১০ জন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হন এই বাটা ভাইবোনরা। কিন্তু দমে না গিয়ে চামড়ার বেশি দাম বলে তাঁরা অল্প চামড়া মিশিয়ে ক্যানভাসের জুতো বানাতে শুরু করলেন। নাম হল ‘BATOVKA’ এবং সে জুতোর জনপ্রিয়তার জোরে কর্মীসংখ্যা ১০ থেকে ৫০-এ গিয়ে পৌঁছল। এরই মধ্যে স্বয়ংক্রিয় মেশিন উদ্ভাবনের ফলে বাটা কোম্পানির উৎপাদন এতই বেড়ে গেল যে, ১৫০০ কর্মীসংখ্যা নিয়ে ইউরোপের সবথেকে বৃহৎ জুতো প্রস্তুতকারী সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হল।
ছয়, সাতের দশকে বাংলার বিজ্ঞাপন জগতে এমন ব্র্যান্ড প্রমোশন হেডলাইন বোধহয় আর দুটো হয়নি। সকালের খবরের কাগজে মাত্র চারটি শব্দের একপাতা জোড়া জুতোর বিজ্ঞাপন বাঙালির প্রাণের উৎসবের কেনাকাটা ত্বরান্বিত করত আর আসন্ন উৎসবের উচ্ছ্বাসকে প্রাণিত করে তুলত। ভূ-ভারতে এমন সহজ সরল, বিজ্ঞাপিত প্রতিটি জুতোর সমূল্য আত্মপ্রতিকৃতি প্রদর্শন বাটা কোম্পানি ছাড়া আর কেউ করত বলে আমার জানা নেই।
এটাই ছিল বাটা কোম্পানির জুতোর বিজ্ঞাপনের ম্যাজিক। বাটা-ই প্রথম এদেশের সাধারণ মানুষকে জুতো পরতে শেখাল। ওই সময়ের এক নজর কাড়া বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, টিটেনাস থেকে রক্ষা পেতে চাই বাটার জুতো।
১৮৯৪ সালে চেকোস্লোভাকিয়ার ঝিন নামে ছোট্ট একটি গ্রামীণ শহরে টমাস বাটা তাঁর ভাই বোনদের সঙ্গে নিয়ে এই পারিবারিক কোম্পানি শুরু করলেন। তাঁরা বংশানুক্রমে ছিলেন চর্মকার বা মুচি। জুতো তৈরিতে অতি দক্ষ ছিলেন আর দক্ষ ছিলেন স্বপ্নের জাল বুনতে।
১০ জন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হন এই বাটা ভাইবোনরা। কিন্তু দমে না গিয়ে চামড়ার বেশি দাম বলে তাঁরা অল্প চামড়া মিশিয়ে ক্যানভাসের জুতো বানাতে শুরু করলেন। নাম হল ‘BATOVKA’ এবং সে জুতোর জনপ্রিয়তার জোরে কর্মীসংখ্যা ১০ থেকে ৫০-এ গিয়ে পৌঁছল। এরই মধ্যে স্বয়ংক্রিয় মেশিন উদ্ভাবনের ফলে বাটা কোম্পানির উৎপাদন এতই বেড়ে গেল যে, ১৫০০ কর্মীসংখ্যা নিয়ে ইউরোপের সবথেকে বৃহৎ জুতো প্রস্তুতকারী সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হল।
১৯১৪ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু। চার বছর ধরে সামরিক বাহিনীর অর্ডার সাপ্লাই করতে করতে কোম্পানির ব্যবসা খুবই বেড়ে গেল। ফলে কর্মীসংখ্যা যা ছিল, তার দশগুণ বৃদ্ধি হল। সাধারণের কাছে বাটার নতুন নতুন স্টাইল, পকেট ফ্রেন্ডলি উৎকৃষ্ট জুতোর চাহিদার বৃদ্ধির জন্য ইউরোপের নানা প্রান্তে বাটার শো রুম প্রতিষ্ঠিত হল। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির আঁচ বিশ্ব অর্থনীতিতে ঘা মারল তো বটেই, চেকোস্লোভাকিয়ার মতো ছোট্ট দেশে তার প্রভাব অনেক গুণ বেশি ক্ষতিকর হল। বহু কলকারখানা বন্ধের ফলে প্রচুর মানুষ কাজ হারাল।
