মোটামুটি শুরু থেকেই, শুটিংয়ের জন্য বুকড হতে থাকল ‘সান এন স্যান্ড’। একদিন, শশী কাপুরের সঙ্গে, কোনও দরকারে, দেখা করতে এসেছিলেন অমিতাভ। কিন্তু, হোটেলের গেটেই আটকে দেওয়া হল তাঁকে। শেষমেশ, জুহুর সৈকতে দাঁড়িয়ে, লম্বা-লম্বা হাত নেড়ে, প্রিয় সহ-অভিনেতার নজর ফেরাতে পারলেন নিজের দিকে। পরে, মেগাস্টার অমিতাভ এখানেই প্রেস কনফারেন্স করতেন। এখান থেকেই তাঁর বাড়িতে বিরিয়ানি আর শিক কাবাব যায়, এখনও।
ঋত্বিক ঘটকের কেরিয়ারে, সম্ভবত, সবথেকে অনালোচিত কাজ, ‘মুসাফির’। ঋত্বিক স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন, পরিচালনায় হাতেখড়ি হয়েছিল হৃষীকেশের। অভিনয়ে ছিলেন সুচিত্রা সেন, কিশোর কুমার, দিলীপ কুমারের মতো স্টার। সংগীতে, সলিল চৌধুরী। ক্যামেরায়, বিমল রায়ের প্রিয়তম সিনেমাটোগ্রাফার, কমল বোস।
ইদানীংকালে, বিশেষত ওটিটি-বাজারে, অ্যান্থোলজির প্রোডাকশন যে হারে বেড়েছে, সে সময় এরকম ছিল না। খানিক এক্সপেরিমেন্ট হিসেবেই, মেনস্ট্রিম সিনেমায়, তখন দেখা হত ব্যাপারটা। ‘মুসাফির’-এর আসলি চরিত্র, আসলে, ছোট্ট একটা বাড়ি। বাড়িটায় অনেকে আসেন, প্রয়োজনের খাতিরে, ভাড়া নিয়ে। জীবনের কিছুটা অংশ কাটিয়ে, মায়া রেখে বা না রেখে, চলে যান তাঁরা। শুধু ঘটনাগুলোর সাক্ষী হয়ে, বাড়িটা দাঁড়িয়ে থাকে; একা, বোবা।
এবার, বাড়ির জায়গায় ধরা যাক, একটা হোটেল। ভাড়াটে নয়, ক্লায়েন্ট হয়ে আসছেন ফিল্ম-জগতের মহারথীরা। হ্যাঁ, এরকমই একটা আইডিয়া খেলে গেছিল ‘অ্যাম্বাসাডর’ হোটেলের মালিক জ্যাক ভয়ান্টিসের মাথায়, পাঁচের দশকের শেষে। গ্রিক রক্তের জ্যাক ছিলেন খাঁটি ইয়োরোপীয় মেজাজের, লম্বা-চওড়া চেহারার। ঠোঁটের কোণে হামেশা ঝুলত জ্বলন্ত সিগার। জামাকাপড় কেতাদুরস্ত না হলে, সাউথ বম্বের ‘অ্যাম্বাসাডর’-এ ঢোকার অনুমতি পেতেন না কেউ।
একদিন, বন্ধু গুল আদবানিকে আইডিয়াটা জানালেন জ্যাক। গুল তখন জুহুর সৈকত ঘেঁষে অনেকটা জমি কিনেছেন, বাংলো বানিয়ে বেচবেন বলে। সায়রা বানুর মা, অভিনেত্রী নাসিম বানুর সঙ্গে একটা বাংলোর চুক্তিও হয়ে গেছিল। কিন্তু, জ্যাকের আইডিয়াটা গুলের মনে ধরে গেল। ক’দিন পরেই, নাসিম বানুকে ডিলের অ্যাডভান্স টাকাপয়সা ফেরত দিলেন তিনি।
