ধর্মব্যাধ কোথায় আছেন খোঁজ করতে করতে তিনি গিয়ে পৌঁছালেন এক কসাইখানায়। দেখলেন এক তপস্বী মাংস বিক্রয়রত। ব্রাহ্মণকে দেখে তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠে এলেন। বললেন, ‘আপনার কী সেবা করতে পারি আদেশ করুন। আমি জানি যে পতিব্রতা এক রমণী আপনাকে এখানে আসতে বলেছেন। কী কারণে আপনি এখানে এসেছেন, তাও আমি জানি।’ ব্রাহ্মণ একথা শুনে বিস্মিত। ভাবলেন, এ তো দ্বিতীয় আশ্চর্য!
অনেককাল আগের কথা। কৌশিক নামে বেদাধ্যায়ী, তপোধন, ও ধর্মশীল এক ব্রাহ্মণ একদিন এক গাছের তলায় বসে বেদ অধ্যয়ন করছিলেন। গাছের উপরে বসে তখন এক বকপক্ষিণী। হঠাৎই সে বিষ্ঠা ত্যাগ করল, আর তা পড়ল গিয়ে ব্রাহ্মণ কৌশিকের মাথায়! কৌশিক তপস্বী। তাঁর তপোবলের এমনই প্রভাব যে, ক্রোধান্বিত হয়ে সে এই বকের মৃত্যুচিন্তা করে তাঁর দিকে দৃষ্টিপাত করা মাত্রই বকপক্ষিণী মাটিতে পড়ল। তাকে প্রাণহীন অবস্থায় দেখে তিনি খুব কষ্ট পেলেন।
সেখান থেকে কিছু পরে তাকে ভিক্ষার জন্য এক গ্রামে যেতে হল। গ্রামে গিয়ে একটি বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষে চাইলেন। বাড়ির গৃহিণী তাঁকে অপেক্ষা করতে বলে ভিক্ষাদানের পাত্র পরিষ্কার করতে লাগলেন। এমন সময় তাঁর স্বামী ক্ষুধার্ত হয়ে এসে উপস্থিত। গৃহিণী পতিকে এ অবস্থায় দেখে তাঁর সেবায় লাগলেন। এই সদাচারসম্পন্না গৃহিণী সবসময়েই দেবতা, অতিথি, ভৃত্য ও অন্যান্যদের সেবা করতেন। এদিকে সেই ব্রাহ্মণ অপেক্ষারত।
গৃহিণীর স্মরণে এল একথা। তিনি ব্রাহ্মণের জন্য ভিক্ষা নিয়ে বেরিয়ে এলেন। ব্রাহ্মণ রেগে আগুন! গৃহিণীকে বললেন, ‘আপনি আমায় দাঁড়ান বলে থামালেন, কিন্তু বিদায় দিলেন না।’ গৃহিণী বিনীতভাবে ক্ষমা চেয়ে বললেন যে, পতি তাঁর কাছে প্রধান দেবতা। তিনি ক্ষুধার্ত ও শ্রান্ত হয়ে উপস্থিত। তাই তিনি পতি সেবাতেই রত ছিলেন। ব্রাহ্মণ সেবার পরিবর্তে পতিসেবা করার জন্য কৌশিক গৃহিণীকে তিরস্কার করলেন। গৃহিণী ক্ষমা ভিক্ষা করলেন। আর সেইসঙ্গে এ-ও জানালেন যে, পতিসেবার ধর্মই তাঁর কাছে প্রিয়। এই পতিসেবার ফলও তিনি পেয়েছেন। ব্রাহ্মণ কৌশিক ক্রোধান্বিত হয়ে বকপক্ষিণী দগ্ধ করেছেন এই ঘটনা তিনি জানেন । সাহসী এই রমণী কৌশিককে বললেন যে, ধর্ম বহুবিধ হলেও সূক্ষ্ম। কৌশিক ধর্মজ্ঞ, বেদপাঠনিরত, পবিত্র হতে পারেন, কিন্তু তাঁর অভিমত যে, কৌশিক যথার্থ ধর্ম জানেন না। যথার্থ ধর্ম জানতে হলে মিথিলাপুরীতে ধর্মব্যাধের কাছে গিয়ে জানতে হবে।
ব্রাহ্মণ কৌশিক কৌতূহলী হয়ে বহু অরণ্য, গ্রাম ও নগর অতিক্রম করে মিথিলায় উপস্থিত হলেন। ধর্মব্যাধ কোথায় আছেন খোঁজ করতে করতে তিনি গিয়ে পৌঁছালেন এক কসাইখানায়। দেখলেন এক তপস্বী মাংস বিক্রয়রত। ব্রাহ্মণকে দেখে তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠে এলেন। বললেন, ‘আপনার কী সেবা করতে পারি আদেশ করুন। আমি জানি যে পতিব্রতা এক রমণী আপনাকে এখানে আসতে বলেছেন। কী কারণে আপনি এখানে এসেছেন, তাও আমি জানি।’ ব্রাহ্মণ একথা শুনে বিস্মিত। ভাবলেন, এ তো দ্বিতীয় আশ্চর্য!
