কান সবই টানবে, মগজ ফিল্টার করবে, যাতে তা মুখ অবধি না আসে, অন্তত বড়দের সামনে নয়। এভাবে বেড়ে ওঠা যে কী কঠিন! নিজের মনে অসভ্য কথা আওড়াতে ক্ষতি নেই, বন্ধুদের সামনেও চলতে পারে কিন্তু স্থান-কাল-পাত্র বুঝে জিহ্বা সামলাতে হবে।
খিস্তি দেয় বস্তির ছেলেমেয়েরা। আমাদের খিস্তি দিতে নেই। ‘খিস্তি’ শব্দটা উচ্চারণ করাও বারণ। বলতে হবে ‘অসভ্য কথা’। সব অসভ্য কথা কিন্তু খিস্তি নয়, কিন্তু সব খিস্তিই অসভ্য কথা, তা বলাই বাহুল্য। অর্থাৎ, যে-শব্দগুলো ভদ্রবাড়িতে ‘ব্যবহার উপযোগী নয়’ বলে বড়রা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁদের সাধারণ খিস্তির সঙ্গে যোগ করে, একটি অলাতচক্র সৃষ্টি করে ছোটদের শাসনে রাখা। এদিকে বাড়ি থেকে পা বাড়ালেই বস্তি। এদিক-ওদিক থেকে বিভিন্ন দু’-অক্ষর, চার-অক্ষর ভেসে আসে টুকটাক। কানে তো আর অত্যাধুনিক ফিল্টার লাগানো যায় না, যা কেবল সুশব্দগুলোকে ভেতরে টেনে নেবে। কান সবই টানবে, মগজ ফিল্টার করবে যাতে তা মুখ অবধি না আসে, অন্তত বড়দের সামনে নয়। এভাবে বেড়ে ওঠা যে কী কঠিন! নিজের মনে অসভ্য কথা আওড়াতে ক্ষতি নেই, বন্ধুদের সামনেও চলতে পারে, কিন্তু স্থান-কাল-পাত্র বুঝে জিহ্বা সামলাতে হবে। তার ওপর সমস্যা হল নতুন কোনও শব্দ কানে এলে তা অসভ্য কি না, বোঝার জন্য কোনও রেফারেন্স বই নেই। বড়রাও ধরতাই দেবেন না। ক্লাস ফোরে যখন, বাড়িতে সকলের সামনে, দাদা জোর করে কোলে তুলে নিতে বলে ফেললাম, ‘থোবড়া বিলা করে দেব’। কী করে জানব যে ‘থোবড়া’, ‘বিলা’ ইত্যাদি অসভ্য কথা? তারপর কয়েক ঘণ্টা যে আলোড়ন হল, তার ফলে বড় রাস্তায় খেলতে যাওয়া, পাড়ার রকের আশপাশে ঘুরঘুর করা ইত্যাদি বন্ধ হল। তবে মজার ব্যাপার হল, যেখান থেকে এই শব্দগুলি শিখেছি, সেই স্কুলে যাওয়া নিয়ে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি হল না।
প্রথম খিস্তি দিই ক্লাস নাইনে। গুড বয়, ফার্স্ট বেঞ্চে বসি। সেটাই নিয়ম। মজার কথা এই যে, ক্লাসের সবচেয়ে দামাল যে ছেলেটি, যে সারাক্ষণ একে-তাকে অসভ্য কথা বলে, ক্লাস কেটে সিনেমা যায়, বিড়ি খায়, সে-ই পরীক্ষায় প্রথম হয়। এ তো আমার কাছে এক পরম বিস্ময়! সে আর তার সাঙ্গপাঙ্গ একদিন আমার বেঞ্চের সামনে দাঁড়াল। একজন আমাকে নির্দেশ দিল আমার পাশে বসা অন্য গুড বয়কে একটি চার-অক্ষর বলতে, না হলে মেরে মুখ ফাটিয়ে দেবে। মারের ভয় কে না পায়, তার ওপর আমার বছরভর আমাশা। আমি বন্ধুর চোখের দিকে তাকিয়ে দেগে দিলাম। সবাই চড়বড়িয়ে হাততালি দিল। এবার ওই বন্ধুকে বলা হল, আমার মুখের দিকে তাক করে অন্য একটি চার-অক্ষর লঞ্চ করতে। আবার হাততালি। আমাদের চোখমুখ লাল। ঘাবড়ে গিয়ে কোলাকুলি করে ফেললাম। সেই যে খিস্তি বের হতে আরম্ভ করল মুখ থেকে, আর থামে না। কলেজে ভর্তি হয়ে দেখি, প্রায় সব ছেলেই অসভ্য কথা ব্যবহার করছে। ধরে নিয়েছিলাম মেয়েরা এইসব শব্দ ব্যবহার করে না। এই ভুল ভাঙাতে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত যেতে হয়েছিল।
খিস্তি দেওয়া শুরু করলে জীবন আমূল বদলে যায়। বিশেষ করে আমার মতো একজন মানুষের, যাকে ছোটবেলা থেকে ‘মানুষ’ করার চেষ্টা হয়েছে। কলেজে সারাদিন খিস্তি দেওয়ার পর বাড়িতে অন্য ভাষায় কথা বলা খুব কঠিন। হঠাৎ যদি মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়, এই ভয়ে কথা কম বলি। পরিবারের লোকজন ভাবেন ছেলে বড় হচ্ছে, তাই একটু দূরত্ব রাখাই ভাল। মাঝে মাঝে অবিশ্যি একটু খচখচ করে, তখন হলিউডি সিনেমা দেখতে যাই। মন ভাল হয়ে যায়। আমেরিকার ভিয়েতনাম অভিযান নিয়ে একটি প্রোপাগান্ডা মার্কা সিনেমায় তো বুলেটের চেয়ে খিস্তি বেশি ছিল। আমেরিকান সৈনিক যখন গুলি খেয়ে মরতে চলেছে তখন সে মা-বোন জড়ানো খিস্তি দিচ্ছে, আবার কোনও ভিয়েতনামির চাঁদি ফুটো করে দেওয়ার আগেও ওই একই অসভ্য কথা। ভিয়েতনামিরা কোনও খিস্তি দিতেন কি না, সেটা জানানোর দায় ডিরেক্টর সাহেবের ওপর বর্তায়নি।
কয়েক দিন আগে সেক্টর ফাইভের রাস্তার চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে আছি এক সহকর্মীর সঙ্গে। পাশ দিয়ে ঝড়ের গতিতে এক যুবতী চলে গেলেন। কানে মোবাইল। মুখ থেকে তুবড়ির মতো বাংলা, হিন্দি, ইংরাজি খিস্তির নিঃসরণ। আমরা দু’জনেই প্রথমে একটু চমকে উঠলাম, তারপর ফোনের ওপারে যিনি আছেন, তাঁর কথা ভেবে হো হো করে হেসে উঠলাম।