শুক্রবার ছিল নতুন সিনেমা শুরু হওয়ার দিন। কেন শুক্রবার, তার কারণ জানি না। এই নিয়ম বহুদিনই ছিল, এখন আর এরকম হয় না। যে কোনও দিনই নতুন ছবি শুরু হয়ে যেতে পারে। আর ছায়াছবি বা সিনেমাকে বলা হত ‘বই’। মাসি-পিসিরা নিজেদের গল্পগুজবে জিজ্ঞাসা করত কী বই দেখলে? ‘বই’ বলার কারণ– তখন ছায়াছবিগুলো সাহিত্য-নির্ভর ছিল, আর সাহিত্যই মানেই তো বই। মনে আছে, লাস্ট দেখা ‘বই’-এর গল্প আদানপ্রদান হত।
৫.
ছোট বয়স থেকেই আমার এক বন্ধু ছিল, কবিতা লিখত, একটা ছোট পত্রিকাও করত; সিনেমাহলে টর্চলাইট হাতে নিয়ে টিকিট দেখে দর্শকদের সিট দেখাত। বুড়ো বয়সেও সেই স্মৃতি ও বহন করেছে।
দাঁতের ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলেছে, ‘ব্যালকনিতে শেষ দুটো ছেড়ে দিয়ে যেটা, সেটায় ব্যথা।’ মেয়ের বিয়েতে অতিথিকে চেয়ার দেখাচ্ছে, ‘ফ্রন্ট রো-তে চারটে ছেড়ে…।’ পরে ও প্রমোশন পেয়ে হল-ম্যানেজার হয়ে যায়। তখনও এইসব মাল্টিপ্লেক্স হয়নি। কলকাতার সিনেমাহলগুলো উঠে যায়নি। আটের দশক। সেই সব মারকাটারি বাংলা সিনেমার যুগ প্রায় শেষ হয়ে আসছে। উত্তমকুমার মারা গিয়েছেন ১৯৮০ সালে। এরপর কিছুকাল খরা। হিট ছবি হয় না তেমন, অনেকদিন পরে হিট হল ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’!
অনেকদিন পর ব্ল্যাকারদের মুখে হাসি ফুটেছিল। বহুদিন পর পাঁচ-কা-দশ, দশ-কা-বিশ হল। টিকিট ব্ল্যাক হলে ম্যানেজারদের মুখেও হাসির রেখা ফোটে। আমার বন্ধুটিও খুশি হয়েছিল, কারণ হল-ম্যানেজারদের সাহায্য ছাড়া ব্ল্যাকাররা টিকিট পেতে পারে না।
আমি উত্তর কলকাতায় বড় হয়েছি। শ্যামবাজার ট্রামডিপোর পর থেকে হাতিবাগান পর্যন্ত পরপর সিনেমাহল ছিল, কর্নওয়ালিস স্ট্রিট থেকে বিধান সরণির দু’পাশেই। প্রথমেই ‘মিনার’, তারপর ‘চিত্রা’, ‘দর্পণা’, ‘উত্তরা’, ‘শ্রী’, ফড়িয়াপুকুরেরর রাস্তা দিয়ে দু’মিনিট পরেই ‘টকি শো হাউস’, ‘শ্রী’ ছাড়িয়ে হাতিবাগান মোড়ে ‘রাধা’। হাতিবাগান ছাড়িয়ে একটু সামনে গিয়ে বাঁ-ধারের রাস্তায় ‘বিধুশ্রী’। একই গলিতে ‘রূপবাণী’, ‘রঙ্গনা নাট্যগৃহ’, পরে ওই গলিতেই ‘সারকারিনা’।
এই এলাকায় সর্বদাই এমন একটা আবহাওয়া, যেটা এখন ঠিক ব্যাখ্যা করা যাবে না। সিনেমাহল লাগোয়া রেস্টুরেন্ট, বাইরে চিনেবাদামওয়ালা ঝুড়ি নিয়ে, কিংবা ঝালমুড়ি। বিকেলের দিকে ফেরিওয়ালারা ফুটপাথে মেয়েলি পসরা সাজিয়ে, যেমন চুলের ক্লিপ, ফিতে, পানের ডিবে, নানারকম কৌটো, জামার বোতাম, সুতোর রিল…।
সিনেমার চটি-বই বিক্রি হত। সিনেমার কাহিনিটা অল্প করে বলার পর লেখা থাকত– ‘এবার দেখুন রূপালি পর্দায়’। ওই বইতেই সিনেমাটিতে ব্যবহৃত গানগুলি ছাপা থাকত। লিরিক এবং সুরকারের নামও থাকত। ওখানেই পাওয়া যেত কিশোরকুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যাায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের জনপ্রিয় ছায়াছবির গান। আর ছিল ব্ল্যাকাররা। যারা টিকিটগুলো দো-কা-চার, পাঁচ-কা-দশ করত, তাদের একজন দাদা থাকত।