ব্যাধ ব্রাহ্মণকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে যথোচিত সম্মানে তাঁর সেবা করলেন। ব্রাহ্মণ ব্যাধকে বললেন যে, তার কর্ম খুবই নিষ্ঠুর। ব্যাধ জানালেন– এ তার কুলধর্ম। স্বধর্মে থেকে তিনি যথাশক্তি তাঁর কর্তব্য পালন করেন, আর গুরু ও পিতামাতার সেবা করেন। তিনি সত্য বলেন, ঈর্ষা করেন না, যথাশক্তি দান করেন এবং দেবতা, অতিথি ও ভৃত্যদের ভোজনাবশিষ্ট দ্বারা জীবন ধারণ করেন। ব্যাধ বললেন যে, যজ্ঞ, দান, তপস্যা, বেদপাঠ, সত্যব্যবহার, গুরুসেবা, ক্রোধ ত্যাগ এগুলি শিষ্টাচারের মধ্যে গণ্য। ধর্মব্যাধের সঙ্গে ব্রাহ্মণের বিবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। ব্রাহ্মণের প্রশ্নের উত্তরে ব্যাধ যা বলেছিলেন, তার সবই রয়েছে মহাভারতে। এই অংশ ‘ব্যাধগীতা’ নামে পরিচিত।
ব্যাধের কাছে বিবিধ বিষয়ে আলোচনা শুনে ব্রাহ্মণ অবাক হয়ে তাঁকে বললেন যে, ধর্মবিষয়ে যে তাঁর কিছুই অবিদিত নেই। ব্যাধ বললেন, বাড়িতে বৃদ্ধপিতামাতাই তার মহান দেবতা। দেবতার সেবার জন্য যা করা উচিত, তিনি পিতামাতার জন্য তাই করেন। জন্মগত কর্মে তিনি মাংসের ব্যবসা করেন বটে, কিন্তু তিনি অনাসক্তভাবে তার কর্মগুলি করেন। আর গৃহে যথাসাধ্য তাঁর পিতামাতার সেবা তো রয়েছেই। সেই থেকেই তাঁর দিব্যজ্ঞান লাভ হয়েছে। আর এই তপস্যার বলে তিনি ব্রাহ্মণ কৌশিকের তাঁর কাছে আসার আগের সব ঘটনা জানতে পেরেছেন।
ধর্মের অনেক সূক্ষ্ম দিক রয়েছে। ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছে শিষ্টাচার। ব্যাধ এবং পতিব্রতা রমণী– উভয়েই নিজ নিজ স্থানে আন্তরিকভাবে আনন্দের সঙ্গে তাঁদের কর্তব্য পালন করেছেন। আর তা থেকেই উভয়েরই অন্তরে প্রকৃত জ্ঞানের স্ফুরণ হয়েছে। বিবেকানন্দ ‘ব্যাধগীতা’-র এই কাহিনি উল্লেখ করে বলেছেন যে, কর্তব্য গৃহস্থ বা সন্ন্যাস যে কোনও আশ্রমেরই হোক না কেন, যথার্থ অনাসক্তভাবে করতে পারলে তাই চরম অনুভূতি নিয়ে আসে।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved