এখন বেড়াতে গিয়ে ভোরবেলায় বেরিয়ে পড়ার ঝোঁক আর নেই, কারণ কম্পিমেন্টারির আঠা! সেখানে বিচিত্র সব খাবারদাবার। তার বিচিত্র স্বাদ। কিন্তু ‘শ্রেষ্ঠ ব্রেকফাস্ট’ কে না জানে, বাঙালিরা নির্ঘাত জানে– তা হল লুচি আর সাদা আলুর তরকারি! শেষপাতে যদি পান্তুয়া থাকে তবে তো কথাই নেই। তবু মাঝে সাঝে লোকাল খাবারের চক্করে ভ্রমণপিপাসুরা কম্পিমেন্টারির লোভ সামলে নেয়। খুঁজে পায় ভ্রমণের স্বাদ।
প্রচ্ছদ শান্তনু দে
১১.
আজকাল অনেক হোটেলেই ‘কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট’ থাকে। ‘ব্রেকফাস্ট’, মানে প্রাতঃরাশ সোজা বাংলায় যাকে সকালের জলখাবার বলি, ওটার জন্য দাম দিতে হয় না। আসলে, দামটা হোটেল চার্জের ভিতরেই ধরা থাকে। ওই ‘কমপ্লিমেন্টরি’ শব্দটা বেশ মোহময় কিংবা আঠাময়। ওটাকে ছাড়া যায় না। কোথাও বেড়াতে গেলাম, হোটেলে উঠলাম, কিছু দেখতে যাব দূরে, সক্কালবেলা বেরিয়ে পড়তে পারলে ভালো, কিন্তু আটকে দেয় কমপ্লিমেন্টারির আঠা। ওটা যখন ফ্রিতে দিচ্ছে, ছাড়ি কেন! এই ‘ফ্রি’র চক্করে আমরা বেতাল হয়ে যাই। দুটো শার্ট কিনলে একটা ফ্রি। মানে দুটোর দামে তিনটে কিনে ফেলি। তিনটে দরকার নেই, তবু যদিও ভালো করেই জানি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ব্যবসাই করছে। দানছত্র করছে না। আমাদের মতো বগাদের ফান্দে ফেলে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মাল গছিয়ে দিয়েছে। জুতো কিনলে মোজা ফ্রি, জুতো কিনলে জুতো পালিশের কৌটো ফ্রি, ভালো হত যদি জুতো পালিশঅলা ফ্রি পাওয়া যেত। এক মাছউলি একটু গন্ধবিধুর মাছ বিক্রি করছিল– পচা মাছ আর কী! ‘পচা’ শব্দটা ওদের বলতে নেই, বলতে হয় একটু নরম হয়ে গেছে। ওই নরম হয়ে যাওয়া মাছের প্রমোশনের জন্য কিছু রসুনও রেখেছিলেন। ‘আরে, এট্টু লবোম হয়েছে তো কী হয়েছে? ভাল করে নংকা-রসুন দে কষিয়ে নিলেই এক থালা ভাত উঠে যাবে। রসুন তো ফিরিতেই দিচ্ছি।’ মানে, পচা মাছ কিনলে রসুন ফ্রি!
