Robbar

যে গান ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝতে হবে সেই গানই কালজয়ী

Published by: Robbar Digital
  • Posted:February 15, 2025 7:55 pm
  • Updated:February 16, 2025 11:42 am  

ট্রেনের গানের একটা গণমন আছে। ‘আমার সাধ না মিটিলো’ শেয়ালদা লাইনে যত জনপ্রিয়, হাওড়া লাইনে নয়। কারণ শেয়ালদা লাইনে বাঙাল বেশি। ‘এ পৃথিবীতে কেহ ভালো তো বাসে না এ পৃথিবী ভালবাসিতে জানে না’ উদ্বাস্তুদের খুব মনের মতো। আবার গেদে লোকাল, লালগোলা লোকাল খুব লেট করে। ‘কতদূর আর কতদূর বলো মা….’ এক্কেবারে মনের মতো। ট্রেনের গানের আবার অঞ্চলভেদ আছে।

প্রচ্ছদ শিল্পী: শান্তনু দে

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

১.

লোকাল ট্রেনে যাঁরা যাতায়াত করে থাকেন, তাঁরা জানেন ট্রেন-গায়কদের কত বদল ঘটে গিয়েছে। স্মৃতি খাবলে সাতের দশকের ট্রেনের গান টেনে আনলে শুনি, ‘আমার সাধ না মিটিল/ আশা না পুরিল/ সকলি ফুরায়ে যায় মা’ কিংবা ‘পথের ক্লান্তি ভুলে– স্নেহ ভরা কোলে তব/ মা গো বলো কবে শীতল হব,/ কতদূর আর কতদূর….।’ এঁরা খালি গলায় গাইতেন। গায়কদের মধ‌্যে দৃষ্টিহীনের সংখ‌্যাই থাকত বেশি– ‘অন্ধ হয়ে ভাই কত কষ্ট পাই, বাবুরা, বাবারা একটা দশ নয়া দিন’– সুর করেই গাইতেন কেউ।

‘মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন’– এই গানটিও শোনা যেত খুব। আটের দশকে রবীন্দ্রসংগীত শুনি ট্রেন-গায়কের গলায়– ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো হে বন্ধু হে প্রিয়’। একজন দৃষ্টিহীনের গলায় শুনলাম, ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে।/ অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহি রে।’ বাক‌্যটা সুর পেল, আমার বুকটা নিংড়ে উঠেছিল, গায়কটি কী অবলীলায় গানটা গাইলেন, যেন ‘হোমটাস্ক’। একই গায়ককে দেখেছি ভেন্ডার কামরায় গাইছেন ‘লে গয়ি দিল গুড়িয়া জাপান কি, পাগল মুঝে কর দিয়া।’ জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘‘সেদিন গাইলেন ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম’, এখন ‘লাভ ইন টোকিও’…?’’ উনি বলেছিলেন, ‘যে-যেটা চায় আর কী!

‘টি.আর.পি’ শব্দটা তখনও বাজারে ঢোকেনি। পাঁচের দশকের গানগুলোর কিছু এবং ছয় থেকে আটের দশকের কিছু মিলে গোটা ২০ গান ট্রেনের গায়কদের গলায় চলছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। যে গানগুলো ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝে নিতে হবে এই গান কালজয়ী হল।

Amrit Bharat Station Scheme | Hawker roosting roasting: Amrit Bharat Station Scheme at the cost of thousands of livelihoods of railway hawkers - Telegraph India

……………………………………………….
‘কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে যেন আমায়’ হয়ে যায় ‘কোন শেয়ালের স্বপ্ন নিয়ে’। ‘বেশ করেছি প্রেম করেছি করবোই তো, গাধার মতো মরতে হলে মরবোই তো’। ‘হাজার টাকার ঝাড়বাতি’টা হয়ে যায় ‘হাজার টাকার ধারবাকিটা’। রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রে ‘আকাশে উড়িছে বক পাখি’ ট্রেনে কেন, আলুলায়িতা রবীন্দ্রসেবীর কণ্ঠে শুনেছি। তবে ট্রেনের এক রসিক গায়ক ভুল করে নয়, সম্ভবত ইচ্ছে করেই গেয়েছেন ‘রোদজ্বলা দুপুরে সুর তুলে নূপুরে, গাছ থেকে তুমি যবে নামতে’। নইলে এ সময় মুখে একটা আশ্চর্য‌ স্মাইলি লেগে থাকত কেন?

……………………………………………….

