শুনলাম, মতিবাবু সন্ধেয় ঢুকে রাত্তিরে বেরোতেন। হুইস্কি বা ভদকা, যে কোনও এক কুহকে বন্দি হয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও দিব্যেন্দু পালিত, সময়ের খুলি গুলিতে উড়িয়ে! সন্তোষকুমার ঘোষের রিপোর্টিংয়ের ‘অকুস্থল’ ছিল ডিউক। ইন্দিরা গান্ধীর প্রয়াণের দিন ‘আনন্দবাজার’-এর প্রথম পাতার শিরোনাম নাকি তিনি করেন এখানে বসে, চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউয়ের ছিমছাম ‘বার’-এ! টাইগার পটৌডি আবার ‘স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড’-এর দায়িত্বে থাকার সময় মাঝেসাঝে চলে আসতেন লাঞ্চ করতে। কখনও একা, কখনও খুদে সইফকে সঙ্গে নিয়ে। ফিশ অ্যান্ড চিপস খেতে পছন্দ করতেন নবাব। সঙ্গে কফি।
২.
ওদের একটা সিঁড়ির তলা আছে। বরাহনগরে আমার পুরনো মামাবাড়িতে ছিল যেমন। একাকী। নিঃসঙ্গ। দুঃখী। অভিমানী। ছেলেবেলা থেকে সিঁড়ির তলাকে একই সঙ্গে প্রহেলিকা ও প্রশ্রয় মনে হয় আমার। সচরাচর চটি-স্তূপ আর হলদে খবরের কাগজের ডাঁইয়ের মতো ইতর বস্তুর ঠাঁই হয় সেখানে। বড়জোর জড়াজড়ি তার। তার জটিল রসায়নের জিলিপি প্যাঁচ। একখানি নিরীহ সুইচ-বাক্স। তবু ছেলেবেলা থেকে সিঁড়ির তলা আমায় টানত বড়। কেমন ঘরের মধ্যে ঘর, ফুচকার ফাউয়ের মতো। গুরুজনদের চোখরাঙানি, তাঁদের গাঁট্টা-অভিলাষী হাতকে দিব্য ‘ড্রিবল’ করে যেখানে ছোট্ট শরীরটাকে গলিয়ে দেওয়া যেত। উবু হয়ে বসে মানসচক্ষে কষে ফেলা যেত কে সি নাগের কঠিন আঁক– রামবাবুর বাগানের কাঁচা আম পাড়িতে লাফাইতে হইবে ঠিক কতখানি?
ওদের সিঁড়ির তলাখানিও অমন। একাকী। নিঃসঙ্গ। দুঃখী। অভিমানী। সাত চড়ে রা কাড়ে না। পিঠের ওপর দিয়ে জুতো মশমশিয়ে লোক দোতলা উঠে গেলে টুঁ শব্দ করে না। ওদের বলতে, ডিউকের। চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউয়ের ‘ডিউক বার অ্যান্ড রেস্তোরাঁ’-র। আমাদের ‘সংবাদ প্রতিদিন’ আপিসের ঠিক উল্টো রাস্তায় যেটা পড়ে। সকাল ১১টা থেকে যার সদর দরজা খুলে যায়। গম্ভীর দ্বাররক্ষী পেরিয়ে যার গর্ভগৃহে পাওয়া যায় শালপ্রাংশু এক ভদ্রলোককে। ‘ডিউক’-এর মালিক তৃপ্তিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে। বার্ধক্যেও দীপ্ত দৃষ্টিতে বসে থাকেন যিনি, দু’চোখে কৃত্তিবাস যুগের বিস্মৃত দলিল নিয়ে। আর তাঁর বাঁ-চোখ বরাবর, টিমটিমে আলো জ্বেলে, সকাল থেকে আটপৌরে বাসর সাজায় সে, সিঁড়ির ‘ছাদনা’-তলা। ঝিমোয়। আলসেমি করে। মৃদু নাক ডাকে। নির্নিমেষ অপেক্ষা করে তার মধ্যাহ্ন কিংবা প্রদোষ-মিত্রদের!