হাতিবাগান অঞ্চলের ব্ল্যাকাররা দু’-তিনজন দাদার তত্ত্বাবধানে থাকত। দাদাদের মধ্যে ঝগড়া এবং সমঝোতার একটা জটিল সম্পর্ক ছিল। যে সিনেমা যত হিট, সে সিনেমার ব্ল্যাকারদের তত রমরমা। তখন জামাইবাবুদের অনেক শ্যালিকা থাকত। নিজের স্ত্রীর ভগিনী ছাড়াও থাকত খুড়তুতো, মাসতুতো, মামাতোরাও। এইসব জামাইবাবুরা সিনেমা দেখতে এসেছে ‘শালিবাহন’। টিকিট নেই, সুতরাং ব্ল্যাকে তো কিনতেই হবে। তিনটে-ছ’টা-ন’টা বলতে এইসব সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমাহলগুলোকেই বোঝায়, যেমন দশটা-পাঁচটা বললে অফিসবাবু। এখন মাল্টিপ্লেক্সে শো-এর কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই, অফিসেরও যেমন নেই কোনও নির্দিষ্ট সময়!
উত্তর কলকাতার মতো দক্ষিণ কলকাতাতেও এরকম পরপর সিনেমাহল ছিল। হাজরার মোড় থেকে কালীঘাট পর্যন্ত পরপর– ‘বিজলী’, ‘পূর্ণ’, ‘বসুশ্রী’, ‘ভবানী’, ‘উজ্জ্বলা’, ‘ইন্দিরা’…। ‘বিজলী’ সিনেমাহলের লাগোয়া একটা ছোট চপ-কাটলেটের দোকান থেকেই ক্রমে ‘বিজলী গ্রিল’। ‘উজ্জ্বলা’ সিনেমাহল লাগোয়া ছোট্ট ডালমুটের দোকানটার নাম ‘উজ্জ্বলার চানাচুর’, আজও বিখ্যাত। যদিও ‘উজ্জ্বলা’ সিনেমাহলটা কবেই উঠে গেছে!
শুক্রবার ছিল নতুন সিনেমা শুরু হওয়ার দিন। কেন শুক্রবার, তার কারণ জানি না। এই নিয়ম বহুদিনই ছিল, এখন আর এরকম হয় না। যে কোনও দিনই নতুন ছবি শুরু হয়ে যেতে পারে। আর ছায়াছবি বা সিনেমাকে বলা হত ‘বই’। মাসি-পিসিরা নিজেদের গল্পগুজবে জিজ্ঞাসা করত কী বই দেখলে? ‘বই’ বলার কারণ– তখন ছায়াছবিগুলো সাহিত্য-নির্ভর ছিল, আর সাহিত্য মানেই তো বই। মনে আছে, লাস্ট দেখা ‘বই’-এর গল্প আদানপ্রদান হত। আমার পিতামহ সিনেমাকে বলতেন ‘বাইশকোপ’, কিংবা ব্যঙ্গ করে ‘তেইশকোপ’! আসলে সিনেমাকে প্রথম দিকে বায়োস্কোপ বলা হত। তখন শুধু ছবিই দেখা যেত। চলন্ত ছবি। যখন কথা ফুটল তখন ‘টকি’। মানে ‘Talk’ করতে পারে। অনেক সিনেমাহলের সঙ্গে টকি শব্দটা জুড়ে দেওয়া ছিল, যেমন ‘গণেশ টকি’, ‘ভবাণী টকি’, ‘টকি শো হাউস’ ইত্যাদি। এরপর সিনেমা, মুভি।
সত্যজিৎ রায়ের আমল থেকে ‘ফিল্ম’ শব্দটা চালু হল। সিনেমা ফেস্টিভ্যাল নয়, ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল।
যা বলছিলাম, সিনেমাগুলো কলকাতায় মুক্তি পেত সাধারণত তিনটি বা চারটি সিনেমা হলে একসঙ্গে। যেমন রাধা-পূর্ণ-প্রাচী, উত্তরা-পূরবী-উজ্জ্বলা, শ্রী-প্রাচী-ইন্দিরা, রূপবাণী-অরুণা-ভারতী, বসুশ্রী-বীণা-চিত্রা। এই এতগুলি সিনেমাহলের মধ্যে আজ, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একটিই বেঁচে আছে, শিয়ালদা অঞ্চলের ‘প্রাচী’।
আমার জীবনে প্রথম সিনেমার নাম মনে আছে, কারণ আমার মায়ের কোলে বসে দেখা। ছবির নামও ‘মা ও ছেলে’। খুব ভয় পেয়েছিলাম, নাকি আশ্চর্য হয়ে নানারকম কথা বলছিলাম। বোধহয় কাঁদছিলামও। মনে আছে, লোকজন বলছিল ‘বাচ্চাকে নিয়ে বাইরে যান।’ মা বাইরে চলে এসে আমাকে বলেছিল, ‘সব মিছিমিছি। ভয়ের কিছু নেই। চোখ বুঁজে থাকবি।’
……………………………………
সিনেমাগুলো কলকাতায় মুক্তি পেত সাধারণত তিনটি বা চারটি সিনেমা হলে একসঙ্গে। যেমন রাধা-পূর্ণ-প্রাচী, উত্তরা-পূরবী-উজ্জ্বলা। শ্রী-প্রাচী-ইন্দিরা। রূপবাণী-অরুণা-ভারতী। বসুশ্রী-বীণা-চিত্রা। এই এতগুলি সিনেমাহলের মধ্যে আজ, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একটিই বেঁচে আছে, শিয়ালদা অঞ্চলের ‘প্রাচী’।
……………………………………
লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার টিকিটের দাম ছিল ‘দশ আনা’। মানে, ৬৫ পয়সা। বহুদিন ধরেই ছিল এই দাম। ‘রাধা’ ছিল এয়ার কন্ডিশন। ওখানেও ৬৫ পয়সার টিকিট ছিল, কিন্তু কম। ৯৫ পয়সা দিয়ে কাটতে হত। সাবেক ১৫ আনা। অ্যাডভান্স টিকিটের সর্বনিম্ন দাম ছিল ‘পাঁচসিকে’, মানে একটা ২৫ পয়সা। এরপর ছিল একটাকা বারো আনা, দু’-টাকা চার আনা ইত্যাদি। কোনও কোনও সিনেমা হলে ব্যালকনিতে ফ্যামিলি কেবিনও থাকত। ভাবা যায়!
আসলে সিনেমা দেখাটা ছিল একটা উৎসব। পিসিরা কুচি দেওয়া শাড়ি পরে, একটু সাজুগুজু করে ম্যাটিনি শো-তে যেতেন, মানে বেলা তিনটের শোয়ে। ইভিনিং-এর সঙ্গে মিলিয়ে অনেকে তাই বলত ‘ম্যাটিনিং শো’। অনেক বউদি পাড়াতুতো দেওরদের বলে অ্যাডভান্স টিকিট কাটিয়ে নিত। সিনেমাহলে চিনেবাদামের খোলা ভাঙার শব্দ শোনা যেত। শো শেষ হলে একটা খাওয়া-দাওয়া…।
১৫ আগস্ট, কিংবা ২৩ জানুয়ারি নেতাজীর জন্মদিনে বা ২৬ জানুয়ারির সকালবেলা দেশপ্রেমের সিনেমা আসলে আমাদের অভিভাবকরা নিয়ে যেতেন। আমার কাকা যেমন নিয়ে গিয়েছিলেন ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ দেখাতে। আজও সেই জালালবাদের পাহাড়ে হামাগুড়ি দিয়ে লড়াই করা টেগরাবলকে মনে পড়ে। ছোটবেলায় ছাদে ওঠার সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় মনে মনে ভাবতাম আমিই টেগরাবল, জালালবাদের পাহাড়ে উঠছি। এই ধরনের আরও ছবি ছিল– ‘ভুলি নাই’, ‘শহীদ ক্ষুদিরাম’, ‘সুভাষচন্দ্র’, ‘বিয়াল্লিশ’।
ভারতছাড়ো আন্দোলনের পটভূমিকায় ছিল ‘বিয়াল্লিশ’ (’৪২)। পুলিশ অফিসারের চরিত্রে ছিলেন অভিনেতা বিকাশ রায়। এই ছবি নাকি ১৯৫১ সালে মুক্তি পায়। বিপ্লবীদের সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহারের অভিনয়ের জন্যই নাকি বিকাশ রায়কে মারধোর খেতে হয়েছিল! এত ভালো অভিনয় যে, মানুষ বিকাশ রায়কেই ঘৃণা করতে শুরু করেছিল।
যখন ক্লাস এইট, একটু করে গোঁফের রেখা ফুটছে, তখন ‘A’ মার্কা সিনেমা দেখার লোভ হল। সিনেমাহলের দারোয়ানরাও তখনও বেশ গার্জিয়ানগিরি করত। ছোটদের ঢুকতে দিত না। শুনেছি আমাদের ক্লাসে কেউ কেউ নাকি ‘সঙ্গম’ দেখতে গিয়ে ফিরে এসেছে। দেখতে দেয়নি।
আমি দেখেছিলাম ক্লাস টেন-এ, মুনলাইট সিনেমায় ‘বোল রাধা বোল সঙ্গম হোগা কি নেহি’– রাজ কাপুরের গলায়। তখন বৈজন্তীমালা টেরিলিনের পাতলা সাদা শার্ট পরা, বলছে, ‘হোগা… হোগা… হোগা…’। তখন সিনেমাহল জুড়ে সিটি। ‘টুই, টুই, টুই…’ অদ্ভুত আওয়াজ। জিভের তলায় দু’-আঙুল ঢুকিয়ে সিটি মারার কৌশল রপ্ত করতে পারা বেশ কঠিন। আমি গুরু ধরেছিলাম, চেষ্টা করেছি, রপ্ত হয়নি। এরপর ‘শোলে’, ‘জংলি’, ‘লাভ ইন টোকিও’… আরও কত সব ছবি! এবং এই ছবিগুলোর টিকিট ব্ল্যাক হত। ব্ল্যাক না হলে ছবিটার যেন মান থাকত না।
বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে ‘পথে হল দেরী’, ‘সাগরিকা’, ‘হারানো সুর’, ‘শিল্পী’, ‘দেয়া নেয়া’– এই সব ছিল হিট সিনেমা। আর হিন্দির তো কথাই নেই। হাতিবাগান, কালীঘাট অঞ্চলের অধিকাংশ হলেই কিন্তু বাংলা ছবিই চালানো হত পাঁচ-ছয়ের দশকে। হিন্দি ছবি মাঝেমাঝে চলতো ‘চিত্রা’ (পরে ‘মিত্রা’), ‘দর্পণা’, ‘বিধুশ্রী’, ‘বীণা’, ‘সুরশ্রী’ এইসব হলে, আর ‘টকি শো হাউস’-এ আসত ইংরেজি ছবি।
‘টকি শো হাউস’-এ একবার দেখতে গেলাম ‘ইয়েস্টার ডে-টুডে-টুমরো’। সোফিয়া লোরেন ছিল। সোফিয়া লোরেন তখন কী যেন একটা! এখনকার ভাষায় বলে ‘হার্টথ্রব’। ‘টু উইমেন’ নামে একটি সিনেমার কথা খুব শুনেছি। সেটায় হটসিন আছে শুনেছিলাম, তাছাড়া অনেক পুরস্কারও পেয়েছে।
লাইনে দাঁড়ালাম। হল হাউসফুল। অ্যাডভান্স টিকিট সব বিক্রি হয়ে গেছে। ওই এলাকাটা জানতাম নাটাদার এলাকা। লাইনে দাঁড়াবার আগে আমি নাটাদাকে দেখেছিলাম হলের উল্টোদিকের রোয়াকে বসে আছে। ব্ল্যাক হচ্ছে তিনগুণ দামে। অনেক আগেই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ব্যাকলনের লাল গেঞ্জি পরা একটা লোক এসে আমাকে এবং আরও একজনকে হাত ধরে টেনে বের করে দিয়ে ওর নিজের দুটো ছেলেকে ঢুকিয়ে দিল! আমি নাটাদার কাছে গিয়ে নালিশ করলাম, কারণ নাটাদা আমাদের পাড়ার লোক। আমাদের গার্জেন মস্তান। তখন পাড়ার মস্তানরা পাড়ার ভালোমন্দ দেখত। বেপাড়ার চ্যাংড়ারা পাড়ায় মেয়েদের হিড়িক দিতে এলে এরাই আটকাত। অঞ্জন দত্ত-র একটা গান আছে ‘পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবে, বলেছে পাড়ার দাদারা…’। এই দাদারা মানে নাটাদারা। এইসব নাটাদারাই কেউ মারা গেলে শ্মশানযাত্রী হয়, বস্তিতে আগুন লাগলে নেভানোর ব্যবস্থা করে।
নাটাদা বলল, “বার করে দিয়েছে! চ’ তো চ’। দেখছি।”
নাটাদা জানে কে করেছে এই কাজ। নাটাদা সোজা লাল গেঞ্জির কাছে চলে গেল। বলল– ‘কি রে, একে বার করে দিয়েছিস? খুব ডিং নিচ্ছিস দেখছি। খুব বেড়ে গেছিস। এ আমার লোক। ঢুকিয়ে দে।’ লাল গেঞ্জি বলে– ‘সে আর হবে না নাটাদা। তুমি এখন এখানে ফালতু আসো কেন? তোমার রাজ আর নেই। এখন লালুদার রাজ। আমাকে তো চেনো। আমি লালুদার লোক।’
নাটাদা বলল– ‘ওইসব লালু-ফালু দেখাস না। ওরা আমার পকেট থেকে বেরিয়েছে, দরকার হলে আবার পকেটে ঢুকিয়ে দেব।’
‘কী ব্যাপার? কীসের কী চাই?’ বলতে বলতে লম্বা জুলফিওয়ালা একটা লোক এল। নাটাদাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। আন্দাজ করলাম ওই লোকটাই বোধহয় লালুদা।
নাটাদা উঠে দাঁড়াল। ওই লম্বা জুলফিকে একটা চড় মারল ঠাস করে। বলল, ‘আমি নাটা তপাদার। এতদিন সহ্য করেছি…’। কথা শেষ হবার আগেই দু’-তিনজন এক সঙ্গে নাটাদাকে আক্রমণ করল। নাটাদা বলল, ‘নো-নো-নো, ওয়ান বাই ওয়ান।’
একজন নাটাদার নাকে ঘুষি মারল। নাটাদা পড়ে গেল। রক্ত মুছে গিয়ে আঙুলে তুড়ি মেরে বলল, ‘নেক্সট…’। দ্বিতীয় জন ধাক্কা দিল শুধু। দেয়ালে ধাক্কা খেলো নাটাদা। আবার বলল, ‘নেক্সট…’। আমি নাটাদাকে জড়িয়ে ধরি। বলি, ‘সিনেমায় যাব না নাটাদা। চলুন।’
এইভাবেই হাতবদল হয়ে যেত সিনেমার সাম্রাজ্য। নাটাদার বদলে লালুদার হাতে চলে গেল এলাকা। তারপর তো পুরো সিনেমাপাড়াটাই ‘হারানো সুর’ হয়ে চলে গেল! আমাদের বয়সীদের স্মৃতিতে থেকে যাবে এসব কথা ও কাহিনি।
আরও কত কী মনে পড়ে। নিউজ-রিল। মূল সিনেমার আগে দেখানো হত। কত ভালো ভালো নিউজ রিল দেখেছি– সরকারি স্টিল প্ল্যান্ট, ডিভিসি, ডোকরা শিল্প, মণিপুর নাচ, কথাকলি নাচ…।
………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………….
আরও মনে পড়ে, সিনেমাহল লাগোয়া রেস্টুরেন্টের কেবিন– যেখানে মা, আমি, ছোটকাকু আর পিসতুতো বোন বসেছি। কাঁটা-চামচ আর চিনেমাটির প্লেটে কী আশ্চর্য শব্দ। হাত থেকে কাঁটা-চামচ ফসকে যাওয়া, যার অন্য নাম ‘ফর্ক’, জেনেছি পরে।
দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না।
…পড়ুন ব্লটিং পেপার-এর অন্যান্য পর্ব…
৪. রাধার কাছে যেতে যে শরম লাগে কৃষ্ণের, তা তো রঙেরই জন্য
৩. ফেরিওয়ালা শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ ‘ফির’ থেকে, কিন্তু কিছু ফেরিওয়ালা চিরতরে হারিয়ে গেল
২. নাইলন শাড়ি পাইলট পেন/ উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন
১. যে গান ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝতে হবে সেই গানই কালজয়ী
আমরা এক সময় গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়, অংশুমান রায়ের সুরে ও কণ্ঠে ‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি/ আকাশে বাতাসে ওঠে রণি/ বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ গান শুনে রোমাঞ্চিত হয়েছি– তাই বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে আমি খুবই মুষড়ে পড়েছিলাম।