নয়ের দশকের পরে যেসব গান বাঙালি মধ‌্যবিত্ত মন কিছুদিনের জন‌্য হলেও হিন্দোল জাগিয়েছিল, এখন ঘুমিয়েছে, তার একটিও ট্রেনের ভিখারিদের গলায় আসেনি। একবার শুধু ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানটা শুনেছিলাম, সে ছিল টেক্‌ভিখারি। কোমরে বাঁধা স্পিকার, হাতে মাউথপিস, সাউন্ড ট্রাকে মিউজিক, উনি লিপ দিচ্ছেন। জিজ্ঞাসা করেছিলাম এইসব গানকে কী বলে? উনি বলেছিলেন, এগুলো জিরেনকাটি গান। ‘জিরেন কাট’ শব্দটি খেজুরের রস বের করার সঙ্গে সম্পর্কিত। ঠিক কী বলতে চাইলেন, বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞাসা করি, ‘আর কী কী জিরেনকাটি গান জানেন?’ উনি বলেছিলেন, ‘‘জানি কতকগুলো– ‘ও ডাক্তার’, তারপর ‘সরকারি কর্মচারী’…।’’

Blind Man Singing in Train | Real Hidden Talant Of India - YouTube

খেজুর গাছকে দু’-তিনদিন জিরেন, মানে বিশ্রাম দেওয়ার পর যে কাঁটাটা হয়, তার রস বেশ ভালো এবং বেশি। তবে শীতকালটা চলে গেলেই ‘জিরেন কাট’ অর্থহীন।

ট্রেনের গানের একটা গণমন আছে। ‘আমার সাধ না মিটিলো’ শেয়ালদা লাইনে যত জনপ্রিয়, হাওড়া লাইনে নয়। কারণ শেয়ালদা লাইনে বাঙাল বেশি। ‘এ পৃথিবীতে কেহ ভালো তো বাসে না, এ পৃথিবী ভালোবাসিতে জানে না’ উদ্বাস্তুদের খুব মনের মতো। আবার গেদে লোকাল, লালগোলা লোকাল খুব লেট করে। ‘কতদূর আর কতদূর বলো মা….’ এক্কেবারে মনের মতো। ট্রেনের গানের আবার অঞ্চলভেদ আছে। ট্রেন বিশেষেও গানের প্রকারভেদ আছে। বারুণী লোকাল বোলপুর হয়ে যায়, আবার বিশ্বভারতী এক্সপ্রেসও। বারুণী লোকালে বাউল গান শুনবেন কম, বিশ্বভারতী এক্সপ্রেসে বেশি। কারণ ওই ট্রেনে বাবু-বিবি বেশি। দাড়িবাবু-ঝুঁটিবাবু বেশি। ওরা ভাবে, ট্রেনে বাউল না শুনলে শান্তিনিকেতন ট্রিপের নম্বর কাটা যায়। এই বাবু-বিবিদের প্রার্থিত গানের এক নম্বরে আছে ‘হৃদমাঝারে রাখবো ছেড়ে দিব না’। আবার হাওড়া-তারকেশ্বর লাইনে ভবা পাগলার গান। বর্ধমান-আসানসোলে হিন্দি গান। ক‌্যানিং-ডায়মন্ডহারবার লাইনে আধুনিক। আধুনিক গানগুলির কথাও গায়করা নিজের মতো করে বাগিয়ে নিত। এরকম নিজের মতো করে নেওয়াটা লোকজীবনে বেশ মজাদার। পর্তুগিজদের ‘অ‌্যাগানাস’কে আমরা ‘আনারস’ করেছি। রস আছে বলেই তো। হাতলওলা যে আর্মচেয়ারে বসে খুব আরাম, ওর নাম দিয়েছি ‘আরাম কেদারা’। কাপ্‌ল বার্গিশকে গোপাল বার্নিশ। ট্রেনের গানও তেমন হয়ে যায়।