সে দিন ‘বারবেলা’-র লেখা লিখব ভেবে ‘ডিউক’-এ ঢুকে সর্বপ্রথম সেই সিঁড়ির তলায় নজর গেল। ফাঁকা। দেখে বেশ লোভও হল। জানি, বাংলা সাহিত্যের প্রচুর ঋষি-মণীষীরা ওপর থেকে দেখছেন, কোথাকার কোন তেএঁটে ছোঁড়ার হিম্মত দেখে তাঁরা যার পর নাই কুপিতও হচ্ছেন। কিন্তু তৃতীয় রিপুকে বশে রাখারও বা উপায় কী? আহা, দিওনিসুসের (গ্রিক পুরাণে মদের দেবতা) উপাসনা গৃহে সেঁধিয়ে গেলেই তো চলে না। উপাসনার জবরদস্ত আসনও বাগানোর প্রয়োজন আছে। আর ‘ডিউক’ নামক সুরা-লয়ে ওটিই আমার সিংহাসন, ওটিই আমার কুশাসন!
কিন্তু নাহ্, সংযম দেখাতে হবে। অন্তত আজকের মতো লোভ শাসন করতে হবে। ঢুকেই দেখেছি, তৃপ্তিবাবু বসে। যাঁকে নিয়ে দুঃখ করে বিমল কর লিখে গিয়েছিলেন, সাহিত্যের আড্ডাখানা খুলে ব্যবসা চলে না! তৃপ্তিবাবুর থেকে জেনে নিতে হবে, ‘বার’-এর মতো একখানা খাসা ব্যবসা ফেঁদেও তিনি মন দিয়ে তা করলেন না কেন? কেনই বা ব্যালান্স শিট মেলানো ছেড়ে সাহিত্যের সাগর-সঙ্গমে পুণ্যস্নানে ব্রতী হয়ে পড়লেন? অথচ বিলক্ষণ জানি, মদ এদের চমৎকার। খাবার-দাবার আরও চমৎকার। দেখতে গেলে, মদিরা ব্যবসায়ীর পোয়াবারো। পান-ভোজনের এলাহি আয়োজন যে একেবারে, ‘মদ্যপায়ী’দের সম্মোহিত না হয়ে উপায় আছে? মৌরলা মাছ ভাজা, কাতলা পেটি ফ্রাই, তোপসে ভাজা, ভেটকি ফ্রাই, উফ তোফা! ফিস স্টাফড মাটন বলে একখানা বস্তু আছে, যার ওপরে ভেটকির ফিলে, ভেতরে মাংসের পুর। যা একবার চেখে দেখতে যাওয়া যায় সাত-সমুদ্দুর। মাটন লিভার কারি-ফিশ ফিঙ্গারের কথাও বা আলাদা করে কী বলব? এক-একখানা ফিঙ্গার এই অ্যাত্তো বড়! ওল্ড মংক কিংবা বাডওয়াইজারের এক-এক চুমুকের সঙ্গে এক-এক কামড় ফিশ ফিঙ্গার, রীতিমতো মহাকাল দর্শন বুঝলেন কি না, হেঁ হেঁ!
ধুর শালা, জীবনটা পুড়ে খাক হয়ে গেল! কপালে কাল থেকে মদ ঘষব। সুরা-দেবী যদি তাতে সুপ্রসন্ন হন, যদি তাতে ভাগ্য ফেরে, যদি তাতে ভরদুপুরে কলমের বদলে ‘কনিয়াক’ নিয়ে বসতে পারি! আর ওই যে আপদকে দ্যাখো, ব্যাগের ফাঁক দিয়ে কেমন ভালোমানুষের মতো চোখ-মুখ করে উঁকি দিচ্ছে, যেন সর্বাঙ্গে কলমের ঘষা না খেলে বাবুর ভাতঘুম হবে না! নোটবই হে, নোটবই। যাক গে, বার করি। কয়েকটা ফ্যাক্ট চেক দরকার। পেশার সিনিয়রদের কাছে বিস্তর শুনেছি, ‘ডিউক’-এ মতি বাবু (নন্দী) আসতেন। শক্তিবাবুর (চট্টোপাধ্যায়) পায়ের ধুলো পড়ত নিয়মিত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ফাঁক-ফোঁকরে ঢুকে পড়তেন। প্রথম দিকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কেও দেখা যেত। সমস্ত সত্যি, সব? সেক্ষেত্রে শক্তিবাবুর দু’একখানা গল্প বের করা খুব দরকার। প্রয়াণের এত দিন পরেও উনি যে ‘রিপোর্টার্স ডিলাইট’!