কথা হচ্ছিল হোটেলের। চাকরি জীবনের আগে হোটেলে উঠিনি কখনও। ট্যুরের চাকরি করতে গিয়ে যেসব হোটেলে উঠতাম, তা ছিল নিতান্তই ম্যাড়ম্যাড়ে হোটেল। ওসব হোটেলে পেঁয়াজ-লংকা-লেবু ফ্রি থাকত। খাওয়াটাও ‘মিল’ সিস্টেম। যত খুশি ভাত-ডাল-তরকারি পাওয়া যেত। ‘মিল’ প্রথা এখনও মিলিয়ে যায়নি। বিহার রাজ্য ছিল আমার প্রথম কর্মক্ষেত্র। ওখানে আমার সকালের ব্রেকফাস্ট ছিল লিট্টি। লিট্টির সঙ্গে ‘ধনিয়াকা চাটনিয়া’ ছিল ফ্রি।
সপরিবার বেড়াতে যাওয়া ছিল পুরীতে, একবার রাজগীরে। হোল্ড অল-এর ভিতরে বিছানা-বালিশ গামছা, ঝাঁটা, এমনকী, ঘর মোছার ন্যাকড়া গুঁজে নিয়ে বেরিয়ে পড়া। জলের কুঁজো মগও। থাকা হত ধর্মশালা, কিংবা বাড়ি ভাড়া করে। তখন তো তিন দিনের ট্যুর হত না, কমপক্ষে এক সপ্তাহের। হোটেলেও উঠেছি পরবর্তীকালে, কিন্তু ব্রেকফাস্ট ‘কমপ্লিমেন্টারি’ দেখিনি। প্রথম ‘কমপ্লিমেন্টারি’-র অভিজ্ঞতা হয় আমেরিকায়। ২০০২ সাল নাগাদ। একটি সেমিনারে গিয়েছিলাম, হোটেল দিয়েছে; সকালে ডাইনিং হল-এ ব্রেকফাস্ট, যা খুশি খাও, যত খুশি খাও। খাবারদাবার পরিপাটি সাজানো। পাউরুটির স্লাইজ এবং মাখন। টোস্টার কাছেই রয়েছে, সেঁকে নাও, মাখন মাখাও। শুধু কি মাখন? নানাবিধ জ্যাম, কেচাপ, মধু, ক্রিম, লেটুস, ডিমসেদ্ধ রাখা। ওমলেটও ভেজে দিচ্ছে। একজন ডিমের পোচ বানিয়ে দিচ্ছে। আমি পোচে পৌঁছে গেলে কালো মুখের সাহেব বলে ‘হাউখ্যানাই হেল্প হউ?’ আমি বলি, ‘পোচ, পোচ।’
‘ওকেই, ফোচ। ওয়াটার ফোচ অর অয়েল ফোচ, বাটার ফোচ?’ আমি বলি, ‘যা খুশি।’ ও কী বুঝল কে জানে! বলল, ‘ওখেই…। সানি সাইড আপ অর সানি সাইড ডাউন?’ বাপ রে! ফোচের এত ফ্যাচাং! বলি, ‘আপনার যা ভালো মনে হয়।’ ও বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘আপ, আপ।’ ওই যে, ‘আপনার’ শব্দটা কানে গেছে…। ও ডিমের কুসুমটা উপরে রেখে প্লেট এগিয়ে দিল।
আরও কতরকম খাবার, চিনি না। চেনা সম্ভব নয়। কতরকম সালামি, সসেজ, চিজ, গাজর, ব্রকোলি, বিন– এসব সেদ্ধ, কর্নফ্লেক্স, দুধ, ওটস, কতরকমের ফল, ফলের রস… বাপরে বাপ! আমি তো ভ্যাবাচাকা। আমার সঙ্গে একজন ছিল, ও আবার ভেজ। ও ওর পছন্দমতো খাবার নিচ্ছে। আর ভাবছি আমি বেশি কিছু নিলে ভেজ ছেলেটা আমাকে হ্যাংলা ভাববে না তো? আমার কিন্তু লোভের চাইতে কৌতূহল বেশি ছিল। অনেক কিছুই খাওয়া তো দূরের কথা, জীবনে প্রথম দেখছি। ভাবছি পরখ করি। সাদা চিজ তো দেখেছি, কালো চিজ দেখিনি কখনও। একটু নিল ও, ব্বাবা (ওখানে এক্ষেত্রে ‘ও বয়’ বলে) কী বিদ্ঘুটে গন্ধ!
সবশেষে মনে হয়েছিল, আমাদের লুচি আর আলুর সাদা তরকারির মতো উপাদেয় ব্রেকফাস্ট দুনিয়ায় কোথাও নেই, এরপর যদি একটু মিহিদানা বা একটা পান্তুয়া! ওদের লুচি-কচুরির কোনও ধারণা নেই। কী হতভাগ্য ওরা! দক্ষিণ ভারতের হোটেলের কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টে ইডলি ধোসা বড়া উপমা ছাড়া ও পুরি-সবজি থাকে। পাউরুটি-মাখন-ডিম তো দুনিয়ায় সর্বত্র থাকে। একবার একটা কাজে দক্ষিণ ভারতের একটি হোটেলে গিয়েছি। ওখানে সকালে বিনে পয়সায় এইসব খেতে পারতাম। কিন্তু বাইরে চলমান ভ্যানে বিক্রি হচ্ছিল ধোঁয়াওঠা ইডলি, পদ্মপাতায়। এবং বিক্রি করছিল চুলে ফুল জড়ানো দক্ষিণী রমণী। আমিও পদ্মপাতা এবং ফুল জড়ানো চুলের আকর্ষণে কমপ্লিমেন্টারি ত্যাগ করলাম। মহারাষ্ট্রের নাসিকেও এরকম রাস্তার ‘পোহা’র লোভ সামলাতে পারিনি।
২০০৮ সাল নাগাদ কয়েকজনকে জুটিয়ে কম্বোডিয়া-লাওস-ভিয়েতনাম গিয়েছিলাম বেড়াতে। আঙ্কোর ভাটের অঞ্চলটায় আমরা বাসে করে ঘুরেছিলাম এবং ছোটখাটো হোটেলেই থেকেছিলাম। কিন্তু কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট ব্যাপারটা ফ্যাশন হিসেবে ছিল। টেবিলে থাকত নানা ধরনের পোকা ভাজা। ডিম ফোটা সদ্য স্ফুটিত মুরগিও ছিল, নরম লাল রং, তখনও মুরগি শিশু বলা চলে না, গুটিশুটি পা, ভেজে রেখেছে। এসব বাদ দিয়ে যে বাইরে খাব, সেটাও খুব সুবিধের ছিল না। বাইরেও প্রায় এমনই খাবার। পশুদেহের নানা অংশ, মাছ বা অজানা ফল। হোটেলে চালের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি পিঠে পেয়েছিলাম, ভেবেছিলাম টমেটো সস্ দিয়ে খেয়ে নেব। তাই করলাম, কিন্তু খাওয়া গেল না, কারণ টমেটো সসকে আরও স্বাদু করার জন্য সসের মধ্যে শুকনো মাছের গুঁড়ো মেশানো ছিল। কী বিটকেল গন্ধ, বাপরে! এই শুকনো মাছের গুঁড়ো ওই এলাকার মানুষের বড় আদরের ধন। সব কিছুতেই ওই দ্রব্য। যেমন দক্ষিণ ভারতে কারিপাতা, পূর্ববঙ্গে নারকোল, কাশ্মীরে কেশর। ওদিকে নুন বলতে গুঁড়ো নুন নয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। তরল নুন। নুনের ঘন দ্রবণ বলা চলে। ডিম সেদ্ধ, নড়ুল, বা সবজি সেদ্ধর মধ্যে শিশি ঝাঁকিয়ে নুন মেশাতে হয়। ওই তরল লবণেও শুঁটকি মাছের গুঁড়ো। খুব মুশকিল হয়েছিল আমাদের। এটা কম্বোডিয়ার নমপেনের কথা বলছি। শেষ অবধি ওষুধের দোকানে সোডিয়াম ক্লোরাইডের প্যাকেট কিনতে হল। ওদিকের হোটেলগুলোতে যেখানে কমপ্লিমেন্টারির আঠা আছে, ওখান থেকে বেরনো মুশকিল ছিল, তাই বাইরে গিয়ে গাঁটের পয়সা দিয়ে কলা, বিস্কুট– এসব দিয়ে কোনওরকমে ম্যানেজ করা তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব হলেও প্রকৃত বাস্তবে সম্ভব ছিল না। ওখানে ডিমসেদ্ধ, ওমলেট, চালের রুটি– এসব নিয়ে ‘সোডিয়াম ক্লোরাইড’ মানে নুন গুঁড়ো মিশিয়ে কোনওমতো ম্যানেজ করতাম।