নভেম্বর, ১৯৬২-তে দরজা খুলল ‘সান এন স্যান্ড’ – বম্বের দ্বিতীয় পাঁচতারা হোটেল, এবং সারা দেশের প্রথম সৈকত-মুখী পাঁচতারা হোটেল। ততদিনে, বম্বের বৈভব দক্ষিণ ছাড়িয়ে, আরব সাগরের পার ধরে, ক্রমশ এগিয়ে আসছে শহরতলির দিকে। হ্যাঁ, এখনকার চূড়ান্ত-পশ বান্দ্রা, খার, পালি হিল, আন্ধেরি– তখন সবই, সত্যিই, সাবার্ব। অধিকাংশ স্টুডিও উত্তরের দিকে হওয়ায়, উঠতি-ফিল্মস্টারদের বসতি আর প্রোডাকশন অফিস গড়ে উঠছিল উত্তরেই। অতএব, জ্যাক ও গুলের ব্যবসায়িক বুদ্ধি, অচিরে, দুইয়ে দুইয়ে চার।
মোটামুটি শুরু থেকেই, শুটিংয়ের জন্য বুকড হতে থাকল ‘সান এন স্যান্ড’। কারণ, প্রথম দিন থেকে, সেখানে নিজস্ব সুইমিং পুল। বহু হিন্দি সিনেমায়, ধনী পিতার তরুণী কন্যার সাঁতারের দৃশ্য এই পুলেই নেওয়া। মাল্টি-স্টারার ব্লকবাস্টার ‘ওয়াক্ত’-এর অনেক সিকোয়েন্স এখানেই শুট হয়েছিল; মীনা (সাধনা) আর রবি (সুনীল দত্ত) যেখানে পরস্পরের প্রতি প্রেম নিবেদন করেন, সেটা এই হোটেলই। হেলেনের অনেক ড্যান্স সিকোয়েন্সের ব্যাকড্রপে আছে এখানের ‘সানসেট রুম’, যেটা এখন চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ‘হাওচি’।
এখানের সুইমিং পুলে সাঁতার শিখেছিলেন সায়রা বানু, সঞ্জয় দত্ত। এখানের হেলথ ক্লাবে নিয়মিত আসতেন শ্রীদেবী, রাকেশ রোশন, প্রেম চোপড়া, জিতেন্দ্র। কেরিয়ারের শীর্ষে, শহরে থাকলে, জিতেন্দ্রকে প্রায়ই পাওয়া যেত এ হোটেলের লবিতে; দেদার অটোগ্রাফ দিতেন।
সিঙ্গাপুরে ‘মহম্মদ রফি নাইট’ হবে, আয়োজকদের মধ্যে একজন ছিলেন হোটেলের সিনিয়র ভিপি গুলশন অরোরার বন্ধু। বন্ধুর অনুরোধ এল, যদি কোনও বলিউড স্টারকে পাওয়া যায় ফাংশনে। রাজেন্দ্র কুমারকে বললেন অরোরা। অনুষ্ঠানে উপস্থিতির জন্য কোনও ফি না নিয়েই, এক বাক্যে রাজি জুবিলি কিং। আয়োজকেরা, সে সময়, শুধুমাত্র রাজেন্দ্র কুমারের আসা-যাওয়ার ফ্লাইট আর দু’রাত থাকার ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন।
রাকেশ রোশনের এনগেজমেন্ট, প্রেম চোপড়ার তিন মেয়ের বিয়ে, শত্রুঘ্ন সিনহার ছেলের এনগেজমেন্ট– সব এখানে। স্কুলে পড়ার সময়ে, কৈশোরের উত্তেজনায়, ঋষি কাপুর ঘোরাঘুরি করতেন ওই সুইমিং পুলের আশপাশে। ঠিক ‘মেরা নাম জোকার’-এর মতো, হাঁ হয়ে থাকতেন বিকিনি-পরিহিতা বিমানসেবিকাদের দিকে। সুইস এয়ারলাইনসের উন্মুক্ত এয়ার-হোস্টেসরা এখানে সূর্যস্নান করতেন।
