খবর পাওয়া গেল, প্রধানমন্ত্রী এসে গিয়েছেন, বাইরে প্রদীপ জ্বালিয়ে এসে ঢুকলেন স্টুডিও ফ্লোরে। নিজের চোখকে তখন বিশ্বাস করতে পারছি না, আমার সামনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। যেমন সৌম্যদর্শন তেমনই বিনয়ী, আমাদের সামনে এসে নমস্কার করলেন, আমরাও প্রতিনমস্কার করলাম। একে একে এলেন আরও বিশিষ্টজন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অজিত পাঁজা– এমন আরও অনেকে।
১২.
১ জুলাই, ১৯৮৬। উদ্বোধন হবে দূরদর্শন ভবনের। পুরনো বাড়ি ছেড়ে আমরা এলাম নতুন বাড়িতে। মনের মধ্যে জড়িয়ে রইল ১১ বছরের কত না স্মৃতি! ছোট বাসস্থান থেকে বড় বাসস্থানে গেলে যে ঔৎফুল্ল হয়, আমার দশা তাই। এত বড় স্টুডিও, তাও একটা নয় দুটো। স্টিুডিও-‘এ’-র আয়তন দেখে তো বিস্ময়ের অবধি নেই, শুনলাম এটিই এশিয়ার লারজেস্ট স্টুডিও। যদিও আমাদের সম্প্রচার হবে স্টুডিও ‘বি’ থেকে, এলাহি কাণ্ড সেখানে, প্রস্তুতির শেষ পর্ব চলছে, দেশের প্রধানমন্ত্রী এসে বসবেন, সে কী কম কথা !
মেকআপ রুমে গিয়ে তাক লেগে গেল। এত দিন মেকআপ করেছি এক চিলতে করিডরের মধ্যে, আবার সেটাই ছিল বাথরুম যাওয়ার প্যাসেজ। আর এখানে দেখছি বড় বড় দুটো মেকআপ রুম, তার মাঝখানে প্রশস্ত জায়গা, সব ঘরেই দেওয়াল জোড়া আয়না। মেকআপ রুমে তখন রুমা গুহ ঠাকুরতা, শ্রমণা ও ক্যালকাটা ইউথ কয়ারের শিল্পীরা রয়েছেন– ওঁরাই উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করবেন, যেমন করেছিলেন ১৯৭৫-এর ৯ অগাস্ট। এঁদেরই মাঝে জায়গা করে নিয়ে আয়নার সামনে বসি, পঞ্চুদা মেকআপ করে দেন, লাল পাড় সাদা ঢাকাই পরে গিয়েছিলাম বাড়ি থেকে, তার সঙ্গে মানানসই ছোটখাটো গয়না পরি, চুল বাঁধি (এখানে বলে রাখা ভালো যে, আমাদের কোনও দিন কোনও হেয়ার ড্রেসার ছিল না), সাদা ফুল লাগাই, তারপর প্রথমবারের মতো গিয়ে দাঁড়াই নতুন স্টুডিওর নতুন ফ্লোরে। দিল্লি থেকে এসেছিল একটি মেয়ে, হিন্দি ঘোষণা করার জন্য, ভারী মিষ্টি দেখতে, সেজেছেও সুন্দর হালকা সাজে, সে-ও এসে আমার পাশে দাঁড়ায়। ওর নামটা আজ আর মনে নেই। ফ্লোর ম্যানেজার নির্দিষ্ট করে দিলেন কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা ঘোষণা করব। আমাদের সামনে কিছুটা বাঁদিক ঘেঁষে পাশাপাশি চেয়ার সাজানো রয়েছে।
খবর পাওয়া গেল, প্রধানমন্ত্রী এসে গিয়েছেন, বাইরে প্রদীপ জ্বালিয়ে এসে ঢুকলেন স্টুডিও ফ্লোরে। নিজের চোখকে তখন বিশ্বাস করতে পারছি না, আমার সামনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। যেমন সৌম্যদর্শন তেমনই বিনয়ী, আমাদের সামনে এসে নমস্কার করলেন, আমরাও প্রতিনমস্কার করলাম। একে একে এলেন আরও বিশিষ্টজন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অজিত পাঁজা– এমন আরও অনেকে।
