Robbar

রামেও আছি, রোস্টেও আছি!

Published by: Robbar Digital
  • Posted:April 12, 2025 7:36 pm
  • Updated:April 12, 2025 7:42 pm  

আঙ্কোর ভাটের মন্দিরগাত্রের প্যানেলে রাম দু’-হাত তুলে নাচছে, লক্ষ্মণ ঢোল বাজাচ্ছে। এবং বিরাট জালা থেকে মদ‌্যপান করছে বানরেরা। পরের প‌্যানেলে রাম সিংহাসনে, মাথাটা কেমন যেন কাত হয়ে গেছে, শরীর এলিয়ে গেছে। পরের প‌্যানেলে দেখি চারটি বানর একটি শুয়োরের চারটি ঠ‌্যাং ধরে রেখেছে, তলায় আগুন জ্বলছে, মানে শুয়োর রোস্ট হচ্ছে। বিজয় উৎসব। পরের প‌্যানেলে অনেক মানুষ ও বানর। মাঝখানে রাম, হাতে পানপাত্র। ওধারে তৈরি হচ্ছে পর্ক রোস্ট।

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

৯.

আঙ্কোর ভাট আর বরোবুদুর দেখার ইচ্ছেটা জন্মেছিল ক্লাস সেভেনে, বাংলার মানে-বই পড়ে। সত‌্যেন্দ্র দত্ত’র যে কবিতাটায় ‘আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ লঙ্কা করিয়া জয়’, সেই কবিতাতেই আছে আঙ্কোর ভাট আর বরোবুদুর মোদেরই প্রাচীন কীর্তি। মানে বইতে টীকা থাকত। পরীক্ষাতেও আসত টীকা লিখ: বরবুদুর, আঙ্কর ভাট…। তখন জেনেছিলাম ভারতের দর্শনচিন্তা, সাহিত‌্য ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে গিয়েছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। ইন্দোনেশিয়াতে, আজকের কম্বোডিয়ার– যার নাম ছিল ‘কম্বোজ’, ওসব অঞ্চলে তৈরি হয়েছিল শিবের এবং বিষ্ণুর মন্দির। পরে আগ্রহটা বাড়ে হায়ার সেকেন্ডারির পর, রবীন্দ্রনাথের ‘জাভাযাত্রীর পত্র’ পড়ে।

All About The Borobudur Temple Compounds In Indonesia
বরোবুদুর

একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম ২০০২ সালে। একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম খবরের কাগজে– ‘শ‌্যাম-কম্বোজ ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিবার জন‌্য ষাটোর্ধ্ব স্বাস্থ‌্যবান ব‌্যক্তি যোগাযোগ করুন।’ যাঁর ফোন নম্বর দেওয়া ছিল, তাঁর নাম সুধীর ঘোষ! উনি ডাক্তার মানুষ। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। আমি উৎসাহী শুনে, উনি বললেন, ‘আপনি তো ইয়ং ছোকরা মশাই, আপনার সঙ্গে ঠিক পটবে না।’ আমি বলি, ‘ইয়ং কী বলছেন! পঞ্চাশ বছর বয়স হয়ে এল আর মাত্র দশ হলেই ষাট!’

ডাক্তারবাবু বললেন, ‘এই বয়েসটাই ডেঞ্জারাস। আমরা থাইল‌্যান্ড, লাওস হয়ে কম্বোডিয়া যাব, বাই রোড। আমরা পাঁচজন রেডি আছি, সবাই সমবয়সি। তাই সমমনস্ক লোক চাইছি।’
আমি বলি, ‘অসুবিধে নেই, আমি শরীরে পঞ্চাশ বাট মনেতে ষাট!’

