তিনটি গুণ। সত্ত্ব। রজোঃ। তমোঃ। মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষ এদের দ্বারাই চালিত। শ্রীরামকৃষ্ণদেব থেকে গীতা, এই গুণগুলির ব্যাপারে নানা সময় আলোচনা করেছেন, তত্ত্বের আকারে, কিংবা গল্পের রূপকে।
মানুষের মধ্যে তিনটি গুণ রয়েছে— সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ। মানুষের অন্তরে তিন গুণ খেলা করে। এরাই কোনও না কোনওভাবে মানুষকে বশীভূত করে রাখে, পরিচালনা করে। এই তিন গুণের প্রভাবে মানুষ তার আসল স্বরূপ ভুলে যায়।
কেমনভাবে এরা কাজ করে?
একজন ধনী মানুষ বনের পথ দিয়ে যাচ্ছিল। কোথা থেকে তিন ডাকাত এসে ঘিরে ধরল তাকে। ধনসম্পদ যা ছিল, সব কেড়ে নিল। এদের মধ্যে এক ডাকাত মত দিল যে, লোকটিকে মেরে ফেলা হোক। শুধু বলা নয়, তাকে কাটতে পর্যন্ত গেল। দ্বিতীয় এক ডাকাত মত দিল, মেরে কাজ নেই। তাকে বেঁধে ফেলা হোক, তাতে পুলিশে খবর দিতে পারবে না। কথামতো কাজ। তাকে বেঁধে ফেলে রেখে ডাকাতরা অন্যত্র গেল। কিছু সময় পরে তৃতীয় ডাকাত ফিরে এসে লোকটির বাঁধন খুলে দিয়ে বলল, ‘আহা তোমার বড় লেগেছে, না?’ তারপর তাকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তার কাছে এসে পথ দেখিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই পথ ধরে চলে যাও, এখন তুমি অনায়াসে নিজের বাড়িতে যেতে পারবে।’ লোকটি ডাকাতকে তার বাড়ি যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে বলল, ‘আপনি আমার কত উপকার করলেন। বাড়িতে গেলে আমরা খুবই আনন্দিত হব।’ ডাকাত রাজি হল না, পুলিশে ধরবে যে!
আমাদের জীবনে এই তিন গুণের ভূমিকা এই তিন ডাকাতের মতো। তমোগুণে বিনাশ হয়। প্রমাদ, আলস্য, নিদ্রা এইসব তমোগুণের লক্ষ্মণ। প্রমাদ হলে সব ভুল হয়। জীবনে আমরা অসতর্ক হই, ভালো কাজে মনোনিবেশ করতে পারি না। কোনও কাজে উৎসাহ থাকে না। অসতর্কতা, অবসাদ, ঘুম এসবই তমোগুণের কারণে। তমোগুণী ব্যক্তির দৃষ্টির স্বচ্ছতা থাকে না। কাজে ভুল হয়, বা মানুষ খুব সহজেই অন্যায় কাজ করে ফেলে। তমোগুণের আধিক্যে আমরা লক্ষ্যচ্যুত হই, জীবন থেকে হারিয়ে যাই । তমোগুণে বিনাশ হয়। প্রথম ডাকাতটি হল তমোগুণ, কারণ সে লোকটিকে মেরে ফেলার কথা বলেছিল। যে ডাকাত লোকটিকে না মেরে বেঁধে ফেলার কথা বলেছিল, সে রজোগুণ। সে মানুষকে বদ্ধ করে, সংসারের বহু কর্মে জড়িয়ে রাখে। তৃষ্ণা বা বাসনার মধ্যে সে একের পর এক কর্ম করে চলে। রজোগুণী মানুষের এই স্বভাব। নিত্যনতুন কর্মের পরিকল্পনা তার মধ্যে চলতে থাকে। তার মন ভীষণ চঞ্চল হয়ে পড়ে, হাজার কর্ম করেও শান্তি নেই। একটা অসংযত অস্থিরতা কাজ করে সবসময়। থাকবে কী করে? শান্তি যে অন্তরে, কিন্তু সেদিকে তার তাকানোর সময় নেই। তৃতীয় ডাকাত, যে কি না লোকটিকে বাঁধন মুক্ত করে দিয়েছিল, সে সত্ত্বগুণ। এই গুণ নির্মল। এই গুণে মানুষ সুখ অনুভব করে। মনে যদি প্রশান্তি অনুভব হয়, তাহলে বুঝতে হবে সেখানে সত্ত্বগুণের আধিক্য। সত্ত্বগুণ আমাদের চরম লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে দেয়।
শ্রীরামকৃষ্ণদেব তিন ডাকাতের গল্প দিয়ে এই তিন গুণকে চমৎকারভাবে বুঝিয়েছেন। গীতাতেও এই তিন গুণ নিয়ে সুন্দর আলোচনা রয়েছে। আমাদের ভিতরে এই তিন গুণ মিশে থাকে শুধু নয়, এক একসময় এক এক গুণের প্রাধান্য থাকে। দৈনন্দিন জীবনে একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, কোন গুণ বেশি কাজ করছে। যদি একটু সচেতন হয়ে দেখি, তমোগুণ বেশি রয়েছে, বেশি প্রভাব রাখছে, তাহলে সতর্ক হয়ে যাওয়া যায়। আর এই সচেতনতা আখেরে ফল দেয়। এতে নিজের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সুবিধে হয়।