তৃপ্তিবাবু নিজে কিছু বললেন না। ছেলেকে (শুভদীপ চট্টোপাধ্যায়) বললেন, ‘তুই বলে যা। আমি শুনছি। ভুলভ্রান্তি হলে ধরিয়ে দেব।’ তা, শুভদীপবাবু বললেন, ‘শক্তি বাবুর গল্প শুনবেন? বলছি শুনুন। উনি প্রায়শই অত্যধিক বেশি মদ্যপান করে ফেলতেন। আমি বারণ করতে যেতাম। কিন্তু কপালে জুটত ধমক। আমায় বলতেন, তোর বাপ আমাকে বারণ করে না, আর তুই এসেছিস বলতে!’ কথা শেষে দমকা হাসি। আর সে হাসির অলি-গলি গলে ঢুকে পড়ে আরও দু’একখানা গল্প। একবার নাকি শক্তিবাবু ট্যাক্সির ভাড়া না মিটিয়ে ‘ডিউক’-এ ঢুকে পড়েছিলেন এবং পিছনে হাঁসফাঁস করে দৌড়ে আসছিলেন পাঞ্জাবি ড্রাইভার। দারোয়ানের সঙ্গে তাঁর বচসা দেখে কর্মচারীরা তৃপ্তিবাবুকে খবর দেন এবং তিনি শেষ পর্যন্ত ভাড়া মেটান। আর একবার শুনলাম, মদ্যপান করে শক্তিবাবুর নেশা এতটাই উর্ধ্বগামী হয়ে যায় যে, ‘ডিউক’ থেকে বেরিয়ে সোজা ল্যাম্পপোস্ট বেয়ে ওঠার চেষ্টা করেন! বোঝো কাণ্ড!
মদের গল্পের বদগুণ হল, গল্পে-গল্পে গল্পের শুঁড়ি-পথ তৈরি হয়। বিভিন্ন বাঁকে তার বিবিধ গল্প দাঁড়িয়ে থাকে। শক্তির পিছু পিছু বিমলবাবু এলেন। মতিবাবু চেয়ার টেনে বসলেন। গৌতম চট্টোপাধ্যায় গুনগুন করতে শুরু করলেন। মনসুর আলি খান পটৌডি দরজা ঠেলে ‘ডিউক’-এর ওপরতলায় চলে গেলেন! তৃপ্তি চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন যে, মহীনের ঘোড়াগুলির প্রথম ‘আস্তাবল’ এটা– ডিউক! এখানেই তাদের গান ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। এবং শেষে ডানা মেলে পক্ষীরাজ হয়ে সুরের আকাশে উড়ে গিয়েছিল। পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘স্ত্রীর পত্র’-র স্ক্রিপ্টও ‘ডিউকে’ বসে লেখা। বিমল করের ‘উড়ো খই’-ও তাই।
এখানে একটা বিষয় না লিখলেই নয়। এড়িয়ে গেলে সত্যের ঘোর অপলাপ হবে। চাঁদনি চক চত্বরে ‘ডিউক’ কিংবা ‘চাংওয়া’-য় যে সাহিত্যিকদের ভিড়-ভাট্টা লেগে থাকত, তার একটা মুখ্য কারণ শ্রীযুক্ত অভীক সরকার ও তাঁর স্বর্ণযুগের আনন্দবাজার পত্রিকা। ‘আনন্দবাজার’-এ কাজ করার সময় শুনেছি, এই সাহিত্যিক-সমষ্টিকে নাকি বলা হত অভীকবাবুর নবরত্ন সভা! পুরনো দিনের সিনিয়ররাই বলতেন। এবং ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের পার্শ্ববর্তী ‘বার’ বাবাজীবনদের বাড়-বাড়ন্তই বলুন বা ব্যবসায়িক বাড়াবাড়ি, সিংহভাগ এঁদের কারণে। শক্তি-সুনীল-বিমলের মতো প্রাতঃস্মরণীয়দের অবাধ বিচরণে। শুনলাম, মতিবাবু সন্ধেয় ঢুকে রাত্তিরে বেরোতেন। হুইস্কি বা ভদকা, যে কোনও এক কুহকে বন্দি হয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও দিব্যেন্দু পালিত, সময়ের খুলি গুলিতে উড়িয়ে! সন্তোষকুমার ঘোষের রিপোর্টিংয়ের ‘অকুস্থল’ ছিল ডিউক। ইন্দিরা গান্ধীর প্রয়াণের দিন ‘আনন্দবাজার’-এর প্রথম পাতার শিরোনাম নাকি তিনি করেন এখানে বসে, চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউয়ের ছিমছাম ‘বার’-এ! টাইগার পটৌডি আবার ‘স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড’-এর দায়িত্বে থাকার সময় মাঝেসাঝে চলে আসতেন লাঞ্চ করতে। কখনও একা, কখনও খুদে সইফকে সঙ্গে নিয়ে। ফিশ অ্যান্ড চিপস খেতে পছন্দ করতেন নবাব। সঙ্গে কফি। সুতরাং, কলকাতার মদ্যপানের ইতিহাসে অভীকবাবুকে অস্বীকার করা অত্যন্ত অন্যায় হবে। ‘আনন্দবাজার’-এ কর্মরত কবি-সাহিত্যিকরা যদি তাঁর পরোক্ষ প্রশ্রয় না পেতেন, তা হলে এ শহরের বার-চরিতের একটা বড় অংশ বর্ণহীন থেকে যেত।
খেয়ালই করিনি কথায়-কথায় কখন বেলা গড়িয়েছে, সিঁড়ির তলা দখল হয়ে গিয়েছে। দেখলাম, মেটে রংয়ের পাঞ্জাবি, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ আর একখানা বিয়ার নিয়ে বসেছেন এক প্রৌঢ়। নির্নিমেষ চেয়ে আছি দেখে ম্যানেজার সায়েব সকৌতুকে চোখ নাচিয়ে বললেন, “ভদ্রলোকের বয়সটা জানেন? ৮৬! ’৭৮ সাল থেকে আসছেন। আমাদের এরকম অতিথিই বেশি। কেউ বিগত ৪০ বছর, কেউ ৩০ বছর ধরে আসছেন!” শোনার পর, মুখ হাঁ হয়ে গেল। আর বন্ধ হল না। এগোলাম। যাই, ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করি, কীসের আকর্ষণ এত? কেন এ পাগলামি?
‘নমস্কার, আমি রাজর্ষি। সংবাদ প্রতিদিন থেকে আসছি।’
‘হ্যাঁ, বলো বাবা।’
‘শুনলাম, সাতচল্লিশ বছর ধরে আসছেন এখানে।’
‘ইয়েস, প্রতিদিন আসি। দুপুরে।’
‘কেন আসেন? শুধু ডিউক-ই বা কেন?’
‘পরিবেশটা ভালো। দাম সাধ্যের মধ্যে।’
‘ব্যস? স্রেফ পরিবেশ আর মদ সস্তা বলে গত ৪৭ বছর ধরে এখানে নিত্য আসছেন?’
উত্তরে এবার স্মিত হাসেন ভদ্রলোক। উত্তর দেন না।
…………………………………………
তৃপ্তিবাবুর ‘ডিউক’-এ যে সর্বাগ্রে অতিথির কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করা হয়! কাস্টমার না লিখে অতিথি লিখলাম। কারণ, সময়-অসময়ে আর কোনও পানশালার মালিক পুরনো খরিদ্দারদের বিনামূল্যে ফ্রুট স্যালাড খাওয়ান না! খোঁজ নেন না, ট্যাক্সি ভাড়া সঙ্গে আছে কি না? তৃপ্তিবাবুর ছেলে শুভদীপকে শুধোলাম একবার যে, বাড়ালেন না কেন ব্যবসা? নির্মোহ হেসে ভদ্রলোক বললেন, “বাবা বিশ্বাস করেন, জীবনে অতিরিক্ত অর্থের সঙ্গে আসে অনাচার। তাই যেটুকু না হলে নয়, বাবা সেটুকুতেই সন্তুষ্ট। আমরাও সেই দর্শনে বিশ্বাসী। দুটো বাড়তি পয়সার চেয়ে দু’জন গুণী ব্যক্তির সান্নিধ্য আমাদের কাছে অনেক বেশি শ্রেয়।”
…………………………………………
