবিরে ভাগ করে ভবিষ্যতে রক্তপাতের দিকে এগিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।
হিন্দু মহাসভার দ্বিজাতিত্ত্ব ও রাজনৈতিক কার্যাবলির বিরোধিতা করার পাশাপাশি এ-ও দেখা যায় যে সুভাষচন্দ্রের ভারতেতিহাস ধারণার ভিত্তি ছিল তাঁর নিজস্ব হিন্দু চেতনা। দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল-এ তিনি লেখেন, ইতিহাসের ধারা বেয়ে ভারত যে বহু জাতিকে আপন করে নিয়ে একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে তুলতে পেরেছে তার সবচেয়ে বড় কারণ হিন্দুধর্ম। ‘সমস্ত হিন্দু ভারতকে পবিত্র ভূমি হিসাবে দেখে।’ তিনি লেখেন ‘উত্তর হোক বা দক্ষিণ, পূর্ব হোক বা পশ্চিম, যেখানেই যান সেখানেই পাবেন একই ধর্মীয় ভাবনা, একই সংস্কৃতি এবং একই ঐতিহ্য।’ একই ধরনের কথা তিনি বলেন ১৯৪৪-এর নভেম্বরে টোকিও ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটিতে তাঁর বক্তৃতাতেও।
১৯২৭-এ সুভাষ তাঁর মেজবউদিদি বিভাবতী দেবীকে লেখেন, ‘ছেলেদের সকলকে কাশীরাম দাসের মহাভারত ও কৃত্তিবাসের রামায়ণ পড়তে দিবেন।…মহাভারত ও রামায়ণ আমাদের সভ্যতার মূলভিত্তি, একথা আমি যত বড় হচ্ছি তত বুঝতে আরম্ভ করেছি।’
রাজনীতিতে ব্যবহৃত সুভাষচন্দ্রের ভাষাও ছিল হিন্দু কৃষ্টির উপমায় সম্পৃক্ত। এই ব্যবহার বারবার দেখা যায় তাঁর বক্তৃতা ও নানা রচনায়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯২৫ সালের শেষের দিকে ‘দেশের ডাক’ প্রবন্ধে লেখেন:
“বঙ্গজননী আবার একদল নবীন তরুণ সন্ন্যাসী চান।… মায়ের হাতে তোমরা পাবে শুধু দুঃখ, কষ্ট, অনাহার, দারিদ্র্য ও কারাযন্ত্রণা। যদি এই সব ক্লেশ ও দৈন্য নীরবে নীলকণ্ঠের মত গ্রহণ করতে পার– তবে তোমরা এগিয়ে এসো… তোমরাই তো সকল দেশে আত্মদানের পুণ্য ভিত্তির উপর জাতীয় মন্দির নির্মাণ করেছ…তাই বলছি, তোমরা সকলে এসো, ভ্রাতৃবন্ধনের ‘রাখি’ পরিধান করে, মায়ের মন্দিরে দীক্ষা নিয়ে আজ এই প্রতিজ্ঞা করো যে, মায়ের কালিমা তোমরা ঘুচাবে, ভারতকে আবার স্বাধীনতার সিংহাসনে বসাবে এবং হৃতসর্বস্বা ভারতলক্ষ্মীর লুপ্ত গৌরব ও সৌন্দর্য পুনরুদ্ধার করবে।”
সুভাষচন্দ্র কি ধর্মকে কখনও রাজনীতির আঙিনায় আনেননি? জেলের ভিতর আনুষ্ঠানিক ভাবে পূজা করার অধিকার নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যেভাবে বারবার সংঘর্ষে গিয়েছিলেন, তা কিন্তু অন্য কথা বলে। মান্দালয় জেল থেকে কর্তৃপক্ষকে তিনি লেখেন, ‘আমাদের কাছে ধর্ম নিছক সামাজিক সম্মিলন, বুদ্ধিবিলাস বা ছুটির দিনের উৎসব নয়।…ধর্ম আমাদের সমগ্র জাতীয় ও ব্যক্তিসত্তায় পরিব্যাপ্ত। এর ভিত্তিতেই আমাদের সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে উঠেছে।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন কেন, ‘সামান্য কয়েকজন খ্রীস্টান অপরাধীর ধর্মানুষ্ঠান পালনের জন্য বছরে ১২০০ টাকা দেওয়া হয়, কিন্তু উচ্চশিক্ষিত, সংস্কৃতিবান হিন্দু রাজবন্দীদের ধর্মানুষ্ঠান পালনের জন্য একটা পয়সাও দেওয়া হয় না।’ ১৯২৮-এ তিনি সিটি কলেজে সরস্বতী পূজা করার দাবিতে আন্দোলনরত হিন্দু ছাত্রদের প্রকাশ্যে সমর্থন করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। আজকের দিনে এসব কথা ওই ভাষায় বললে হয়তো তাঁকে হিন্দুত্ববাদী বলে দাগিয়ে দিতে বিলম্ব হত না।