Buy Sukhasane Sukhahar Book Online at Low Prices in India | Sukhasane Sukhahar Reviews & Ratings - Amazon.in

যাই হোক, ওঁরা রাজি হল। আমাদের দলে একজন সে সময়ের একজন নামী সাংবাদিক ছিলেন, রমেন মজুমদার। ওঁর ‘সুখাসনে সুখাহার’ নামে একটা বই রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিল। দু’জন অধ‌্যাপিকা, একজন ফোটোগ্রাফার ছিলেন। আর একজনও ছিলেন, যিনি হলেন হোসপাইপ বিশারদ। হোসপাইপের বিভিন্ন প্রযুক্তি, ব‌্যবহার এবং উৎপাদন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান। ওঁর একটা শখ ছিল– পৃথিবীর পরম আশ্চর্য এবং বিখ‌্যাত জায়গাগুলির মূলবিন্দুতে গিয়ে অন্তত এক ঢোক মদিরা পান করা! উনি মিশরের গিজায় খুফুর পিরামিডের গায়ে হেলান দিয়ে মদিরা পান করেছেন, আইফেল টাওয়ারের উপর উঠেও। রোমের কলোসিয়ামে, স্পেনের হালহাম্বারায়, অজন্তার গুহায়, চিত্রকূট জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়িয়ে, মাচু-পিচুর সিঁড়িতে বসে সুরাপান হয়ে গেছে। তাজমহলে হয়ে ওঠেনি। আগে কাজটা সম্পন্ন করা হয়নি, আজকাল বড্ড ‘কড়াক্কড়ি’। দেখা যাক, আঙ্কোর ভাট মন্দিরে এটা সম্ভব হয় কি না।

যে কোনও সমবেত ভ্রমণে এরকম বিচিত্র লোক দেখা যায়। আমি যাকে অন‌্যরকম ভাবছি, হয়তো তিনও আমাকে ‘অন‌্যরকম’ ভাবছেন। আমি এই বিষয়টি ঘাঁটতে চাইছি না। ভ্রমণ বৃত্তান্তও লিখতে চাইছি না। বিষয়টি মন্দিরের গায়ের কারুকাজ নিয়ে।

সবাই জানেন, আঙ্কোর ভাট একটা বিষ্ণুমন্দির ছিল। ১১৩০ থেকে ’৬০-এর মধ‌্যে তৈরি হয়েছিল এবং বহু বছর লেগেছিল। রাজা সূর্য বর্মনের রাজত্বকালে তৈরি হয়। ৮১০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ দক্ষিণ ভারতের এক নির্বাসিত রাজপুত্র কম্বোডিয়াতে আসেন। অঞ্চলটির নাম তখন ‘কম্বোজ’। চম্পারাজ‌্য বলা হত এলাকাটিকে। সেই রাজপুত্র স্থানীয় কন‌্যাকে বিয়ে করেন। তাঁর নাম সম্ভবত জয়বর্মন। ভারতের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ছিল তাঁর এবং তাঁদের বংশধরদের। শৈব এবং বৈষ্ণব ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে ওধারে গেছে দক্ষিণ ভারতীয় সংগীত শৈলী, হাতজোড় করে নমস্কার এবং ফুল দিয়ে আরাধনা। তবে ওরা পোকামাকড় খাওয়াটি ছাড়তে পারেনি। খাওয়ার ব‌্যাপারে অষ্টম-নবম শতাব্দীর হিন্দু ভাবনাকে পাত্তাও দেয়নি ওরা। ওরা নমস্কার করে দেবতার পায়ে ফুল দিয়েছে, নিজেদের নামও সংস্কৃত ঘেঁষা রেখেছে, শহরগুলির নামও সংস্কৃত ঘেঁষা।

মেকং নদীতে চীন-লাওস-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড যৌথ টহল সমাপ্ত
মেকং নদী

মেকং নদীকে পবিত্র মনে করে, পাপহারিণী মনে করে ডুব দেবার অভ‌্যেসও রপ্ত করেছে, কিন্তু গরু, মোষ, শুয়োর সবই খায়। এবং বেশ আনন্দ করেই খায়। ওরা রামকে নিজেদের লোক ভাবে। এবং নিজেরা যা ভালোবাসে সেটাই খাওয়ায়। হ‌্যাঁ, সেই রঘুপতি রাঘব রাজা রাম।

থাইল‌্যান্ড থেকে ইন্দোনেশিয়া– এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রামায়ণের আশ্চর্য প্রভাব। থাইল‌্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া– সবাই মনে করে রাম ওদের দেশের লোক। অন্তত দশটা অযোধ‌্যা আছে এই অঞ্চলে। আজুদা, ইদুদা, ইয়াউদা, আজোয়া, ওযুদা– এরকম সব নাম।

AirlinePros International Appointed as Garuda Indonesia's GSA in the United States and Canada
গরুড় এয়ারলাইন্স

ইন্দোনেশিয়ার ৯৩ শতাংশ লোক এখন মুসলমান। ইসলাম গেছে দ্বাদশ শতাব্দী থেকে। কিন্তু ওরা রামায়ণ ছাড়েনি। প্রাচীন সংস্কৃতি ছাড়েনি। শহরের বিভিন্ন জায়গায় চার হাতের বিষ্ণুমূর্তি, কাঁধে ধনু নিয়ে রামচন্দ্র। গরুড় হল ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রচিহ্ন। সরকারি বিমান সংস্থার নাম ‘গরুড় এয়ারলাইন্স’। রাষ্ট্র প্রধানের নাম হয় সুকর্ণ (সোয়েকর্ণ), সুহার্তো (সুরথী), সুসিলো (সুশীল)। রামায়ণ গান করে মুসলমান শিল্পীরা, ছায়াপুতুলের খেলা দেখায়। এতে রামেরও কোনও অসুবিধা হয় না, ওদের ইসলামেরও কোনও ধর্মসংকট হয় না। ওখানে কোনও দাঙ্গা নেই। বৌদ্ধ, মুসলমান, হিন্দু, তাওপন্থী, খ্রিস্টান– সবাই পাশাপাশি আছেন। রাম সবার।

আঙ্কোর ভাটের মন্দিরের গায়ে খোদাই করা কারুকাজে রামায়ণ-মহাভারতের গল্প আছে। একটা লম্বা দেওয়াল জুড়ে প‌্যানেল। পরপর রিলিফের কাজ। সীতাহরণ, জটায়ুর ডানাকাটা, লঙ্কায় সীতা বসে আছে জঙ্গলে, এবার রামের আগমন, রাম-রাবণের যুদ্ধে, বানর সেনা… সব পরপর চলছে। যুদ্ধে রামের জয়। বানরদের উল্লাস, সব ঠিক আছে। এরপরের প‌্যানেলে আসুন।

রাম দু’-হাত তুলে নাচছে, লক্ষ্মণ ঢোল বাজাচ্ছে। এবং বিরাট জালা থেকে মদ‌্যপান করছে বানরেরা। পরের প‌্যানেলে রাম সিংহাসনে, মাথাটা কেমন যেন কাত হয়ে গেছে, শরীর এলিয়ে গেছে। পরের প‌্যানেলে দেখি চারটি বানর একটি শুয়োরের চারটি ঠ‌্যাং ধরে রেখেছে, তলায় আগুন জ্বলছে, মানে শুয়োর রোস্ট হচ্ছে। বিজয় উৎসব। পরের প‌্যানেলে অনেক মানুষ ও বানর। মাঝখানে রাম, হাতে পানপাত্র। ওধারে তৈরি হচ্ছে পর্ক রোস্ট।

এরপর আর মন্তব‌্য করছি না কিছু।

…পড়ুন ব্লটিং পেপার-এর অন্যান্য পর্ব…

৮. বাঘ ফিরেছে বাগবাজারে!

৭. রেডিওর যত ‘উশ্চারণ’ বিধি

৬.হৃদয়ে লেখো নাম

৫. তিনটে-ছ’টা-ন’টা মানেই সিঙ্গল স্ক্রিন, দশটা-পাঁচটা যেমন অফিসবাবু

৪. রাধার কাছে যেতে যে শরম লাগে কৃষ্ণের, তা তো রঙেরই জন্য

৩. ফেরিওয়ালা শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ ‘ফির’ থেকে, কিন্তু কিছু ফেরিওয়ালা চিরতরে হারিয়ে গেল

২. নাইলন শাড়ি পাইলট পেন/ উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন

১. যে গান ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝতে হবে সেই গানই কালজয়ী

………………………………….

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

………………………………….