‘মা ও মেয়ে’র দু’টি অনুষ্ঠানের কথা আলাদা করে বলতে চাই। তৃপ্তি মিত্র, শাঁওলি মিত্রকে নিয়ে দুটি পর্বে বিন্যস্ত অনুষ্ঠানের প্রথমটিতে শাঁওলী বলেছে তার মায়ের কথা, দ্বিতীয়টিতে বলেছে তার নিজের কথা। সবগুলো ‘মা ও মেয়ে’ সিরিজের মধ্যে এ এক ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান। শাঁওলির সংগ্রহে রাখা বহু ছবি ও ক্লিপিংস আমরা ব্যবহার করেছিলাম এতে।
১৮.
অমলাশঙ্কর ও মমতাশঙ্করকে ‘ঘরে বাইরে’র আগেও একবার বসিয়েছিলাম একসঙ্গে, মালতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রযোজনায়, ৮ ডিসেম্বর উদয়শঙ্করের জন্মদিন উপলক্ষে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে। শিরোনাম ছিল ‘হে নটরাজ’। সেখানে ‘কল্পনা’ ছবির ক্লিপিংস ব্যবহার করা হয়েছিল। ‘মা ও মেয়ে’ সিরিজ শুরু করার আগে মম একাধিক বার এসেছে আমার অনুষ্ঠানে, তার মধ্যে একটি হল ওর সাক্ষাৎকারমূলক ‘ক্লোজ আপ’। এই সময় কিছুদিনের জন্য ক্লোজ আপ প্রযোজনা করতেন শর্মিষ্ঠাদি। মমকে যোগাযোগ করা হলে ও বলে, ‘কেয়া যদি আমার ইন্টারভিউ নেয় তবেই আমি যাব’। এই ধরনের শর্তে কর্তৃপক্ষ রাজি হয়ে যায়। পরবর্তীকালে বহু উল্লেখযোগ্য ক্লোজ আপ আমি সঞ্চালনা করলেও তার অনেক আগে এটিই আমার প্রথম ক্লোজ আপ সঞ্চালনা।
ফিরি ‘মা ও মেয়ে’র কথায়। দ্বিতীয় অনুষ্ঠানে এল ম্যাজিক পরিবার। জয়শ্রী সরকার তার তিন মেয়ে মানেকা, মৌবনী, মুমতাজকে নিয়ে জমিয়ে তুলল আসর। হাসি মশকরা গল্পে কখন যে সময় পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। আড্ডা যখন মাঝপথে তখন রঞ্জনা ওপরের প্যানেল থেকে জানায় এটারও দুটো এপিসোড হবে, ব্যস, তখন তিন মেয়েকে আর পায় কে! আবার গল্প চলল হৈ হৈ করে।
আরেক মায়েরও তিন মেয়ে কিন্তু মেজো মেয়ে সেই সময় বম্বেতে থাকায় দীপালী চক্রবর্তীর সঙ্গে বসল বিদীপ্তা ও সুদীপ্তা। নাটকের বাড়ির মেয়েরা এসেছিল তাদের মায়ের সঙ্গে, মা ভদ্রা বসু, মেয়ে মেনি (আনন্দী) ও বেণী (দামিনী)। গানে কথায় ভরপুর দুই পর্ব। গানের জগতের মা ও মেয়েদের মধ্যে এলেন সুমিত্রা সেন, কন্যা ইন্দ্রাণী ও শ্রাবণীর সঙ্গে। সকলের সঙ্গে পূর্ব পরিচয় থাকাতে গল্প করা সহজ হত। অন্তরা চৌধুরী এল ওর মা সবিতা চৌধুরীকে নিয়ে। সবিতাদি ও অন্তরাকে একসঙ্গে অবশ্য বসিয়েছিলাম অন্য একটি অনুষ্ঠানেও, সেটি সলিল চৌধুরীর জন্মদিন ১৯ নভেম্বরের আশপাশের কোনও সময় টেলিকাস্ট হয়েছিল।
ভারি মিষ্টি মেয়ে কৌশিকী চক্রবর্তী এল ওর ব্যস্ত শিডিউলের মধ্যে মা চন্দনা চক্রবর্তীর সঙ্গে। চন্দনাকে অবশ্য ‘ঘরে বাইরে’র আরও অন্য অনুষ্ঠানেও ডেকেছি, বন্ধুত্বের খাতিরে এসেছেও, যদিও স্বভাব অনুযায়ী ও অন্তরালে থেকে কাজ করতে বেশি পছন্দ করে।
নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে এলেন কলাবতী দেবী ও তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী বিম্বাবতী। মা ও মেয়ের কথোপকথন ছাড়াও এতে উপরি পাওনা ছিল কলাবতীদির নাচ। পূর্ণিমা ঘোষ এলেন ছোট কন্যা অভিনেত্রী চান্দ্রেয়ী ঘোষকে নিয়ে। স্টুডিওতে নেওয়া সাক্ষাৎকার অসম্পূর্ণ থেকে গেল কারণ বড় কন্যা ঐন্দ্রিলা তখন বিলেতে থাকত। আমরা অপেক্ষা করলাম, শীতে যখন সে কলকাতায় এলো তখন তার বাড়িতে গিয়ে শুট করে তৈরি হল পূর্ণাঙ্গ অনুষ্ঠান।
তনুশ্রী শঙ্কর আর ওর মেয়ে শ্রীনন্দা শঙ্করকে নিয়ে অনুষ্ঠানটি স্টুডিওভিত্তিক নয়, শুটিং করেছিলাম ওদের পাম এভিনিউ এর বাড়িতে। সাহিত্যিক বাণী বসু ও তাঁর কন্যা ইলিনা মিত্রকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করেছিলাম। তেমনি করেছিলাম রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী চিত্রলেখা চৌধুরী ও তাঁর মেয়েকে নিয়ে। স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত ও সোহিনী সেনগুপ্তকে নিয়ে মা ও মেয়ে অনুষ্ঠানটিও সংগ্রহে রাখার মতো। মঞ্চের অভিনেত্রীদের মধ্যে সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত তার মেয়ে কৃষ্ণকলিকে নিয়ে হয়েছিল অনুষ্ঠান।
আরেক প্রবীণ মঞ্চ অভিনেত্রী মণিকা চক্রবর্তী এসেছিলেন স্টুডিও-তে তাঁর মেয়ে অভিনেত্রী পাপিয়া সেনের সঙ্গে। আমার ইচ্ছে ছিল পরে কোনও সময় এই চক্রবর্তী পরিবার, যাঁরা তিন প্রজন্ম অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের সকলকে একসঙ্গে বসাব একটি অনুষ্ঠানে, কিন্তু সে আর হয়ে ওঠেনি। নবনীতাদির এপিসোড ভালো-বাসা বাড়িতে শুট করেছিলাম।
এই ধরনের প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানই আমরা রেকর্ডিং করতাম স্টুডিও অথবা আউটডোরে। তারপর এডিটিং টেবিলে আমরা খুব যত্ন নিয়ে, অনেক ছবি এবং ভিডিও যোগ করে দাঁড় করাতাম অনুষ্ঠান। ‘মা ও মেয়ে’র দু’টি অনুষ্ঠানের কথা আলাদা করে বলতে চাই। তৃপ্তি মিত্র, শাঁওলি মিত্রকে নিয়ে দুটি পর্বে বিন্যস্ত অনুষ্ঠানের প্রথমটিতে শাঁওলী বলেছে তার মায়ের কথা, দ্বিতীয়টিতে বলেছে তার নিজের কথা। সবগুলো ‘মা ও মেয়ে’ সিরিজের মধ্যে এ এক ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান। শাঁওলির সংগ্রহে রাখা বহু ছবি ও ক্লিপিংস আমরা ব্যবহার করেছিলাম এতে।
এখানে রাধা স্টুডিওর সময়কার একটি ঘটনা মনে পড়ল। তৃপ্তি মিত্র তখন খুবই অসুস্থ, হুইল চেয়ারে এলেন ‘সরীসৃপ’ নাটকের রেকর্ডিং করতে। সেই এক চিলতে মেকআপ রুমে অপেক্ষা করছেন ফ্লোরে যাবেন বলে, কাছে গেলাম, প্রণাম করলাম, থুতনি ধরে আদর করলেন। সেই শেষ দেখা। সম্ভবত এটিই তাঁর শেষ অভিনয়।