ওঁরা আসন গ্রহণ করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই শুরু হল রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার, প্রথমে বাংলায় ঘোষণা, তারপর হিন্দিতে। আমাদের বলা শেষ হতেই শুরু হল ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়ার’-এর গান। পরে, ছবিতে দেখেছি, যতক্ষণ ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কথা বলেছি ততক্ষণ সেই সুদর্শন মানুষটি, দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্মিত হাসি নিয়ে আমাদের দিকেই চেয়ে ছিলেন। দূরদর্শন আমাকে যেসব অসাধারণ মুহূর্ত উপহার দিয়েছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। আমাদের স্টুডিও থেকে সম্প্রচারের পর রবীন্দ্র সদন থেকে সরাসরি সম্প্রচার শুরু হল, সেখানে ঘোষনায় ছিল শাশ্বতী, অনুষ্ঠান ছিল মমতাশঙ্কর ব্যালে ট্রুপের পরিবেশনায় চন্ডালিকা নৃত্যনাট্য।
নতুন বাড়িতে নতুন ভাবে শুরু করলাম আমরা। তিনতলায় প্রেজেন্টেশন সেকশনের ঘর। সকালের মিটিং এর পর সে ঘরে বসতাম। সে সময় সেকশন ইনচার্জ ছিলেন সম্ভবত: অমলেন্দু সিনহা, তারপর তপন রায় প্রধান, আরও অনেক পরে অভিজিৎ সরকার।
এ বাড়িতে এসে আমাদের নতুন প্রাপ্তি এক্কেবারে নিজস্ব একটি ঘর। যে বিরাট স্টুডিওর কথা বলেছিলাম সেই স্টুডিও ‘এ’-র লাগোয়া একটি ঘর। ইঞ্জিনিয়ারিং-ইন-চার্জের সম্মতিতে এটি আমাদের দেওয়া হয় কারণ স্টুডিও চত্বর ইঞ্জিনিয়ারিং দপ্তরের অধীনে। তবে এ-ও জানি, শিপ্রাদি (শিপ্রা রায়)র তৎপরতায় আমাদের ঠান্ডা ঘরে বসার ব্যবস্থা সম্ভব হয়েছিল। যেমন ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন আগের বাড়িতেও লাইব্রেরি রুমে, ঠান্ডায় বসতে পারি যাতে। যদিও যত দিনে আমি আর শাশ্বতী নতুন ঘর সাজিয়েছি আমাদের নিজস্ব রুচিবোধ অনুযায়ী ততদিনে শিপ্রাদি ছুটিতে চলে গেছেন অসুস্থ হয়ে, ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই তাঁর বহুদিনের, সাজানো ঘর তাঁকে দেখানো হয়নি। মানুষটি আপাতদৃষ্টিতে রাগী প্রকৃতির ছিলেন কিন্তু মনটা নরম ছিল, আমাদের দু’জনকে প্রশ্রয়ও দিতেন। আমাদের নামে কেউ কিছু বললে ওপেন মিটিংয়ে, বলতেন, ‘আমার দুই সুন্দরীকে কিছু বোলো না’।
দূরদর্শনে সংগীত সন্ধ্যা নামে একটি অনুষ্ঠান হতো অভিজিৎ দাশগুপ্তর পরিচালনায়। ওই অনুষ্ঠান করতে খুব ভালো লাগত, স্টুডিওর বাইরে বেরতে পারতাম। আইস স্কেটিং রিংকের অনুষ্ঠানের কথা খুব মনে পড়ে। এছাড়াও ম্যাক্সমুলার ভবন, গোর্কি সদনেও হত, তবে সেগুলো সংগীত সন্ধ্যা না ৯ অগাস্টের জন্মদিনের অনুষ্ঠান, সঠিক মনে নেই। আজকের প্রথিতযশা অনেক শিল্পী সেই সময় নবীন ছিলেন যাঁরা গান গেয়েছেন এই স্টেজ পারফরম্যান্সে। অনুষ্ঠানগুলি রেকর্ডিং করা হত, পরে এডিট করে প্রত্যেক সপ্তাহে দেখানো হত।
…………………………………
খুব রোগা মতো একটি ছেলে, গায়ের রংটা শ্যামলা, তাকে দেখে বলি, ‘একটু দেখবেন ভাই, অডিটোরিয়াম এ সামনের রো-তে রশিদ খান বলে কেউ আছেন কিনা’, সে শুধু বলল, ‘জি’, আবারও বলি, ‘প্লিজ একটু দেখবেন’, আমি তখনও তাঁকে ভাবছি ‘usher’ জাতীয় কেউ। এবার সে একটু ইতস্তত করে নম্রভঙ্গীতে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলে, ‘জি, ম্যায় হুঁ’।
…………………………………
আইস স্কেটিং রিংকের একটি ঘটনা বলতেই হয়। আমরা পালা করে আসতাম স্টেজে, আমি আর শাশ্বতী। এক এক জন শিল্পীর কাছ থেকে তাঁদের বিষয়ে জেনে নিয়ে তাঁদের সম্পর্কে চট করে লিখে নিতাম তারপর মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজের মতো করে তা বলতাম, অর্থাৎ যা করতে হতো তৎক্ষণাৎ, কোনও পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া। কাজটা সহজ ছিল না মোটেই। সেদিন ইন্দ্রনীল সেন, স্বপন বসু, শুভ্রা গুহ ছিলেন শিল্পীদের মধ্যে। আমি সঞ্চালনা করে স্টেজ থেকে বেরনোর পর অভিজিৎদা বললেন ‘এবার যে ছেলেটি গান গাইতে আসছে, ওর নাম রশিদ খান, দ্যাখো কোথায় আছে, খুঁজে নিয়ে জেনে নাও ওর সম্পর্কে’। আমি মেকআপ রুমে খুঁজে পেলাম না, এমন সময় অডিটোরিয়াম থেকে ব্যাক স্টেজে আসার যে দরজা সেটা দিয়ে উঠে আসছিল খুব রোগা মতো একটি ছেলে, গায়ের রংটা শ্যামলা, তাকে দেখে বলি, ‘একটু দেখবেন ভাই, অডিটোরিয়াম এ সামনের রো-তে রশিদ খান বলে কেউ আছেন কিনা’, সে শুধু বলল, ‘জি’, আবারও বলি, ‘প্লিজ একটু দেখবেন’, আমি তখনও তাঁকে ভাবছি ‘usher’ জাতীয় কেউ। এবার সে একটু ইতস্তত করে নম্রভঙ্গীতে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলে, ‘জি, ম্যায় হুঁ’। এবার লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার অবস্থা আমার, ‘সরি’ বলে পরিস্থিতি সামলাবার চেষ্টা করি। ও বলে, ‘কোই বাত নেই, দিদি, সরি মত্ বোলিয়ে’। আমরা মেকআপ রুমের দিকে এগোই। ও ওর জীবনের গল্প বলতে শুরু করে। রশিদ খানের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ এভাবেই। পরে কখনও দেখা হলে এই দিনের গল্প নিয়ে আমরা দু’জনেই হাসতাম।
……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব ……………………………
পর্ব ১১: প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত, গোলযোগের আশঙ্কায় দূরদর্শনের বাইরের গেটে ঝুলছিল তালা!
পর্ব ১০: সাদা-কালো থেকে রঙিন হয়ে উঠল দূরদর্শন
পর্ব ৯: ফুলে ঢাকা উত্তমকুমারের শবযাত্রার বিরাট মিছিল আসছে, দেখেছিলাম রাধা স্টুডিওর ওপর থেকে
পর্ব ৮: যেদিন বীণা দাশগুপ্তার বাড়ি শুট করতে যাওয়ার কথা, সেদিনই সকালে ওঁর মৃত্যুর খবর পেলাম
পর্ব ৭: ফতুয়া ছেড়ে জামা পরতে হয়েছিল বলে খানিক বিরক্ত হয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
পর্ব ৬: ভারিক্কিভাব আনার জন্য অনন্ত দাস গোঁফ এঁকেছিলেন অল্পবয়সি দেবাশিস রায়চৌধুরীর মুখে
পর্ব ৫: দূরদর্শনে মান্য চলিত ভাষার প্রবর্তক আমরাই
পর্ব ৪: রবিশঙ্করের করা দূরদর্শনের সেই সিগনেচার টিউন আজও স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসে
পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে