তার পরের জেনারেশনটাও একই রকম নির্ভয়ে থাকবে। দেশে দাঙ্গা লাগুক, বন্যা-খরায় ছারখার হয়ে যাক, মহামারীতে কোটিখানেক লোক মরে গেলেও দেখা যাবে ওরা বাজার থেকে ঠিক গুনে গুনে চারটে চিংড়ি মাছ কিনে বাড়ি ফিরছে। দুপুরে ঠিক দেড়হাতা ভাত খাচ্ছে। মাইনের অধিকাংশটাই ব্যাঙ্কে জমিয়ে বলছে, ‘ভবিষ্যতের কথা তো ভাবতে হবে, তাই না?– এমন ভাব যেন আপনি ঘাড় নেড়ে ‘হবে না’ বললে জমাবে না। তারপর বরাবরের মতোই স্বাস্থ্য সচেতন এবং অমর হওয়ার দৌড়ে কিপকেতারকে পিছনে ফেলে বহুকাল বেঁচে থাকবে নির্ঝঞ্ঝাট।
১৬.
ভোঁদার একটা জমকালো নাম ছিল– প্রবলজলোচ্ছ্বাসচন্দ্র বা বিগলিতকুসুমকাকলি টাইপের কিছু একটা। একটু কাব্যিক মতো। মানে, শুনলে প্রথমেই বলতে ইচ্ছে করে, ‘আগে অরে থাবড়াইয়া ল, হ্যার পর কতা কবি।’ ওর বাবা-মা, অর্থাৎ আমাদের কাকু-কাকিমা কলকাতার সমস্ত নামকরা লোকেদের চিনতেন তো বটেই, তাঁদের সঙ্গে ফ্রেমে বাঁধানো ছবিও সাজানো দেখেছি বুক শেলফের ওপর– ও বাড়িতে আমাদের মতো বইয়ের তাক-ফাক ছিল না। ‘জর্জদা’, ‘মোহরদি’, ‘মানিকবাবু’ শব্দগুলো জুড়ে কীসব আশ্চর্যজনক গায়ে কাঁটা দেওয়া বাক্য একটানা নিমিলিত নয়নে বোরোলিন না-মাখা ঠোঁট আলতো কাঁপিয়ে বলে যেতেন, সে যারা না দেখেছে, তাদের পক্ষে বিশ্বাস করা অসম্ভব! রেল কলোনির বদলে নালন্দা স্কুলের মাঠ থেকে পয়লা মার্চের প্রভাতফেরি বেরনোর ঐতিহাসিক যৌক্তিকতা বা ওই ধরনেরই কোনও একটা বিষয়ে কাকিমার ‘সে বছর পাঁচই অগ্রহায়ন রথীন্দ্রনাথ পোস্তর বদলে চাপর ঘন্ট খাওয়ায় অবুদা (পরে জেনেছিলাম অবনীন্দ্রনাথ) কুণ্ঠিত হয়ে পড়েন’ বিষয়ক একটা দীর্ঘ আলোচনা মনে পরলে এখনও… কী মনে হয় লিখলে এডিটর মশাই কলম কেড়ে নেবেন। বলাই বাহুল্য, ছোট মফসসলের পরিধি ছাড়িয়ে ওদের খ্যাতি শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, এদিকে রায়গঞ্জ অবধি ছড়ায়। কাকিমা সাদা শাড়ি পরতেন, কাকুকে কখনও পাজামা-পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য কিছুতে দেখিনি। কথা বলতেন ফিসফিসিয়ে এবং রবিবার এগারোটা নাগাদ তেইশ-চব্বিশ মিনিটের মতো কণিকা বা হেমন্তের গলায় রবীন্দ্রসংগীত বাজত। ভোঁদাকে কখনও ওঁরা তুই-তোকারি করছেন শুনিনি। বাঙাল হওয়া সত্ত্বেও রাবীন্দ্রিক বাংলায় কথা কইতেন, এবং আমাদের মতো সাধারণ বাড়িতে সকাল-বিকেল মোগল সাম্রাজ্যের পতন সম্পর্কিত চিৎকার চেঁচামেচি কখনও এক মুহূর্তের তরে থামলেই রান্নাঘর বা বৈঠকখানা থেকে যেমন কেউ না কেউ ‘হারামজাদা শুয়ারটা গেলো কই’ টাইপের আর্তনাদ করে কানে জবা ফুল গুঁজে ছুটে বেড়াত, সেরকমটা ওদের বাড়িতে একরকম অকল্পনীয়ই ছিল বলা যায়। আমরা যেমন জানতাম, খেতে চাইলে কেউ একটা সামনে রুটি-আলুভাজার থালা ঠকাস করে নামিয়ে দিয়ে বলবে ‘ন্যান, গেলেন’– বা চা দিতে হলে ওরকমই সশব্দে বাদামি লিকুইড ছলকানো কাপ-ডিস থুয়ে কোলের ওপর একটা বাজারের ব্যাগ ছুড়ে দিয়ে ‘নাও, খেয়ে উদ্ধার করো’ বলতে হয়, সেসব বহুমাত্রিক নাটকীয়তাও ওদের বাড়িতে বর্জিতই ছিল।
আর ভোঁদাটাও একেবারে ক্রিমিনাল টাইপ। কী বলব মশাই, সকাল দশটা নাগাদ হয়তো কাকিমা জিজ্ঞেস কললে, ‘বাবা প্রস্ফুটিতবজ্রপাত, তোমাকে যে একশোটা অঙ্ক কষতে বলেছিলোম, সেগুলো কী হল?’ অমনি জানোয়ারটা বলবে, ‘না মা, টেস্ট পেপারের তিনশো বাইশটা অঙ্ক করা হলেই ওই একশোটা করব।’ একেবারে ডেডলি মাল! ‘আজ সকালে ফিজিক্স পোড়ো’ বললে উত্তর দিত ‘নিলস বোরের থিয়োরিগুলো ভুল প্রমাণ করেই পড়তে বসব।’ আমরা হাঁ করে চেয়ে থাকতাম। কথা বেরত না মুখ দিয়ে। তপন বলেছিল, ‘শালা নিগ্ঘাত হরমোন সিরাপ খায়।’ কেউ অবিশ্বাস করিনি– আমাদের সময় ওই খেয়ে বা মাখিয়ে শুঁটকি ক্যাটেগরির মেয়েরা নাকি ইসে বড় করত। যা খেলে ইসে বড় হয়, তাই দিয়ে অঙ্কে একশোয় একশো পাওয়া আর এমন কী? কল্যাণ এই উপায়ে এইটের গণ্ডি পেরনোর প্রস্তাব পেশ করলে বাপ ওকে আপাদমস্তক জুতোপেটা করেছিল। সে অন্য প্রসঙ্গ, তবে পরে অবশ্যই বিস্তারিত কথা হবে ওই বিষয়ে। ভোঁদাটা সকালে চুল আঁচড়ে স্কুলে এল, বিকেলে ফেরার সময়ও একই রকম পাটপাট চেহারা ছবি। জুতোয় ধুলো নেই, খাতায় লাল দাগ নেই, জানলা দিয়ে মুখ বার করে থানার বড়বাবু কল্লোল বিশ্বাসকে ‘কালু আঃ আঃ আঃ’ বলে খেপানো নেই, যাদবজির বেকারি থেকে বিস্কুট চুরি বাদই দিলাম, বানোয়ারির দোকানে সাজানো পানু ঝেড়ে রেললাইন ধরে খেঁচে দৌড় লাগানোর অপরাধেও কোনও দিন কেউ ওকে অ্যাকিউজ করতে পারেনি। টিফিন পিরিয়ডে ওর একটা ইক্যুয়ালি ‘সুসইব্য’ গোছের ভাইয়ের সঙ্গে বারান্দার এ-মাথা থেকে সে-মাথা হেঁটে সামান্য পেঁজা তুলোর মতো মেঘের সরুচাকলি আর বসন্তের বাতাসা টাইপের কীসব খেয়ে, শিশিরের জল পানান্তে আবার ফার্স্ট হওয়ার পড়াশুনায় ডুবে যেত। নাইনে হালকা দাঁড়ি গজিয়েছিল, নাহলে কে বলবে মানুষ!
ওর বাপ মায়ের নাকি খুব শান্তি। বরাবর তাই শুনেছি। ছেলের উচ্চশিক্ষা, বড় চাকরি– যা কিনা পার্মানেন্ট, উইথ গ্র্যাচুইটি, উপরি, পিপিএফ, পেনশন বেনিফিটস অ্যান্ড হোয়াটএভার এলস ফিটস– ঠিকঠাক পরিবার থেকে বাছাই করা সুন্দরী বউ, এবং যথাসময়ে প্ল্যানড বাচ্চা নিয়ে নাকি ওদের কোনও চিন্তা কখনওই ছিল না। তাদের বাচ্চাদের নিয়েও থাকবে না। তার পরের জেনারেশনটাও একই রকম নির্ভয়ে থাকবে। দেশে দাঙ্গা লাগুক, বন্যা-খরায় ছারখার হয়ে যাক, মহামারীতে কোটিখানেক লোক মরে গেলেও দেখা যাবে ওরা বাজার থেকে ঠিক গুনে গুনে চারটে চিংড়ি মাছ কিনে বাড়ি ফিরছে। দুপুরে ঠিক দেড়হাতা ভাত খাচ্ছে। মাইনের অধিকাংশটাই ব্যাঙ্কে জমিয়ে বলছে, ‘ভবিষ্যতের কথা তো ভাবতে হবে, তাই না?– এমন ভাব যেন আপনি ঘাড় নেড়ে ‘হবে না’ বললে জমাবে না। তারপর বরাবরের মতোই স্বাস্থ্য সচেতন এবং অমর হওয়ার দৌড়ে কিপকেতারকে পিছনে ফেলে বহুকাল বেঁচে থাকবে নির্ঝঞ্ঝাট।
এমনটাই হয়তো হওয়া উচিত। যারা রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসীন, তাদের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল, পরবর্তী প্রজন্মও সে পথেই হাঁটবে। মুসলমান এবং দলিতদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে না, কারণ কখনও দাঙ্গা বাঁধলে তারা এসে আবার আশ্রয় চাইতে পারে– গোবর জলে ঘর ধোয়া-পাখলা বিষয়টা খুব মেসি, আর কিছু নয়, নয়তো ওদের এক পিসেমশাইও বিফ কাবাব খেয়েছিল না জেনে। খুবই প্রগ্রেসিভ সবাই, শুধু বাবা এখনও বেঁচে, তাই ছেলের পৈতে…। নাহলে সিয়াটেল আর টেক্সাসে বছরে দু’বার হবন করালেই সব দোষ কেটে যায়। পুরোহিত নিজে এসে পয়সা নিয়ে ডিজিটাল স্ক্রিনে যজ্ঞের পুরো ভিডেও দেখিয়ে দেয়। নো প্রবলেম। খুব শান্তি। শান্তির জলও পাওয়া যাচ্ছে– ডাইরেক্ট ফ্রম দি গ্যাঞ্জেস। ‘দূর্গা পুজাসে’ ছেটানো হয়– পে এক্সট্রা, গেট এক্সট্রা। কী যে শান্তি! তারপর সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম। খুব শান্তি। দেশে মুসলমানরা সবাই টেররিস্ট। ইস্টকোস্টে ব্ল্যাকরা সবাই টেররিস্ট। ইউরোপে অ্যাফ্রিকান ইমিগ্রান্টরা টেররিস্ট। সাউথ অ্যাফ্রিকায় স্টিভেন বিকো টেররিস্ট। নিও নাৎসি, মনু মানেসর টাইপের ক্রিমিনাল আর কু ক্লুক্স ক্ল্যানের রেপিস্টরা ছাড়া সবাই টেররিস্ট। তাছাড়া মেহুল চোকসি, নীরব মোদি আর কিংফিশার মালিয়া বাদে সবাই চোর। একেই বলে ‘গোরাক শাক’ দিয়ে মাছ ঢাকা। ভয় নেই, লজ্জা ,ঘৃণা, ভয় ত্যাগ করে একবার এটা মেনে নিতে পারলে খুব শান্তি।
তারপর কী? মুসোলিনির পরিণতি মনে আছে? উল্টো করে রাস্তার ধারে ওকে আর ওর পোয়া রক্ষিতাকে ঝুলিয়ে দেওয়ার আগে সাধারণ মানুষ ওদের মৃতদেহগুলোতে থুতু দিয়ে লাথি মেরে রাগ মিটিয়েছিল– মনে কি পড়ে না? মনে না পড়লে নেট খুলে সে ছবি দেখে নিন। তারপর আবার শান্তিতে বেহায়াপনা শুরু করবেন।