না দিলেও বুঝি, আসলে টান। অমোঘ টান। যা নিশিডাকের মতো তাঁকে নিত্য হাত ধরে ‘ডিউক’ নিয়ে আসে, বসিয়ে দেয় কাঙ্ক্ষিত চেয়ারে। যে টান, এক সময় ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে আসত। যে টান ‘ডিউক’-এর উপরতলায় সাহিত্য সভা বসাত! পুরনো ‘ডিউক’-এর নিচে পূর্বে একখানি সোফা ছিল। ঋত্বিক নাকি সকাল থেকে এসে সে স্থান দখল করে, পা তুলে বসে, নিবিড় চিত্তে বিড়ি টানতেন! কেউ কিস্যু বলত না। বিমল করের লেখায়, কবি তুষার রায়ের সিগারেট খেতে-খেতে এখানে ঘুমিয়ে পড়ার দস্তাবেজও পাওয়া যায়। বন্ধুরা যাঁকে ঠাট্টা করে ডাকত, ‘ব্যান্ডমাস্টার’, তাঁরই বিখ্যাত কবিতার নামের অনুকরণে। তবে দুটো গল্প চমকপ্রদ। অত্যাশ্চর্য। সাহিত্যসভা একটা। যার প্রথম অনুচ্ছেদ আগে লিখলাম। আজ যেখানে সন্ধে থেকে সুরা-সংগীতের (অধিকাংশ শ্যামাসংগীত-রবীন্দ্রসংগীত কিংবা পুরনো হিন্দি গান। হালফিলের চ্যাংড়া হিন্দি গানের নামে লারেলাপ্পার প্রবেশ এখনও এ স্থানে নিষেধ) আসর বসে, ‘ডিউক’-এর সেই দোতলা কবি-সাহিত্যিকরা ইচ্ছে মতো নিয়ে নিতেন! মালিক তৃপ্তিবাবুকে একবার বলে দিলেই চলত। দ্বিতীয় গল্পটা আরও মারাত্মক।
গোটা কলকাতায় নরেন্দ্রনাথ মিত্র-র একমাত্র শোকসভা হয়েছে ‘ডিউক’-এ! তার দোতলায়! ভাবতে পারেন, পানশালায় কি না শোকসভা বসছে! এ জিনিস কখনও সম্ভব? নিমতলা শ্মশানে বিয়েবাড়ির ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে, আজ পর্যন্ত শুনেছেন কখনও?
বিমল কর তাই ‘শও প্রতিশত’ খাঁটি কথা লিখেছেন। তৃপ্তিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের দ্বারা মদের ব্যবসা হয়নি। হওয়ার কথাও ছিল না। তৃপ্তিবাবুর ‘ডিউক’-এ যে সর্বাগ্রে অতিথির কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করা হয়! কাস্টমার না লিখে অতিথি লিখলাম। কারণ, সময়-অসময়ে আর কোনও পানশালার মালিক পুরনো খরিদ্দারদের বিনামূল্যে ফ্রুট স্যালাড খাওয়ান না! খোঁজ নেন না, ট্যাক্সি ভাড়া সঙ্গে আছে কি না? তৃপ্তিবাবুর ছেলে শুভদীপকে শুধোলাম একবার যে, বাড়ালেন না কেন ব্যবসা? নির্মোহ হেসে ভদ্রলোক বললেন, “বাবা বিশ্বাস করেন, জীবনে অতিরিক্ত অর্থের সঙ্গে আসে অনাচার। তাই যেটুকু না হলে নয়, বাবা সেটুকুতেই সন্তুষ্ট। আমরাও সেই দর্শনে বিশ্বাসী। দুটো বাড়তি পয়সার চেয়ে দু’জন গুণী ব্যক্তির সান্নিধ্য আমাদের কাছে অনেক বেশি শ্রেয়।”
………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………….
এরপর কোনও আর কথা থাকে? থাকে কোনও জিজ্ঞাসা? ঠিকই আছে। শহরের সমস্ত বার-বাবুকে মুনাফা খুঁজতে হবে কেন? কে দিব্যি দিয়েছে? তার চেয়ে থাকুক না দু’-একটা এমন, পানশালার বদলে অতিথিশালা। যেখানে প্রিয় খরিদ্দারদের মহাসমারোহে সংবর্ধনা দেওয়া চলে। চলে সেই খরিদ্দারদের পাল্টা চাঁদা তুলে ‘বার’ মালিককের রাজ-আড়ম্বরে জন্মদিন পালন!
থাকুক, ‘ডিউক’ এমনই থাকুক। পয়সাকড়ির পিছনে ছুটে তার ‘ডিউক অফ চাঁদনি চক’ হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। সে বরং দুধে-ভাতে থাকুক বিনামূল্যের শ্রমজীবী চানাচুরে। দীর্ঘজীবী হোক মদের সঙ্গে আদা কুচির ভালোবাসায়!
চিত্রগ্রাহক: কৌশিক দত্ত