পাগলকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলেও পাগলিকে জরিপ করে নেওয়ার লোভ একটা বয়সে তুঙ্গে পৌঁছয়। অথচ একেবারে ছোটবেলায় এই সমস্যা ছিল না।
পাগল আর পাগলির মধ্যে যে তফাত, সেটা পুরুষ আর নারীর তফাতের মতোই হওয়া উচিত ছিল শাস্ত্রমতে। কিন্তু তাঁদের মনের অবস্থান তথাকথিত ‘নর্মাল’ মানুষের বিপ্রতীপে। তাই আমার দেখার চোখ যে কখন সহানুভূতি থেকে অজ্ঞানতার দিকে ঘুরে গিয়েছে, বুঝতেও পারিনি। পাগলকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলেও পাগলিকে জরিপ করে নেওয়ার লোভ একটা বয়সে তুঙ্গে পৌঁছয়। অথচ একেবারে ছোটবেলায় এই সমস্যা ছিল না। আমার জ্ঞান হওয়া ইস্তক আমার দিদাকে বদ্ধ উন্মাদ অবস্থায় দেখেছি। অবিশ্যি শৈশবে উন্মাদ ও ‘নর্মাল’-এর কোনও সংজ্ঞা জানা ছিল না। জানলেও বোঝার উপায় ছিল না, কারণ তখনও বর্ণ পরিচয় হয়নি। উত্তর কলকাতার যে বাড়িতে মা-বাবা-দাদার সঙ্গে ভাড়া থাকতাম, সেই বাড়িরই সামনের অংশে আমার অকৃতদার মামা, দিদাকে নিয়ে থাকতেন। কে পাগল আর কে ছাগল– বোঝার জন্য বড়দের জ্ঞান ভরসা। কিন্তু যে শিশুর বোধই নেই, তাকে কে জ্ঞান দেবে? তাই দিদাকে নিয়ে বাড়ির সবাই এবং প্রতিবেশীরা যারপরনাই দুশ্চিন্তা করলেও আমার কোনও অসুবিধে হয়নি। পরে জেনেছিলাম আমার জন্মের সময় তাঁর পাগলামির বয়স ছিল প্রায় ৩০ বছর।
ছোটবেলায় আমার ভালই লাগত দিদাকে। কারণ উনি আমায় আগলে রাখতেন সারাক্ষণ। যেমনভাবে আগলে রাখতেন বয়াম ভর্তি পচে যাওয়া লেবুর আচার, উঠোনে লম্বা করে সাজিয়ে রাখা পুরনো খবরের কাগজের ওপর তেঁতুলের ছড়া, যা থেকে আচার হয়ে একটি নতুন বয়ামে ভর্তি হবে এবং তারপর দিদার খাটের নিচে আশ্রয় পাবে, পচে যাওয়ার জন্য। সেই আচার দিদা নিজেও কোনও দিন খেয়েছেন কি না সন্দেহ। তিনি কোনওরকমে একটি শাড়ি জড়িয়ে অথবা একটি পুরনো, ছেঁড়া সেমিজ পরে হাতে লাঠি নিয়ে ওই তেঁতুল, আচার পাহারা দিতেন। পাড়ার ছেলেরা স্কুল ছুটির দুপুরবেলায় দিদাকে বুড়ি ছুঁয়ে তেঁতুল চুরি করার চেষ্টা করত, মূলত বিচিগুলো হাত করার জন্য। আর উনি লাঠি নিয়ে তেড়ে যেতেন। আমার কাছাকাছি কেউ এলে তাকেও তাড়া করতেন। বলতেন, আমার গায়ে নাকি নোংরা লেগে যাবে, আমি কালো হয়ে যাব। অথচ উনি নিজেই আদৌ স্নান করতেন কি না বুঝতে পারতাম না। চুলে জট। সেখান থেকে উকুন এসে আমার মাথাতেও বাসা বেঁধেছিল, মনে আছে। আমাদের দু’জনের মাথায় তখন পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট, কালার পার্পল। ঠিক কবে জানতে পারলাম যে দিদা ঠিক আমাদের মতো নন, সেটা মনে নেই। তবে প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার সময় থেকে ওঁর সঙ্গে আমার দূরত্ব বাড়তে আরম্ভ করে। বড় রাস্তা পেরতে শেখার পর দিদা আমাকেও ভুলে গেলেন। যে সময় ওঁর দেহান্তর, আমি সমবয়সি সদ্য টিনএজার বন্ধুদের সঙ্গে রাস্তায় বেরিয়ে পাগল আর পাগলির মনস্তত্ত্ব বিচার করতে শিখে গিয়েছি। আলটপকা মন্তব্য করার জন্য নির্দ্বিধায় মুখের আগল খুলছি। পাগল দেখলে বজায় রাখছি নিরাপদ দূরত্ব আর আড়চোখে দেখে নিচ্ছি পাগলির বুক, একঝলক। এমনকী, পাড়ার এক বন্ধুর মা, যিনি ক্রমবর্ধমান মানসিক অস্থিরতার মধ্যেও অফিস যেতেন রোজ সকালে আর সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে তুমুল চিৎকার, কান্নাকাটির পর এবাড়ি-ওবাড়ি হাজির হতেন শুধু এইটুকু জানানোর জন্য যে, তাঁর ছেলেরা আসলে পূর্বজন্মে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ছিলেন, তাঁকে নিয়েও হাসাহাসি করেছি পাড়ার রকে, তাঁরই ছেলেদের সঙ্গে। তখন মনে পড়েনি আমার দিদাও পাগলি ছিলেন। হয়তো অবচেতনে কাজ করেছে দিদাকে খ্যাপানোর দৃশ্যগুলো। হয়তো প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম নিজের অজান্তেই। এইসব কথা ভিড় করে এল কিছুদিন আগে, বাইপাস টপকে সল্টলেকে ঢোকার মুখে একটি পাঁচতারা হোটেলের সামনে। এক নারী। সম্পূর্ণ বিবস্ত্র। উসকোখুসকো চুল। শাড়ি মাটিতে লুটোচ্ছে। ঠোঁটের কোণ দিয়ে কষ গড়াচ্ছে। বিড়বিড় করে কিছু বলে চলেছেন। হয়তো অভিশাপ দিচ্ছেন দ্রৌপদীর মতো। গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ওঁকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কেন জানি না নিজেকে দুঃশাসন মনে হল।