দুই বোনের অক্লান্ত পরিশ্রম, একজন সামলাচ্ছেন কিচেন, যাতে ঠিক মাপে ইনগ্রেডিয়েন্টস মিক্স হয়, যাতে কোয়ালিটির এতটুকু হের-ফের না হয়, আর অন্যজন সামলাচ্ছেন ডিসট্রিবিউশন/ স্টোর সাপ্লাই। কারণ সব আইটেম নিশ্চিতভাবে হতে হবে ফ্রেশ, হট, ক্রিসপি, ইয়াম্মি! তবেই তো কনফেকশনারির মজা। কোনও বাসি জিনিস চলবে না। তাই ক্রমান্বয়ে চাহিদার মতো সাপ্লাই। ১৫০ স্কোয়ার ফিট থেকে এক এক করে ৩০০/৫০০/১০০০/ ২০০০ স্কোয়ারে ফিটের দোকান বেড়েই চলল। কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়, মলে কুকি জার ঝলমল করতে শুরু করল।
১৯.
ব্র্যান্ড বাজাল দুই বোন। দুই বোনের অসাধ্য সাধনের দৃঢ় সংকল্প আর নিরলস পরিশ্রমের ফসল এই জার ভর্তি কুকির পথ চলার গল্প বলব আজ।
১৯৮৫, আমাদের কোম্পানির বিজ্ঞাপনী কাজ মানুষের নজরে আসছে। এই সময় একদিন অল্পবয়স্ক দুই সুন্দরী বোন তাদের নতুন ব্যবসার প্রস্তাব নিয়ে হাজির। কনফেকশনারির ব্যবসা।
সেই সময় কলকাতায় এই ব্যবসায় রাজ করছে ফ্লুরিজ। আর বড়দিনে নিউ মার্কেটে নাহুম। ফ্লুরিজের পার্ক স্ট্রিটে অভিজাত লোকেশন, বহুদিনের সাহেবি ঐতিহ্য এবং সেই সময়ের গুণমানে এক নম্বর কনফেকশনারির সঙ্গে টক্কর দেওয়ার কেউ ছিল না তখন। কিন্তু এই দুই ফুটফুটে সুন্দর বোনদের অসম্ভব কনফিডেন্ট প্রস্তাবে চমকে গেলাম। ওরা সুইজারল্যান্ড থেকে স্পেশাল ট্রেনিং নিয়ে এসেছে, কলকাতার বেস্ট কনফেকশনার হিসেবে নিজেদের পরিচিত করতে। ফ্লুরিজ আছে, থাকবে। ওরাও থাকতে চায় কিন্তু এক নম্বরে। এটা ওদের চ্যালেঞ্জ!
ওই সময়টায় কলকাতার খুব বদনাম। কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, লোডশেডিংয়ের উৎপাত। কলকাতাকে বলা হত ‘মৃত শহর’। আর এই পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন ব্যবসার প্রস্তাব, তাও যদি ভুঁড়িঅলা মোটাসোটা বেওসাদার হত, বুঝতাম। এ তো দুই অল্পবয়স্ক পাঞ্জাবি কন্যা। শিক্ষিত, মার্জিত, রুচিশীল, চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। আর্থিক প্রসঙ্গ আসতেই পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিল যে, খুবই সীমিত বাজেটে কাজ করতে হবে। যদিও লড়াইটা হবে অতি বিখ্যাত ফ্লুরিজের সঙ্গে। নির্দ্বিধায় জানিয়ে দিল যে, সেই কারণেই ওরা আমাদের কাছে এসেছে, ক্রিয়েটিভ আইডিয়া দিয়ে বাজিমাত করতে– বড় বড় বহুমূল্যের বিজ্ঞাপন দিয়ে নয়।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন। বিশ্বজিৎ রায়ের ‘ছাতিমতলা’ : রবীন্দ্রনাথ কি ক্রিয়েটিভ রাইটিং শেখানোর কিংবা কপি এডিটিং করার চাকরি পেতেন?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সে তো আমাদের কাছেও চ্যালেঞ্জ। আর ওই চ্যালেঞ্জ নিতে আমরা, বিজ্ঞাপন কারিগররা সর্বদা উন্মুখ হয়ে থাকি। অর্ধমৃত কলকাতায় একটা নতুন ব্র্যান্ড যদি তৈরি করা যায়, তাও আবার দুই দৃপ্ত বিশ্বাসী বোনের হাত ধরে, মন্দ কী! অন্তত একটা নতুন হাওয়া তো বইবে।