Rhythm on Rails - Profiling The Invisible Musicians On Mumbai Locals

‘কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে যেন আমায়’ হয়ে যায় ‘কোন শেয়ালের স্বপ্ন নিয়ে’। ‘বেশ করেছি প্রেম করেছি করবোই তো, গাধার মতো মরতে হলে মরবোই তো’। ‘হাজার টাকার ঝাড়বাতি’টা হয়ে যায় ‘হাজার টাকার ধারবাকিটা’। রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রে ‘আকাশে উড়িছে বক পাখি’ ট্রেনে কেন, আলুলায়িতা রবীন্দ্রসেবীর কণ্ঠেও শুনেছি! তবে ট্রেনের এক রসিক গায়ক ভুল করে নয়, সম্ভবত ইচ্ছে করেই গেয়েছেন, ‘রোদজ্বলা দুপুরে সুর তুলে নূপুরে, গাছ থেকে তুমি যবে নামতে’। নইলে এ সময় মুখে একটা আশ্চর্য‌ স্মাইলি লেগে থাকত কেন? বনগাঁ লাইনে একজন আমলকীর হজমি আর জোয়ানের গুঁড়ো বিক্রি করতেন জনপ্রিয় গানের সুরে স্বরচিত কথায় গাইতে গাইতে। তাঁর কয়েকটি গান মনে আছে। ‘আজ আমি বেকার বলে, বৌদি যে ঝাঁটা তোলে, গালাগালি দেয় প্রাণ ভরিয়া/ সকালে রেশনের থলে, কুয়ো থেকে জল তুলে সারা দেহ ঘামে ওঠে ভরিয়া…।’ কিংবা ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে/ পেটে গ‌্যাস নাই, সুখের শ‌্যাষ নাই– সকলের পটিটা বড় সুন্দর হয়েছে… এই আমলকীর গুণে, দাদারা, এই হজমির গুণে’। হকারদের কথা আলাদা করে অন‌্য একদিন বলা যাবে।

Life on Mumbai Local: This group has been on devotional track for ...

ট্রেনে গান গেয়ে বই বিক্রি করা গ্রাম‌্য কবিও দেখেছি আটের দশকেও। ওঁরা পাঁচালির বই বিক্রি করতেন। আটপাতার, ষোলোপাতার বই– আট আনা/একটাকা। নিউজ প্রিন্টে ছাপা। বইগুলির নাম হত ‘কলির বউ হাড় জ্বালানী’, ‘হাফ প‌্যান্ট পরা শাশুড়ি’, ‘বোকা নাপিতের ধোঁকা খাওয়া’, ‘চাকদহের বনমালি’, ‘ইংলিশ ইস্কুল’। পায়ে ঘুঙুর বাঁধা থাকত। ঘুঙুর বাজিয়ে গাইতে– ‘বাপকে বলে ড‌্যাডি আর মাকে বলে ম‌্যাম, গুড়রুটি খায় না ছেলে পাউরুটি আর জ‌্যাম, নটি বয় জুতো আর গলায় বাঁধা টাই, মাস মাইনে দেড়শো টাকা কোথা থেকে পাই?’ কিংবা অন‌্যরকম ছন্দে–
‘বলে রাঁধতে নারি কলির নারী সিনেমাতে যায়
গালে মাখে পাউডার ঠোঁটে লিপস্টিক লাগায়
চলে ভিড় কাটিয়া
চলে ভিড় কাটিয়া ধাক্কা দিয়া পরপুরুষের গায়
আই অ্যাম সরি বলে নারী মুচকি হেসে যায়।’

আশ্চর্য‌ের ব‌্যাপার, এইসব নারীবিরোধী পাঁচালি মহিলা কামরাতেই বেশি বিক্রি হত।

ট্রেনের নিত‌্যযাত্রীদের মধ‌্যে কেউ কেউ বেশ দূর থেকে কলকাতায় যাতায়াত করেন। যেমন বর্ধমান, কৃষ্ণনগর, মেদিনীপুর, বসিরহাট। আড়াই-তিন ঘণ্টা কাটাতে হয়। দলবদ্ধভাবে যাতায়াত করেন। কোনও দল তাস খেলতে খেলতে আসেন। আবার কোনও দলে দু’-একজন গায়ক জুটে য়ায়। ওখানে চলমান সংগীত চর্চা চলে।

চলমান সংগীতে তার চলমান জীবন। নিজের কথা ও সুর।

শুনি ছেলে হাঁটতে পারে আমি দেখি না
পেছন গাছে আম ফলেছে খবর রাখি না
ছ’টার সময় নেয়ে আসি
সাড়ে ছ’টায় খেতে বসি
সাতটা কুড়ির ট্রেন ধরে হায় নিত‌্যি শেয়ালদা।
ও দাদা, নিত‌্যি শেয়ালদা।
রাত দশটায় ফিরি যখন
ছেলেমেয়ে ঘুমোয় তখন
ছেলে নাকি হাঁটতে পারে
কেমন জানি না।

………………………………………

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

………………………………………