রবীন্দ্রনাথ কি স্ত্রীর সঙ্গে সর্বদা সংস্কৃতায়িত শুদ্ধ-সাধু ভাষায় কথা বলতেন! কথার বিষয়-আশয় কি সর্বদা গভীর ও গুরুগম্ভীর? তাঁদের কথোপকথনের নমুনা তো রেকর্ড করা নেই, তবে স্ত্রীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রগুলি কথোপকথনের ভাষা ও ভাবের একরকম অকাট্য প্রমাণ। রবীন্দ্রনাথ নিজে বিশ্বাস করতেন মানুষের দুই আমির অস্তিত্বে– একটিকে বলতেন ‘ছোট আমি’, অন্যটিকে ডাকতেন ‘বড় আমি’ বলে। ছোট আমি হাট-বাজার করে, বড় আমি সৃষ্টি করে।
স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে কী ভাষায় কথা বলতেন রবীন্দ্রনাথ? কী-ই বা ছিল তাঁদের কথাবার্তার বিষয়? এ সম্বন্ধে বাঙালির কৌতূহল স্বাভাবিক, তবে মৃণালিনী-রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বাঙালি ততটা মনোযোগী নয়। হতে পারে কাদম্বরী, রাণু, ওকাম্পো– এইসব সম্পর্কের খবরকে বঙ্গজ লেখকরা ইচ্ছেমতো মুখরোচক করে তুলেছেন বলে মৃণালিনীকে বঙ্গভাষীরা তেমন করে জানতে চায়নি।
রবীন্দ্রনাথ কি স্ত্রীর সঙ্গে সর্বদা সংস্কৃতায়িত শুদ্ধ-সাধু ভাষায় কথা বলতেন! কথার বিষয়-আশয় কি সর্বদা গভীর ও গুরুগম্ভীর? তাঁদের কথোপকথনের নমুনা তো রেকর্ড করা নেই, তবে স্ত্রীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রগুলি কথোপকথনের ভাষা ও ভাবের একরকম অকাট্য প্রমাণ। রবীন্দ্রনাথ নিজে বিশ্বাস করতেন মানুষের দুই আমির অস্তিত্বে– একটিকে বলতেন ‘ছোট আমি’, অন্যটিকে ডাকতেন ‘বড় আমি’ বলে। ছোট আমি হাট-বাজার করে, বড় আমি সৃষ্টি করে। লিখেছিলেন, বাঁশ দিয়ে লাঠি হয়, বাঁশিও। লাঠি লাগে নিত্যদিনের প্রয়োজনে আর বাঁশি তোলে তান। সেই বাঁশির তানে বাস্তবকে মনে হয় দুর্বিষহ প্রলাপের মতো। মন নিত্যদিনের সংসার থেকে তখন যাত্রা করে সুরের অমরাবতীতে। মৃণালিনীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ দুই আমির জগৎই যাপন করেছিলেন। তাঁদের জীবনযাত্রায় বড় আমি যেমন ছিল, তেমন ছিল ছোট আমির জগৎ। মৃণালিনীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র সেই সাক্ষ্য বহন করছে।
আরও পড়ুন: বাঙালি লেখকের পাল্লায় পড়ে রবীন্দ্রনাথ ভগবান কিংবা ভূত হচ্ছেন, রক্তমাংসের হয়ে উঠছেন না
স্ত্রীকে লেখা চিঠির ভাষা বহু জায়গাতেই নিতান্তই কেজো, মুখের ভাষার সহজ চালে ভরা। একটা-দুটো নমুনা পাঠকদের জন্য। ১৮৯০। জানুয়ারি মাস। সাহাজাদপুর থেকে লিখছেন, ‘যেম্নি গাল দিয়েছি অমনি চিঠির উত্তর এসে উপস্থিত। ভালমান্ষির কাল নয়। কাকুতি মিনতি করলেই অম্নি নিজমূর্ত্তি ধারণ করেন আর দুটো গালমন্দ দিলেই একেবারে জল।’ মৃণালিনী সহজে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লেখেন না, কবি কবিপত্নীর চিঠির অপেক্ষায় থাকেন। রাগ-অভিমান তীব্রভাবে প্রকাশ করলে তবে চিঠি আসে। সে-কথাই এখানে। লেখার ভাষাটি খাঁটি চলিত। ছদ্ম তিরস্কারের ভঙ্গিতে এরপর লিখেছেন, ‘ছি, ছি, ছেলেটাকে পর্য্যন্ত বাঙ্গাল করে তুল্লে গা!’ মৃণালিনীর কাছ থেকে চিঠি না-পাওয়ার অভিযোগ অন্যত্রও আছে। ‘তুমি আমাকে দুছত্র চিঠি লিখ্তে কিছুমাত্র কেয়ার কর না।’ এ-তো ছোট আমির ভাষা কৌতুক। যখন রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনীকে নর-নারীর দাম্পত্য সম্পর্কের গভীর কথা লেখেন তখন ভাষার অন্যরূপ। ‘স্ত্রীপুরুষের অল্প বয়সের প্রণয়মোহে একটা উচ্ছ্বসিত মত্ততা আছে… বেশি বয়সেই বিচিত্র বৃহৎ সংসারের তরঙ্গদোলার মধ্যেই স্ত্রীপুরুষের যথার্থ স্থায়ী গভীর সংযত নিঃশব্দ প্রীতির লীলা আরম্ভ হয়…।’ (শিলাইদহ। জুন ১৮৯৮) এ ভাষা যেন ‘গোরা’ উপন্যাসের পরেশবাবুর ভাষা– সুচরিতাকে এভাবেই মাঝে মাঝে পিতৃপ্রতিম পরেশবাবু সংসার-সম্বন্ধে, জীবন-বিষয়ে সচেতন করে তুলতেন।