রক্ষণশীল ও হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে সুভাষ যেমন খড়গহস্ত ছিলেন, তেমনই মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে স্পষ্ট কথা বলতে সংকোচ করতেন না। ১৯৩৭-এ বন্দে মাতরম বিতর্ক নিয়ে তিনি জওহরলাল নেহরুকে লেখেন, “আজ যদি তুমি ‘বন্দে মাতরম’-এর ব্যাপারে [সাম্প্রদায়িক মুসলমানদের] পুরোপুরি সন্তুষ্ট করো, কাল তারা আবার নতুন দাবি তুলতে দেরি করবে না।”
১৯৪৫ সালে লাল কেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের সময় শাহ নওয়াজ খান বলেন যে এহেন সুভাষচন্দ্রকে দেখেই মুসলমান অফিসারদের বিশ্বাস জন্মায় যে, আজাদ হিন্দ ফৌজ সত্যিই এক জাতীয়তাবাদী সংগঠন, যেখানে কোনও সম্প্রদায়কে ছোট বা বড় করে দেখা হবে না; সুভাষচন্দ্র এমনই এক নেতা যিনি সবাইকে কাছে টেনে নিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।
আসলে, বর্তমান সেক্যুলার রাজনীতিকদের মতো সুভাষচন্দ্র কোনও দিন তাঁর হিন্দু পরিচয় ও চেতনা নিয়ে কথা বলতে সংকোচ বোধ করেননি। তাঁর হিন্দু চেতনা ছিল আত্মবিশ্বাসী, ভারতের হিন্দু ঐতিহ্য সম্বন্ধে তিনি ছিলেন গর্বিত। তা নিয়ে কথা বললে অন্য কারও অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে সেই অনাবশ্যক শঙ্কা তাঁর মধ্যে দেখা যায় না। তাঁর অন্তর্নিহিত চেতনার শক্তিতেই তিনি সবাইকে আপন করতে পেরেছিলেন। নতুন ভারত গড়তে সকল সম্প্রদায়ের গুরুত্ব ও দায়িত্ব বোঝানোর চেষ্টায় অনেকাংশে সফলও হয়েছিলেন।
তবুও, কিছু উগ্র দক্ষিণপন্থী চিন্তক অভিযোগ করেছেন যে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য সুভাষচন্দ্র মুসলিম তোষণ করতেও পিছু পা হতেন না। উদাহরণ হিসাবে দেওয়া হয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের বেঙ্গল প্যাক্ট, ১৯৪০-এ কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে মুসলিম লিগের সঙ্গে জোট বাঁধা, ও আজাদ হিন্দ ফৌজে মুসলমানদের প্রাধান্য দেওয়া। সে প্রসঙ্গ পরবর্তী কিস্তিতে।
আমরা এক সময় গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়, অংশুমান রায়ের সুরে ও কণ্ঠে ‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি/ আকাশে বাতাসে ওঠে রণি/ বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ গান শুনে রোমাঞ্চিত হয়েছি– তাই বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে আমি খুবই মুষড়ে পড়েছিলাম।