এই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য বাটা কোম্পানি সেই সময়ের প্রেক্ষিতে একটি অত্যন্ত আধুনিক ও বাজার ধরে রাখার সুচিন্তিত ব্যবস্থা গ্রহণ করল। তার বিশাল সংখ্যক কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্ত জুতোর নির্ধারিত মূল্য অর্ধেক করে দিল। কর্মীদের বেতন ৪০ শতাংশ কমিয়ে দিল। কিন্তু কর্মীদের খাদ্যদ্রব্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বাজার দরের অর্ধেক মূল্যে সরবরাহ করতে লাগল।
যুদ্ধে আর্থিক অনটনের প্রেক্ষিতে জুতোর মূল্য হ্রাসের ফলে বাটার জুতোর বিপুল চাহিদা সামলাতে ফ্যাক্টরির সম্প্রসারণ ও প্রচুর কর্মী নিয়োগের জন্য ঝিন শহরে বহু হেক্টর জমিতে ফ্যাক্টরি সম্প্রসারণ তো হলই, তার সঙ্গে শিল্প জগতে এক চমৎকার দৃষ্টান্ত রাখলেন টমাস বাটা। ওই ফ্যাক্টরির সংলগ্ন আরও কয়েক হেক্টর জমিতে সমস্ত কর্মীর বসবাস ও সুস্থ জীবনযাপনের সুব্যবস্থা করে তৈরি হল বাটা ভিলা।
এখানেই শেষ নয়। টমাস বাটা বোধ হয় বিশ্বে প্রথম শ্রমিক কর্মীদের জন্য প্রফিট শেয়ারিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন, যাতে সমস্ত কর্মী কোম্পানির আর্থিক সাফল্যের ভাগিদার হতে পারেন।
একেই বলে সার্থক শিল্পপতির দূরদৃষ্টি। টমাস বাটা বিশ্বাস করতেন যে কোনও বিশাল শিল্প প্রতিষ্ঠানের সার্থকতা তার ক্রেতাদের ও কর্মীদের একসূত্রে গাঁথা। কোম্পানির এই দূরদৃষ্টি, উৎকৃষ্ট প্রোডাক্ট ও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার উপযুক্ত মূল্যমান বাটা কোম্পানিকে ‘Shoemaker to the world’ ভূষণে ভূষিত করল।
বিশ্ব জুড়ে বাটা কোম্পানির বাণিজ্য প্রসারের এই মহাযজ্ঞে ভারতের একটি বিশেষ ভূমিকা লক্ষ করা গেল। অবশ্যই সারা দেশে জুতোর বাজারের এক বিশাল সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে কোম্পানি এদেশের প্রথম ফ্যাক্টরি, যা এশিয়ার সর্ববৃহৎ জুতোর ফ্যাক্টরি ও টাউনশিপ স্থাপন করলেন ১৯৩৬ সালে কলকাতার-ই অদূরে গঙ্গার ধারে,পরবর্তীকালে যার নাম হল বাটানগর।
ব্র্যান্ডিংয়ের ইতিহাসে ‘বাটা’ একটা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য নাম। সুদূর চেকোস্লোভাকিয়ার ছোট্ট ঝিন শহরের মুচি পরিবারের তিন ভাইবোন কী করে বিশ্ব জুড়ে জুতোর বিপুল সাম্রাজ্য গড়ে তুললেন এবং জুতোর ব্র্যান্ডিংয়ের ইতিহাস হয়ে অর্ধ শতাব্দীর দিকে আগুয়ান, তার কিছুটা গপ্প বলার চেষ্টা করলাম। বাটা কোম্পানির এই সময়ের অবস্থানের কথা বলে দাঁড়ি টানলাম।
বছরে ১৩০ মিলিয়ন জুতোর বিক্রি।
বিশ্বজুড়ে ৩২০০০ কর্মী।
২১টা আধুনিক ফ্যাক্টরি।
৭০+ দেশে ব্যবসা।
৫৩০০ রিটেল শো রুম।
১২৯ বছর ধরে সাধারণ মানুষের
ক্রয়ক্ষমতার উপযুক্ত উন্নত মানের ও আধুনিক ডিজাইনের জুতোর বিপণন।
বছরে ৩ লক্ষ শিশুদের সুস্থ জীবন দেওয়ার প্রয়াস।