আরও পড়ুন: চানঘরে রবীন্দ্রসংগীত গাইলেও আপত্তি ছিল না রবীন্দ্রনাথের
রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে সাংসারিক নানা ছোটখাটো কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখও চোখে পড়ে। কলকাতার বাড়িতে নতুন রান্নার লোক নিয়োগ করা হবে। নাম তার গিরিশঠাকুর। নিয়োগের ক্ষেত্রে স্ত্রীর মতামত নেওয়া জরুরি। লিখেছেন, ‘সে ইংরাজি বাংলা সব রকম বেশ ভাল রাঁধতে পারে– কিছু বেশি মাইনে নেবে কিন্তু কেউ এলে খাওয়াবার কোন ভাবনা থাক্বে না। তুমি কি বল?’ সে-সময় বাঙালি রান্নার পাশাপাশি সাহেবি রান্না জানা আবশ্যিক, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথদের মতো সাহেব অতিথি লেগে থাকা জমিদার-পরিবারে। মৃণালিনীর রবীন্দ্রনাথকে লেখা যে দু’টি চিঠি পাওয়া যাচ্ছে তার একটিতে ছিল রান্নার লোকের সমস্যার কথা। শিলাইদহ, মৃণালিনীর মুখের ভাষায় যা ‘শিলাইদা’ সেখান থেকে স্বামীকে লিখেছেন, ‘বাবুর্চি না পাঠালে আর চলে না।’ এই বাবুর্চিকে সাহেবি রান্না জানতেই হবে। সব সময় রবীন্দ্রনাথ আর মৃণালিনীর একসঙ্গে শিলাইদহে থাকা হয় না। একজন শিলাইদহে, অন্যজন হয়তো কলকাতায়। চিঠিতে খবরাখবরের চলাচল। শিলাইদহ থেকে রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীকে কিচেন-গার্ডেনের খবর দিচ্ছেন। ‘তোমার শাকের ক্ষেত ভরে গেছে। কিন্তু ডাঁটা গাছগুলো বড্ড বেশি ঘন ঘন হওয়াতে বাড়তে পারচে না।’ মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে কী পরে গেছেন সে-কথা মৃণালিনীকে জানাতে ভোলেননি। ‘তোমার মেয়েকে জিজ্ঞাসা কোরো জামাইবাড়ি এসে আমি কি রকম সাজসজ্জায় মনোযোগ করেছি। ঢাকাই ধুতি আর চাদর ছাড়া কথা নেই।’ কখনও আবার চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর শাশুড়ির খবরাখবর জানাচ্ছেন, ‘তোমার মার বাতের মতো হয়ে কষ্ট পাচ্চেন। শিলাইদহে ভাল ছিলেন কুষ্ঠিয়ায় এসে তাঁকে বাতে ধরেছে। ’ শাশুড়ির চাপে পড়ে খেতে হয়েছে, কিন্তু খেতে ভাল লাগেনি সে খবরও চিঠিতে আছে। ‘তোমার মা কোনোমতেই ছাড়লেন না– অনেকদিন পরে পীড়াপীড়ি করে মাছের ঝোল খাইয়ে দিলেন। মুখে কিন্তু তার স্বাদ আদবে ভাল লাগল্ না।’ শাশুড়িকে ‘তোমার মা’ লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ।
আরও পড়ুন: ‘পলিটিকাল কারেক্টনেস’ বনাম ‘রবীন্দ্র-কৌতুক’
আসছে ছেলে-মেয়েদের কথা। বিশেষ সংকটের কথা থেকে উত্তীর্ণ হচ্ছেন পিতা-মাতার আদর্শ অনুভবের কথায়। লিখছেন, ‘ছেলেমেয়েদের সম্বন্ধে নিজের সুখ দুঃখ একেবারেই বিস্মৃত হওয়া উচিত। তারা আমাদের সুখের জন্য হয়নি। তাদের মঙ্গল ও তাদের জীবনের সার্থকতাই আমাদের একমাত্র সুখ।’
এইসব চিঠিপত্র পড়তে পড়তে মনে হয়, বড় বিষয়ের পাশাপাশি দাম্পত্যের নিতান্ত ছোটখাটো দরকারি ভাবনা-যাপনে কার্পণ্য করেননি রবীন্দ্রনাথ। মৃণালিনী রবীন্দ্রনাথের ছোট আমি আর বড়ো আমি– দু’টিকেই পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রপত্নী মৃণালিনী দীর্ঘজীবনের অধিকারী ছিলেন না। তাঁর প্রয়াণের পর যেভাবে ‘স্মরণ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাতে বোঝা যায় কতটা মন পেয়েছিলেন তিনি। একথা সত্য রবীন্দ্রজীবনে নানা সময়ে নানা ভাবানুষঙ্গে নানা নারীর প্রবেশ ঘটেছে। তাঁদের সঙ্গে ভাবময় জীবন যাপন করেছেন তিনি– কিন্তু যেভাবে দুই আমির লীলায় রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছিলেন মৃণালিনী, সেভাবে আর কেউ কি পেয়েছিলেন! রবীন্দ্র-মৃণালিনীর দাম্পত্যজীবনের দিকে বাঙালির চোখ আর মন যাক আর নাই যাক তাঁদের সংক্ষিপ্ত দাম্পত্যজীবন কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দুই আমির সামঞ্জস্যে বড় মধুর– সে মধুরের শেষ হলেও রেশ যাওয়ার নয়। যে বোঝে সে বোঝে।