ব্র্যান্ডের নাম ঠিক হল কুকি জার। লোগো তৈরি হল সঙ্গে প্যাকেজিং, মানে বাক্স। বাক্সের ডিজাইনটা খুব ভেবেচিন্তে তৈরি হল। যেহেতু স্বপ্ন ছিল কুকি জার কলকাতার একটা আইকনিক ব্র্যান্ড হবে তাই বাক্সের ডিজাইনে কলকাতার আইকনিক স্থানগুলোর ছবি উঠে এলো। এবং কুকি জার-ও কলকাতা একাত্ম্য হয়ে গেল। মধ্য কলকাতার রডন স্ট্রিটে একটা দেড়শো স্কোয়ারে ফিটের ছোট্ট স্পেসে কুকি জারের যাত্রা শুরু। লোকেশনটা খুব স্ট্র্যাটেজিক ছিল। একটু এগিয়ে গেলেই দু’দুটো স্কুল। একদিকে লা মার্টিনিয়ার ফর গার্লস আর উল্টোদিকে লা মার্টিনিয়ার ফর বয়েজ। অর্থাৎ স্কুল ভাঙলেই ছাত্রছাত্রীরা ভিড় করতে শুরু করল। গরম প্যাটিস, নতুন রকমের সুইস পেস্ট্রি, আরও কত কী, ফ্লুরিজের একঘেয়েমি আইটেম থেকে মুক্তির স্বাদ। ভিড় বাড়ছে। ইংরেজি খবরের কাগজের পাতায় ছোট্ট বিজ্ঞাপন বেরল ‘Our nearest competiton is in Switzerland.’ আর সত্যিই তাই। এ স্বাদের ভাগ হবে না।
দুই বোনের অক্লান্ত পরিশ্রম, একজন সামলাচ্ছেন কিচেন, যাতে ঠিক মাপে ইনগ্রেডিয়েন্টস মিক্স হয়, যাতে কোয়ালিটির এতটুকু হের-ফের না হয়, আর অন্যজন সামলাচ্ছেন ডিসট্রিবিউশন/ স্টোর সাপ্লাই। কারণ সব আইটেম নিশ্চিতভাবে হতে হবে ফ্রেশ, হট, ক্রিসপি, ইয়াম্মি! তবেই তো কনফেকশনারির মজা। কোনও বাসি জিনিস চলবে না। তাই ক্রমান্বয়ে চাহিদার মতো সাপ্লাই। ১৫০ স্কোয়ার ফিট থেকে এক এক করে ৩০০/৫০০/১০০০/ ২০০০ স্কোয়ারে ফিটের দোকান বেড়েই চলল। কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়, মলে কুকি জার ঝলমল করতে শুরু করল। যোধপুর পার্কের ছোট্ট ফ্যাক্টরি থেকে কসবা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের চারতলা জুড়ে অত্যন্ত আধুনিক,হাইজিনিক, স্টেট ফর দ্য আর্ট ফ্যাক্টরিতে কর্মযজ্ঞ চলতে লাগল। কলকাতার সমস্ত বিজনেস টাইকুনদের এবং অভিজাত বাড়ির পার্টি বা উৎসবের মেনু তে কুকি জার নিশ্চিত স্থান করে নিল।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন। শ্রীজাত-র শীর্ষেন্দু-পাঠ: আবছায়া রহস্যময় প্রীতিসম্পন্ন যে গঞ্জের রং আর গন্ধ পুষে রাখি, তার কৃতিত্ব শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়েরই
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আমাদের কোম্পানির সৃষ্ট ছোট ছোট নজরকাড়া বিজ্ঞাপন বড় বড় বিজ্ঞাপন কোম্পানির অভিনন্দন কুড়তে শুরু করল। এত ছোট বিজ্ঞাপনেও এত জোশ? নজর এড়ানোর উপায় নেই! কলকাতার বাইরে থেকে আসা মানুষ ফ্লাইট ধরার আগে কুকি জার হয়ে এয়ারপোর্ট যেত, এখনও যায়। পপুলারিটির উচ্চ শিখরে উঠে দুই বোনের মন্ত্র হয়ে দাঁড়াল ‘No compromise in quality & fast,fresh distribution’. মুম্বতে এক বিখ্যাত খবরের কাগজের ‘150th Anniversary Celebration Dinner-এ কুকি জারের ডেজার্ট করা হল, স্পেশাল ফ্লাইটে কলকাতা থেকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে। ভাবা যায়? কী ব্র্যান্ড ইমেজ! কী ব্র্যান্ড সাক্সেস!
দেখতে দেখতে কুকি জার কলকাতার কনফেকশনারি জগতের আইকন হয়ে গেল। ফ্লুরিজ ছিল, থাকলও পার্ক স্ট্রিটের এককোণে। এই দুই বোনের সাকসেস স্টোরি নানা পত্রপত্রিকায় পড়ে অনেক মেয়েরা এই বিজনেসে এগিয়ে এল। এবং দেখা গেল তারাও বাড়ি থেকে ব্যবসা করে বেশ সাকসেসফুল হয়েছে। ২০১৫ সালে কুকি জারের ত্রিশতম বছর সেলিব্রেট করে। সেইসময় মাল্টিমিডিয়া ক্যাম্পেইনের সঙ্গে বাক্সের ডিজাইনটাও পাল্টানোর কথা ভাবা হয়। অজস্র নতুন ডিজাইনও করা হয়। কিন্তু কোনওটাই ধোপে টিকলো না।
অবশেষে, একটা কাস্টমার সার্ভে করা হল। জনমত সেই এককথায় বলল, কুকি জার ব্র্যান্ডটা যেমন আইকন– এই বাক্স টাও তাই। আজ ৩৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে কুকি জারের অপরিবর্তিত কোয়ালিটি, গ্যালপিং সাকসেস, আটের দশকের ‘ডেড সিটি’ কলকাতার বুকে বসে দুর্জয় সাহস এবং এক নম্বর ব্র্যান্ড হওয়ার কৃতিত্বকে সঙ্গী করে আমাদের আলোচ্য দুই বোন লাভি আর পূজা নারীশক্তির জয়যাত্রাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করল।
৩৮টা বছর ধরে একই স্বাদে, একই চরিত্রে, একই রূপে, একই অঙ্গসজ্জায় এগিয়ে চলেছে কলকাতার আইকনিক কনফেকশনারি ব্র্যান্ড কুকি জার। এই কলকাতাবাসীর রাজনৈতিক, আর্থিক, সামাজিক জীবনে কত পরিবর্তন এসেছে, পরিবর্তনের পরিবর্তন এসেছে কিন্তু কুকি জারকে কিছুই ছুঁতে পারেনি। সে অপরিবর্তনীয়। একমেবদ্বিতীয়ম।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ব্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৮: কথাবার্তা নেই, স্রেফ গন্ধই খাবারের বিজ্ঞাপন
ব্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৭: বাড়িতে আগুন লাগলে আপনি কি চকোলেট খাবেন?
ব্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৬: বিজ্ঞাপনের গোলকধাঁধায় চিকিৎসাও পণ্য!
ব্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৫: বাঘ-ছাগলকে একঘাটে জল খাওয়াতে পারে যে চা
ব্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৪: বিষ বিক্রি করে মিলিয়ান ডলারের মালিক!
ব্যান্ড বাজাও। পর্ব ১৩: বুকের দুধের বাজার গরম, ৩০০ মিলিলিটার ৪৫০০ টাকা!
ব্যান্ড বাজাও। পর্ব ১২: গেরুয়া লুঙ্গির কাছে গোহারান হেরেছে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি
ব্যান্ড বাজাও। পর্ব ১১: ধর্মতলার সেই ভিক্ষুক যে বিজ্ঞাপনের কড়া স্ট্রাটেজিস্ট
ব্যান্ড বাজাও। পর্ব ১০: ‘টাটকা’ সবজি ‘জ্যান্ত’ বললে বিক্রি বাড়ে, এটাও বিজ্ঞাপন
ব্যান্ড বাজাও। পর্ব ৯: সে যাত্রায় বন্দুকের নল থেকে রক্ষা করেছিলেন সুনীল গাভাসকর
ব্যান্ড বাজাও। পর্ব ৮: যে কোম্পানির নামে আস্ত একটা নগরী!
ব্যান্ড বাজাও। পর্ব ৭: এক সামান্য নাপিতের উদ্যোগ ও চেষ্টা
ব্যান্ড বাজাও। পর্ব ৬: মহাকাশচারীদের জন্য বানানো টুথপেস্টে এখন শিশু ও পোষ্যদের দাঁত মাজানো হয়
ব্যান্ড বাজাও। পর্ব ৫: একখানা লিপস্টিক প্রায় দেড় কোটি টাকা!
ব্যান্ড বাজাও। পর্ব ৪: ইস চাম্পি মে বড়ে বড়ে গুণ
ব্যান্ড বাজাও। পর্ব ৩: ‘ওরে ব্লোরীন লাগা’
ব্যান্ড বাজাও। পর্ব ২: বাংলাভাষায় প্রথম সার্থক বুদ্ধিদীপ্ত বিজ্ঞাপন, রবীন্দ্রনাথও দিয়েছিলেন শংসাপত্র
ব্যান্ড বাজাও। পর্ব ১: ৫০০০ বছর আগেই ছিল ব্র্যান্ডিংয়ের ধারণা!
পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কথা বলতে বলতে তাঁর অশ্রুসজল চোখ দেখে শুধু সেই সময় নির্বাক হয়েছিলাম তা’ নয়, আজও তাঁর সেই চোখ দেখতে পাই, শুনতে পাই মানুষের প্রতি মানুষের বর্বরোচিত অত্যাচারের সেই গল্প বলতে বলতে তাঁর রুদ্ধ কণ্ঠস্বর।