ব্যাঙ্কক শহরের একটা ছোট হোটেল। ব্রেকফাস্ট ফ্রি। ওটা সেরেই যাব শহর দেখতে। অনেকগুলো প্যাগোডা আছে। রাজার বাড়ি, ভাসমান বাজার– এসব আছে। টুকটুক ভাড়া করা হয়েছে। টুকটুক আমাদের টোটোর মতো গাড়ি। সকালে বেরিয়ে ফিরতে ফিরতে সন্ধে। দুপুরের খাওয়ার খরচটা বাঁচাতে হবে তো। খাবারের জায়গায় অনেক কিছুই রয়েছে যা খাওয়া চলে। পাউরুটির টোস্ট, মাখন, জেলি, ফলের রস, কলা, আপেল এসব তো আছেই, নানারকমের ভাতও। শ্রাদ্ধের পিণ্ডর মতো গোল করে পাকানো ভাত, মশলা ভাত, পান্তা ভাতও। স্যালাড, সালামি, আলুসেদ্ধ, আলুভাজা, ফল ইত্যাদি। ফলের রস খেয়ে কী হবে? পেটে তো থাকবে না। ভাতের দুটো পিণ্ড নিয়ে নিলাম, ওতে মাখন, আলুসেদ্ধ। নুন-গোলমরিচের ঝাঁকি কৌটোও ছিল। কলা নিলাম, টোস্ট-ওমলেট…। কত খাওয়া যায়? একটা ট্রেতে দেখলাম ছাল ছাড়ানো ইঁদুরও আছে। ছোট ছোট, গোল গোল ‘কদমা’র মতো দেখতে ডিমও আছে। ওদিকের ছোট চোখের লোকগুলো টপাটপ মুখে পুরছে। জানি না কীসের ডিম।
আমার পাশেই আমাদের দলের এক বাঙালি ছিলেন। উনি বেশ কয়েকটা সালামির টুকরো প্লেটে নিয়ে, তারপর হাতের মুঠোয় নিয়ে পকেটে ঢোকালেন । আমার চোখ এড়াল না। আর ওঁর চোখও এড়াল না যে, আমি দেখেছি। উনি আমার দিকে তাকিয়ে একটা চোখ টিপলেন। কানে কানে বললেন, ‘একটু স্টক করে নিন।’ আমি বুদ্ধমন্দির-টন্দিরে যাব বলে গেরুয়া পাঞ্জাবি পরেছিলাম এবং বেশ বড় বড় পকেট আছে তাতে। আর একটা ধামায় দেখলাম অনেক ডিম আছে। খোসা ছাড়ানো নয়। ওখানে লোকজনকে খোসা ছাড়িয়েই ডিম সেদ্ধ খেতে দেখেছি।
আমি ডিম এবং পাঞ্জাবির পকেটের মধ্যে সমন্বয় তৈরি করে নিতে দুটো ডিমসেদ্ধ টুক করে পকেটে পুরে নিই। দুপুরে খিদে পেলে…
…………………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
…………………………………
শায়িত বুদ্ধের মন্দিরে গিয়েছি। ভিড় আছে। একটু লাইন দিতে হয়। রেলিং রয়েছে। প্যাগোডার ভিতরে ধূপের গন্ধ। বৌদ্ধমন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে। আমার গা থেকে একটা বাজে গন্ধ বেরচ্ছে কেন? কেমন যেন আঁশটে গন্ধ…। বাঁ-হাতটা পাঞ্জাবির বাঁদিকে লাগল। হাতটা ভেজা ভেজা। চটচটে।
পকেটে হাত দিই। এ মা! কাঁচা ডিম ছিল! ওরা কাঁচা ডিমও খায়। কাঁচা ডিম পকেটে পুরেছিলাম? রেলিং-এ ধাক্কা লেগে ফেটে গেছে…।
ক্ষমা পরম ধর্ম হে বুদ্ধদেব।
…পড়ুন ব্লটিং পেপার-এর অন্যান্য পর্ব…
৫. তিনটে-ছ’টা-ন’টা মানেই সিঙ্গল স্ক্রিন, দশটা-পাঁচটা যেমন অফিসবাবু
৪. রাধার কাছে যেতে যে শরম লাগে কৃষ্ণের, তা তো রঙেরই জন্য
৩. ফেরিওয়ালা শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ ‘ফির’ থেকে, কিন্তু কিছু ফেরিওয়ালা চিরতরে হারিয়ে গেল
২. নাইলন শাড়ি পাইলট পেন/ উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন
১. যে গান ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝতে হবে সেই গানই কালজয়ী