শশী কাপুর রবিবারে শুটিং করতেন না। বম্বেতে থাকলে, সপরিবার সময় কাটাতে, চলে আসতেন এখানে। অমিতাভ বচ্চন তখনও পায়ের নিচে মাটি পাননি। একদিন, শশী কাপুরের সঙ্গে, কোনও দরকারে, দেখা করতে এসেছিলেন অমিতাভ। কিন্তু, হোটেলের গেটেই আটকে দেওয়া হল তাঁকে। শেষমেশ, জুহুর সৈকতে দাঁড়িয়ে, লম্বা-লম্বা হাত নেড়ে, প্রিয় সহ-অভিনেতার নজর ফেরাতে পারলেন নিজের দিকে। পরে, মেগাস্টার অমিতাভ এখানেই প্রেস কনফারেন্স করতেন। এখান থেকেই তাঁর বাড়িতে বিরিয়ানি আর শিক কাবাব যায়, এখনও।
সত্যি বলতে, এই হোটেল ছিল দেব আনন্দের ‘সেকেন্ড হোম’; স্যুইট নং ২২৬, পার্মানেন্ট বুকড ছিল তাঁর, একটানা ১২ বছর। জিম-ম্যানিয়ায় মেতে ওঠার অনেক যুগ আগে, দেব আনন্দ ছিলেন প্রকৃতই স্বাস্থ্য-সচেতন। স্বাস্থ্যের জন্য পেশি বানাননি তিনি; আমৃত্যু ছিলেন চনমনে আর এনার্জি-ভরপুর। ‘সান এন স্যান্ড’ সাক্ষী, দেব আনন্দ কোনও দিন লিফট ব্যবহার করেননি; তিনতলার ঘরে উঠতেন, নামতেন, সিঁড়িতে স্প্রিন্ট করতে করতে, সবসময়।
রাজ কাপুরের মেয়ে, রিমার সংগীত সেরিমোনিতে ছিলেন এক্সক্লুসিভ অতিথিরা, মাত্র ৫০০ জন। এদিকে, কাপুর খানদান, যাঁদের সবকিছুই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’, তাঁদের ‘বেটি কি শাদি’, ইয়ার্কি নাকি! বিয়ের নেমন্তন্নে হাজির ২,৫০০ অতিথি। আ-ড়া-ই হা-জা-র! দায়িত্বে? ‘সান এন স্যান্ড’। চেম্বুরে, আর.কে. স্টুডিওর লনে, সে ছিল তুলকালাম পার্টি। মেনুতে, ১৫০টা পদ। বিকেল থেকে শুরু হয়ে, সারারাত পেরিয়ে, সবকিছু থামতে থামতে সকাল ৭টা। হোটেলের স্টাফেরা পরদিন যখন বেরোচ্ছেন, দরজায় দাঁড়িয়ে, তাঁদের অভিবাদন করেছিলেন কাপুর পরিবার– শাম্মি, শশী, রণধীর, ঋষি, রাজীব। এখানেই থামেনি সেটা। হোটেলের স্টাফদের জন্য, রাজ কাপুরের স্ত্রী, কৃষ্ণা নিজের হাতে চিঠি লিখেছিলেন, কৃতজ্ঞতায়। সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন সুবিশাল ফুলের তোড়া, অজস্র শ্যাম্পেন আর ব্ল্যাক লেবেল।
ঠিক যেমন সব চরিত্র কাল্পনিক নয়, তেমনই সব কাহিনি অতীত নয়। বম্বে থেকে মুম্বই হয়ে ওঠার মাঝে, এ শহরের চরিত্র মেনে, এই হোটেলও নিয়ত বদলেছে নিজেকে। জুহুর এই হর্ম্যে, হালের তারকারাও নিয়মিত যাতায়াত করেন।