রুমা গুহ ঠাকুরতা ও শ্রমণা চক্রবর্তীকে নিয়ে মা ও মেয়ে তৈরি করা আমার বহুমূল্য ও একই সঙ্গে মধুর অভিজ্ঞতা। দুটি ভিন্ন পর্বে দু’জনকে ধরা আছে এই অনুষ্ঠানে। শ্রমণা ব্যাঙ্গালোর থেকে কলকাতা এসেছিল প্রবল গ্রীষ্মে। সেই সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের সত্যজিৎ ভবনে (এটাই ক্যালকাটা ইউথ কয়ারের অফিস ও রিহার্সালের জায়গা) শুট করা হল শ্রমণার এপিসোড। দুজনেই প্রচণ্ড ঘামছি, মেকআপ আর্টিস্ট বুদ্ধ (বুদ্ধদেব) মেকআপ রিটাচ করতে করতে হিমশিম খাচ্ছে, তার মধ্যেই দিব্যি চলল গান-গল্প। কিন্তু তার মা তো বম্বেতে, কিভাবে পাব তাঁকে? কলকাতায় আসার সম্ভাবনাও নেই অদূর ভবিষ্যতে।
মনের ইচ্ছে যদি প্রগাঢ় হয় তাহলে উপায় মিলেই যায়। ক’মাস পরে জুলাইয়ের ঘোর বর্ষায় বম্বে গিয়েছিলাম ছোট ছেলে ঋভুর কাছে। রুমাদিকে যোগাযোগ করলে তিনি যেতে বললেন। ঋভু ব্যবস্থা করল শুটিংয়ের, নিয়ে গেল আমাকে। বৃষ্টিতে জল দাঁড়িয়ে গেছে রাস্তায়, তার মধ্যে দিয়ে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম ‘গৌরী-কুঞ্জ’, কিশোর কুমারের বাড়ি। পা দিতেই শিহরন হল, এখানেই থাকতেন ওই কিংবদন্তি শিল্পী ! বাড়ির যে অংশটায় রুমাদির বাস সেখানের প্রশস্ত ড্রয়িংরুমে বসে অশীতিপর রুমা গুহ ঠাকুরতা ভেবে ভেবে বললেন, তাঁর রঙিন জীবনের গল্প। তৈরি হল তাঁদের নিয়ে মা ও মেয়ের দ্বিতীয় এপিসোড।
……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব ……………………………
পর্ব ১৭: বাংলা টেলিভিশনে সেই প্রথম ‘মা ও মেয়ে’ নিয়ে সিরিজ অনুষ্ঠান
পর্ব ১৬: রবীন্দ্রনাথের স্থাপত্যচিন্তা নিয়ে তথ্যচিত্র সেই প্রথম
পর্ব ১৫: ট্রেনে শুটিং-এর সময় সলিল চৌধুরী গেয়েছিলেন, ‘এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও’
পর্ব ১৪: দূরদর্শনের জন্য প্রথম তথ্যচিত্র করা আসলে ছিল অ্যাডভেঞ্চার!
পর্ব ১৩: সেন্ট পল ক্যাথিড্রালকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে সারা দুপুর সাপ্তাহিকীর শুটিং হয়েছিল!
পর্ব ১২: দূরদর্শন ভবনের উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী স্মিত হাসি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন দুই উপস্থাপকের দিকে
পর্ব ১১: প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত, গোলযোগের আশঙ্কায় দূরদর্শনের বাইরের গেটে ঝুলছিল তালা!
পর্ব ১০: সাদা-কালো থেকে রঙিন হয়ে উঠল দূরদর্শন
পর্ব ৯: ফুলে ঢাকা উত্তমকুমারের শবযাত্রার বিরাট মিছিল আসছে, দেখেছিলাম রাধা স্টুডিওর ওপর থেকে
পর্ব ৮: যেদিন বীণা দাশগুপ্তার বাড়ি শুট করতে যাওয়ার কথা, সেদিনই সকালে ওঁর মৃত্যুর খবর পেলাম
পর্ব ৭: ফতুয়া ছেড়ে জামা পরতে হয়েছিল বলে খানিক বিরক্ত হয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
পর্ব ৬: ভারিক্কিভাব আনার জন্য অনন্ত দাস গোঁফ এঁকেছিলেন অল্পবয়সি দেবাশিস রায়চৌধুরীর মুখে
পর্ব ৫: দূরদর্শনে মান্য চলিত ভাষার প্রবর্তক আমরাই
পর্ব ৪: রবিশঙ্করের করা দূরদর্শনের সেই সিগনেচার টিউন আজও স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসে
পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved